হীন জাতের উত্থান
হীন জাতদের উত্থানের প্রসঙ্গ আসলেই দেশের অভিজাত এলাকা সমূহে প্রকম্পন শুরু হয়ে যায়। কারন বাংলাদেশে এই শ্রেনীটির নির্মাণ ও সংজ্ঞায়ন হয়েছে হীনজাতদের দ্বারা। যার ফলে এই জাতীয় সংলাপ এদের জন্য এক প্রকারের অস্তিত্বের হুমকি স্বরুপ। যদি তা নাও হয় তবে নিদেনপক্ষে অস্বস্তিকর তো বটেই।
এক্ষেত্রে একটা নৈতিক প্রশ্ন-ও সামনে চলে আসে। আর তা হলো, হীন জাতদের কি উত্থান ঘটতে পারেনা? তাদের কি উন্নয়নের অধিকার নেই?
এটা একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারন উন্নয়ন বা তথাকথিত upward-mobility বলতে কেবলই জাগতিক উন্নয়নকে নির্দেশ করা হয়। মননের উন্নয়ন এখানে অনুপস্থিত। বরঞ্চ মানসিক উন্নয়ন যখন জাগতিক উন্নয়নের সাথে তাল দিয়ে ঘটতে পারে না তখনই সৃষ্টি হয় যাবতীয় বিপত্তির।
তবে এই বিষয়ক আলাপের পূর্বে জাতের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রেও জাগতিক মাপকাঠির বিচারের পাশাপাশি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিচারের মানদন্ডকেও স্থাপন করা জরুরী। সেই হিসাবে হীনজাত মূলত ধর্মীয় শিক্ষার অনুপস্থিতিকেই নির্দেশ করে। ধর্মীয় শিক্ষার উপস্থিতিতে তার আত্মস্থকরণের অভাবকে নির্দেশ করে।
ধর্মীয় শিক্ষার পরও তার আত্মস্থকরণের অভাব ঘটবার মূলত কয়েকটি কারন। এক: দূর্বল ঈমান দুই: দূর্বল চরিত্র তিন: ধর্মীয় পরিবেশের অভাব চার: নূন্যতম জাগতিক প্রয়োজন মেটাবার সামর্থ্যহীনতা।
এ কারনে দেখা যায় ধর্মীয় শিক্ষাহীন কারও জাগতিক উত্থান তার কদর্যতা ও হীনতাকে প্রকট করে তোলে। বিপরীত পক্ষে ধর্মীয় শিক্ষায় বুৎপত্তি অর্জনকারীর জাগতিক উত্থান ঘটলে স্বল্পতম সময়ে সে তার হীনতার সংশোধন করে নিতে পারে। ধর্ম শিক্ষাহীন একজন হীন ব্যক্তির জাগতিক উত্থানগত বিপর্যয়ের আরেকটি দিক হলো এই যে উত্থানের পরিক্রমায় আভিজাত্য চেনা ও তার অনুকরনে তার কোন নির্দিষ্ট মাপকাঠি থাকে না।
এ কারনে একটা বাংলা যখন বিলাতীদের অনুকরণে তার পোশাকে, খাদ্যাভ্যাসে, ও ব্যবহারে বিলাতি অভিরুচীর প্রকাশ ঘটায় তার রুপগত অসংগতি কখনোই তার নিকট ধরা দেয় না। আর নৈতিকতার কথা তো বলাই বাহুল্য।
উদাহরণত একটা সামরিক অফিসার বিলাতি শিষ্টাচারের নীতিতে (etiquette) এক হাতে নাক-মুখ ঢেকে যখন অন্য হাত দিয়ে আরাম করে ইউটিউয়ুবে ওয়েব ক্যামের সামনে নাক-দাঁত খুঁচিয়ে চলে তখন কিন্ত সে নিজেকে বিলাতের একজন বড়োলাটাই গন্য করে। মনে করে উপস্থিত সিভিয়ান চাষাভুষাদের সে উন্নত জীবন সম্পর্কে ধারণা দিয়ে অনেক উপকার করছে। এদিকে যে এটিকেটের পেটিকোট খুলে গিয়েছে সে সম্পর্কে সে একেবারে অবিদিত।
একারনেই গাঁও গেরাম থেকে উঠে আসা একটা এনুভার্সিটির শিক্ষক বাটাম ড়াসেল কপচাইতে মুখিয়ে থাকে। ইসলামকে দিগম্বর করতে গিয়ে সে নিজেই কখন দিগম্বর হয়ে গিয়েছে তার হুঁশ তার থাকে না। নতুন বাল গজানো বান্দীর পোলাটা যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পা দেয় কিংবা ভাটিয়ারীতে প্রথম টার্ম শেষ করে তখন দেমাগে তার পা মাটিতে পড়ে না। সে হাওয়ায় ভাসে। কল্পনায় সে তার চাইতে জাগতিক বিচারে উন্নত-অভিজাত পরিবারের সুন্দরী কন্যার সাথে সংসার ধর্ম পালনের স্বপ্নে বিভোর থাকে। ছোলজার, ছোলজার, মিঠা ভাতে ভড়কে ... ঠিক হইছে?
