আওয়ামী-লীগের শাস্তি

প্রশ্ন এটা নয় যে আওয়ামী-লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে কিনা? প্রশ্ন হলো তা নিষিদ্ধ করার পদ্ধতি ও সীমা নিয়ে। অর্থাৎ শুধু এই জনখেকো, দেশখেকো দলটি-ই নয় তার যে তথাকথিত রাজনৈতিক দর্শন কিংবা বিশ্বাস তা-কেও করতে হবে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে আল্লাহর উপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের মুচলেকা দিতে হবে। পরিষ্কার করে বলতে হবে যে বাংলাদেশের মানুষের অগ্রগতি ভারতের গোলামী ও পদলেহনে-ই নিহিত কিনা?

ক্ষমতা আরোহণের পূর্বে আওয়ামী লীগ যে সেটা পরিষ্কার করে বলেনি তা জাতীর সাথে বেঈমানি। যদিও এটাই তাদের একমাত্র বেঈমানি নয়। ইতিপূর্বে তারা মাথায় পট্টি বেঁধে, তসবীহ নিয়ে ক্ষমতায় এসে খোদাদ্রহীতায়, মুসলিম নিধনে লিপ্ত হয়েছিলো। কেন্দে কেটে জনগণের হাত-পা ধরে অর্থাৎ 'একটি বারের জন্য' ক্ষমতায় আসবার সুযোগ ভিক্ষা করে ক্ষমতায় এসে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে মাফিয়াতন্ত্র কয়েম করেছিলো।

জাতীর সাথে আওয়ামীদের এই বেঈমানির, এই বিশ্বাসঘাতকতার মূলে রয়েছে ‌'৪৭। যে সময় হিন্দু নির্যাতন, বিশ্বাস ঘাতকতা, ও শোষনের তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞতায় এই অঞ্চলের মানুষ পাকিস্তান নামক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হতে জীবন পণ করেছিলো। এতোটাই যে সিলেটের যে তিনটি গ্রাম প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না সেই তিন গ্রামের লোকেরা আন্দোলন করে, গনভোট নিয়ে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভূক্ত হবার ব্যবস্থা করেছিলো।

স্মরণ রাখা চাই যে মরহুম কায়েদে আযম বাঙ্গালীদের হাতে-পায়ে ধরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন নাই। বরং পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র তাঁর সামনে পেশ করা হলে পরে তিনি নাকি বলেছিলেন এই ছেঁড়া ফাটা অংশ নিয়ে আমি কি করবো? এটা গুরুত্বপূ্র্ণ। কেননা বিলাতী ঔপনিবেশিক আমলে এই অঞ্চলের মতো ভয়াবহ শোষণের স্বীকার অন্য কোন অঞ্চল হয় নাই। মুসলিম সুলতানী শাসনামলের বদান্যতায় সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা এই অঞ্চল যেভাবে বিশ্বের তাবৎ উপনিবেশকদের নজরে পড়ে, তেমনি উপমহাদেশের স্বাধীনতা বিলোপের সূচনাটাও হয়েছিলো সর্বপ্রথম বাংলার পতনের মধ্য দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ দুশ বছরের শোষণে এই অঞ্চল ছোবড়ায় পরিণত হয়ে পড়েছিলো। অর্থাৎ বাংলা যে একটা দায় বা লায়াবিলিটি তার ধারণা কায়েদে আযমের ছিলো।

তা সত্ত্বেও '৪৭ উত্তর বাংলার যেভাবে শনৈ উন্নতি সাধন হচ্ছিলো তা চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো দুই শ্রেণীর লোকের। এক যারা নানা কারনে '৪৭ বিভাগ মেনে নিতে পারেনি। এই শ্রেনীতে মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুয়ানী মানসিকতার মুসলিমদের প্রাধান্য থাকলেও হোসাইন মাদানীর অনুসারীদের মতো দেওবন্দী ঘরানার কিছু হুজুরও এতে শামিল ছিলো। আরেক শ্রেনী ছিলো পুরোপুরি অধৈর্য-স্বার্থাণ্বেষী। পাকিস্তান তৈরীর পর তারা রাতারাতি রাষ্ট্র্য ক্ষমতা ও ধন-সম্পদ আরোহণে হন্যে হয়ে উঠেছিলো। যদিও, না তাদের ছিলো শাসন কার্যের উপযোগী ধীশক্তি ও অভিজ্ঞতা, না ছিলো ব্যবসার পুঁজি ও উদ্যম। ড. সাজ্জাদ হোসেনের কিতাবের মূল প্রতিপাদ্য এটাই বলে শুনেছি।

