জুলাই কাহা-নি
জুলাইয়ের পটপরিবর্তনের পর অর্ধ-বৎসর পার হতে চললো। বহু ঘটন-অঘটনের মধ্য দিয়ে ঈমান এবং কুফর এর লড়াই, এই ব-দ্বীপের ইসলাম প্রিয় জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ও স্বাধীকার আদায়ের লড়াই প্রকট হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক সময়ে যা প্রকাশ পেয়েছে মজলুম জননেতা এটিএম আজহারের মুক্তির আন্দোলনে। এর ফলাফলের ওপর জুলাইয়ের পট-পরিবর্তনের যথার্থতা নির্ধারিত হবে। ছায়ারাষ্ট্র্যের স্বার্থান্ধ, খোদাদ্রোহী, বিভ্রান্ত, ও কপট কারিগরদের ক্ষমতার গভীরতাও বোধ করি এর মধ্য দিয়ে প্রকাশ পাবে।
যদিও এটিম আজহারের মুক্তি এবং বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের জনগণ বিশেষ করে মুসলিমদের কল্যাণকামী একমাত্র পরীক্ষিত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পাওয়া নিকট ভবিষ্যতের জটিল সংগ্রামের একটা দিক মাত্র। কেননা এই সংগ্রামে ময়দানের লড়াইয়ের সাথে চিন্তার লড়াইয়ের মেল বন্ধন করানোটা অতীব জরুরী। বাঙ্গালীর দুর্বল আকলজ্ঞান এই মেল বন্ধনের পথে প্রধান বাধা হলেও এর ক্ষেত্র তৈরী করেছে আন্দোলনের সুবিশাল জনগোষ্ঠী যারা তাদের লক্ষ্যের প্রতি একনিষ্ঠ হলেও সেই লক্ষ্য অর্জনে দলীয় কর্ম ও চিন্তা পদ্ধতিকে পুরোপুরি রপ্ত করতে পারেনি।
এই বিষয়টা মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব উপলব্ধি করেছিলেন প্রায় দুই যুগ আগে। অনুকুল পরিবেশ থাকা স্বত্ত্বেও তাঁর সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেয়ার কারন হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতি জন সমর্থন যে হারে বেড়েছে সেই হারে ইসলামপন্থী রাজনীতির উপযোগী কর্মীবাহিনী ও জনগোষ্ঠী তৈরী হয় নাই। সংগঠনের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এক বিশাল জনগোষ্ঠী তৈরী হয়েছে বটে তবে তাদের ধর্মীয় ও জাগতিক যোগ্যতা কাঙ্খিত মানে এখনও পর্যন্ত নেয়া সম্ভব হয় নাই।
জুলাই ও তৎপরবর্তী যে কর্মকৌশলগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক নৈরাজ্য তার মূলে রয়েছে ইসলামকে এবং বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ইসলামী রাজনীতিকে সঠিকভাবে রপ্ত করতে না পারার ব্যর্থতা।
সেই সূত্রে এটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে জুলাইয়ের পট পরিবর্তন না বিপ্লব, না অভ্যুত্থান। বরং তা গণ-বিস্ফোরণ। কোটা আন্দোলন মূলত ছিলো একটা সুনির্দিষ্ট সুবিদাভোগী শ্রেনীর স্বার্থের দ্বন্দ্ব। কিন্তু আমাদের মাওলানা রহ: সাহেব যেমন বলেছিলেন: তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। মহান আল্লাহ আওয়ামীর পয়দাদের দিয়েই আওয়ামী জুলুম নিপাত করেছেন।
আমি প্রথম থেকেই এটাকে কুত্তার কামড়াকামড়ি হিসেবেই দেখেছি। বিগত এক যুগে জামাত ও দেশের জনগণকে আওয়ামী বন্দুকের নলের মুখে ঠেলে দিয়ে ক্ষমতায় যাবার এবং ব্যর্থতার যে কোন সম্ভাবনায় পেছন থেকে সরে যাবার বিএনপির যে অপ-রাজনীতি, তাতে কোটাবিরোধী আন্দোলনে জামাতের না যাওয়াটাই আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছিলো।
কিন্তু এই প্রশ্নও ছিলো যে তাহলে আওয়ামী জুলুমের অবসানের উপায় কি? যেভাবে ধীরে ধীরে একটি মুসলিম প্রধান জনগোষ্ঠীকে ইসলাম শূন্য করে স্পেনের পরিণতি বরণ করার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তাতে যে কোন মূল্যে আওয়ামী খোদাদ্রোহীতার পতন চাওয়াটা ছিলো বাস্তবতার দাবী। কিন্তু তাতে যে প্রশ্নের উত্তর মেলে না, সে প্রশ্নটা হলো, পতন হবে কি করে?