কালের বিবর্তনে ভূমিহীনের মেয়েটা ডাক্তার হয়। ঢাকা শহরে ফ্ল্যাটের মালিক হয়। অর্থাৎ সে এখন লেন লঠ। সে কর্নওয়ালিস। সে কারও ছারবেন না। সে কল্পনা করে যে বংশ পরম্পরায় সে অভিজাতই ছিলো। সে মেজর। তার পিতা বিগেডিয়ার। তার দাদা ফিল মার্শাল। মাই ছান ইনলেন ছফটওয়ার জেনারেল। তার পরিবারের সবাই বরাবরই জেনারেলই ছিলো। এখন সবার উচিত হইলো তাকে নম:নম: করে চলা। একটা পাদ দেয়ার আগে তার অনুমতি নিয়ে নেয়া। এপ্লিকেশন করা। এরপর কমেডি বসবে। সেখানে পাস হবে। তারপর পাদ দিতে পারবেন। এটাই নিয়ম। দেশের জন্য কি এতোটুকু ছেককিফাইস কত্তে পারবেন না?
হীনজাতদের উত্থান জণিত সংকট সবচেয়ে জঘণ্যভাবে প্রকাশ পায় দেশের শিল্পবদিদের প্রাত্যহিক জীবনে। তারা বাইকে বিকট শব্দের ছাইলেনছার লাগিয়ে বুম বুম করে ঘুরে বেড়ায়। মাগিবাজী করে। সিসা টানে। নেশা করে। তাদের আদর্শ বলিউডের সোনার চেইন গলায় ঝোলানো নায়ক কিংবা বড়োজোর হলিউডের টম কুরুজ। টংয়ের দোকানদারদের মতো সে ঢাকা শহরের জ্যামে রোলস রয়েসের টমটমে চড়ে বসে থাকে। এটাই তার তৃপ্তি (fulfillment)। এটাই তার অভিলক্ষ্য। বড়জোর সে হেনরী ফোর্ডের একশ বছর আগের বুলি নকল করে দেশকে মোটরযান দিয়ে ভরিয়ে দেয়ার গালগপ্পো শোনাতে পারে। একটা ভূমিদস্যু, একটা বিড়ি ফ্যাক্টরীর মালিকের থেকে এর চেয়ে বেশী আর কি আসা করা যেতে পারে? যাদের উত্থান হয়েছে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে তাদের থেকে ব্যাংক চুরি ছাড়া আর কোন রাষ্ট্র্যকল্প কি করে প্রত্যাশা করা যায়?
হীন জাতের উত্থানের এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো বিড়ম্বনা। বস্তি থেকে উঠে এসে সে পুরো রাষ্ট্রটাকে বস্তি বানিয়ে ফেলে। তার রুচিতে, তার চলনে, তার বলনে বস্তিপট্টির ছাপ। হীন জাতের উত্থানও ঠিক এ কারনেই প্রতিরোধযোগ্য। তার অনাকাঙ্খিত উত্থানের পর তার অবতরণও এ কারনেই কাম্য।
বাংলাদেশে একটি বিশেষ শ্রেনীর যে মুক্তিযুদ্ধ প্রেম তাও কিন্তু এই হীন জাতের উত্থান জনিত। একাত্তুরে লুটপাট বিহারী-পাকিস্তানীদের সম্পদ দখলের সূত্রে যাদের উত্থান, একাত্তুর না হলে যারা কেবল একটা সরকারী চাকুরে হিসেবে জীবনপাত করতো - একাত্তুর তাদের জন্য জীবন-মরণের প্রশ্ন। কিন্তু সমস্যাতো সেখানে নয়। সমস্যা হলো বাঁদীর গলায় মুক্তার মালা পরালেই যেমন সে মালকিন হয়না তদ্রুপ হীনজাতরাও কোনদিন অভিজাত হয়ে উঠতে পারেনা। এইটা তাদের ধাতে নাই।
এই ২০২৫ সালে এসেও যে বাঙ্গালীর বুদ্ধিজীবি, ক্ষমতাধর শ্রেনীটি ধর্ম, রাজনীতি, ক্ষমতা, ন্যায়বিচার, সংবিধান, রাষ্ট্রকল্পের বুনিয়াদী বোঝাপড়া নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তাও হীনজাতের লক্ষ্যণ-ই বটে।
পাঠক, ধর্ম ব্যতিরেকে জাতের উত্থান অসম্ভব। আর জাগতিক উত্থান মানেই যে জাতের উত্থান নয় তা প্রতিষ্ঠা করতেই এতো কথার অবতারণা। তবে একটি হাদীস স্মরণ করিয়ে দেই যেখানে বলা হচ্ছে যে, তোমাদের মধ্যে যারা ইসলাম পূর্ব যুগে উত্তম, তারা ইসলাম পরবর্তী যুগেও উত্তম। এর মানে হলো ধর্ম শিক্ষা দিয়ে সব কিছু বদল করা যায় না। মানুষের মাঝে কিছু অন্তর্বর্তী গুণাবলী কিংবা ত্রুটি থাকে যা ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সম্পৃৃক্ত নয়। অর্থাৎ বলতে চাচ্ছি যে যারা জাতে হীন তাদের ধর্ম শিক্ষা দেয়া হলেও তাদের মুসলমানের চাইতে বাঙ্গালী হয়ে ওঠার আশংকা-টা বেশী।