'৪৭ থেকে '‌৭১ পর্যন্ত যতো রাজনৈতিক অনাচার সংঘটিত হয়েছে তার মূলে ছিলো এটাই। তবে এর বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কোন দায় ছিলো না তাতো নয়। কিন্তু সেটার অবতারনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। অর্থাৎ মাওলানা মওদুদী রহ: যেভাবে সতর্ক করেছিলেন যে পাকিস্তান নামক একটি বিশ্বাস ভিত্তিক, ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণের যোগ্যতা মুসলিম লীগের নেতাদের নাই। সেটাই প্রমাণিত হয়েছিলো। শুধু মুসলিম লীগ-ই নয় ইসলামের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ছিলো মূলত বিলাতী ঔপনিবেশিক কাফিরদের গর্ভজাত। সুতরাং লাগ ভেলকি লাগ!

এই প্রেক্ষাপটে যখন '৭১ কে পাঠ করবেন তখন অনেক হিসাব মিলে যাবে। '৭১ এর বহু পূর্বেই কেনো একটি মুষ্টিমেয় গোষ্ঠী ভারতের প্রত্যক্ষ মদদে বাংলাদেশের ভেতরে গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো, সেই পরিক্রমার চূড়ান্ত পর্যায়ে কেনো পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারী নৃশংস পন্থায় বিদ্রোহ দমনে সচেষ্ট হয়েছিলো, তার প্রেক্ষিতে কেনো ভারতীয় কাফির বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পবিত্র ভূমি রক্ষার যুদ্ধে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেবের মতো হিলাল-এ-জুররাত খেতাব প্রাপ্ত সামরিক অফিসারও নিজ বাহিনী ও কমান্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলেন - এ সবের সঙ্গতি পূর্ণ ব্যাখ্যা উপস্থাপন কঠিন নয়।

সুতরাং রাষ্ট্রখেকো, জনখেকো আওয়ামী লীগের মূল অপরাধ ফৌজদারী নয়, রাজনৈতিক। তার ফৌজদারী অপরাধের মূলে রয়েছে তার রাজনৈতিক অপবিশ্বাস, অপদর্শন। সেই দর্শন অনুযায়ী ভারতের দাসত্ববৃত্তি ব্যতিরেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর জনগনকে এই ঘুম-পাড়ানী মাসী-পিসির গান শোনানোর ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় জনগনের ঈমানী জোশ। সেই জোশ কমানো যাবে না যাবৎ ইসলাম এ অঞ্চলের জনমনকে আচ্ছন্ন করে রাখছে। মূল দ্বন্দটা এখানেই।

অতএব আওয়ামী-লীগের অপরাধের শাস্তিও হওয়া চাই ফৌজদারি এবং রাজনৈতিক। শুধু ফৌজদারি শাস্তি বিধান নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। আর রাজনৈতিক শাস্তি বিধানের পন্থা হলো এই যে আওয়ামী রাজনীতির মূলে যে অপদর্শন, খোদাদ্রোহীতা, জনদ্রোহীতা, জ্ঞানের বিকৃতি একে চিহ্নিত করে এর থেকে উৎসারিত অপতত্ত্ব সমূহের চর্চা আইনত নিষিদ্ধ করা। এই রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অপচিন্তা প্রসারের পথকে সংকুচিত করা। এই দলের পূঁজোনীয় নষ্টের গোড়া গুলোর যে প্রতীমূর্তি তার ধ্বংস সাধন। এবং এই আইনী প্রক্রিয়ার পাশাপাশি যা কিছু আওয়ামী তার বিপরীতে বৈচিত্র্যপূ্র্ণ, সুস্থ প্রতিযোগিতাপূর্ণ, স্বত:ফূর্ত অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার ঘটানো। মনে রাখবেন আইনানুগ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি যেখানে পৌঁছাতে অক্ষম সেখানে সামাজিক সুবিচার কার্যকরী হতে পারে। আইন দিয়ে প্রকাশ্য শয়তানিকে দমন ও নির্মুল করা সম্ভব কিন্তু এর কার্যকর প্রতিরোধ সম্ভব হয় তখনই যখন এর বিরুদ্ধে জন সচেতনতা তৈরী হয়। সেই জন সচেতনতা তৈরী ও জিইয়ে রাখতে প্রয়োজন হয় সুস্থ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিনির্মান।

Popular posts from this blog

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

ইসলাম ও গণতন্ত্র

জামাতের ভোট: একবারে না পারিলে দাও শতবার