আমার কাছে এর উত্তর ছিলো পরিষ্কার। এবং তা নিয়ে আমার লেখায় কিছুটা ঈঙ্গিতও দিয়েছিলাম। আর তাহলো প্রথমত এই স্থির বিশ্বাস যে আওয়মীদের পতন অনিবার্য। তবে তা কিভাবে হবে তা বলা মুশকিল হলেও তা যে হবে সে ব্যাপারে ইয়াকীন থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। হতে পারে তা হবে ইরানী শাহের পতনের মতো। যেই শাহের পতনের একদিন আগেও তার জেনারেলরা দাবী করেছিলো: ফরিবেশটা শনদর না? কোন বেজাল আসে?
কিংবা নিকৃষ্ট ক্ষেত্রে সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী হতে পারে। অনেকের মতো আমিও এক সময় মনে করতাম যে চারিদিকে শত্রু রাষ্ট্র পরিবেষ্টিত হয়ে মু'মিনদের মুক্তির আন্দোলনকে চালিয়ে নেয়াটা হবে অসম্ভব। পরবর্তীতে উপলব্ধি করি যে বর্তমান যুগ কানেক্টিভিটির যুগ। গাজ্জার লোকেরা চতুর্দিকে বৈরী রাষ্ট্র্য পরিবেষ্টিত হয়ে যদি প্রায় একশো বছর যাবত টিকে থাকতে পারে, ভারতের সেভেন সিস্টার্সের বিদ্রোহীরা যদি ভারতের পেটের ভেতরে থেকে টিকে থাকতে পারে তাহলে বাংলাদেশও পারবে।
তবে সেক্ষেত্রে কথা হলো সেদিকে দেশকে যেতে দেয়াটা কতোটুকু সমীচীন হতো? যেখানে গৃহযুদ্ধের ফাঁদে পা না দেয়ার প্রাজ্ঞ বোঝাপড়া থেকেই জামাতের শীর্ষ নেতারা বরং নিজেদের ফাঁসিকে বরণ করে নিয়েছিলেন, সেখানে অজস্র নেতা কর্মী হারাবার অর্ধ যুগ পরে এসে সেই একই ফাঁদে পা দেয়াটা কতোটুকু গ্রহণযোগ্য হতো? জামাতের নেতাদের, বিশেষ করে কামারুজ্জামান, যিনি ফাঁসীর দড়ি সামনে রেখে সুস্পষ্টভাবে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে তাঁদেরকে কোলেটারাল ড্যামেজ ধরে কি করে বিরুপ পরিস্থিতিতে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখা যায় তার ব্যবস্থা করতে। এটা যে কি পরিমাণ সাহসিকতা ও দূরদর্শীতা তা বুঝতে জামাতেরও বহু লোকের জীবন পার হয়ে যাবে।
বাস্তবিক হাসিনা ক্ষমতায় থাকার সময় জামাতেরও অনেকেই তার ভূয়সী প্রশংসা করতো। এটা হজম করাটা ছিলো অত্যন্ত পীড়াদায়ক। কিন্তু প্রকৃত সত্য ছিলো এই যে জামাতের নেতাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হাসিনা নিজে নিজের পায়ে কুড়োল মেরেছে। এইটা সে যাদের বুদ্ধিতে করেছিলো তাদের ব্যাপারে আমাদের মওলানা রহ: সাহেব তাকে আন্তরিকভাবেই সর্তক করেছিলেন। কিন্তু কথায় বলে চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনী।
সুতরাং কায়েমী স্বার্থবাদী দজ্জালী গোষ্ঠী হাসিনার মাধ্যমে তাদের পরিকল্পনার কিছু অংশ বাস্তবায়ন করতে পারলেও জামাত তাদের ফাঁদে পা না দেয়ায় তাদের পুরো হিসেব নিকেষ ভজকট হয়ে যায়। তথাপি আমি যতোটুকু বুঝেছি বস্তুজগত যেমন নিউটনীয় সূত্রাবলী মেনে চলে তেমনি মানব সমাজের রয়েছে একটি নির্দিষ্ট গতি-প্রকৃতি। সেই হিসেবে জামাত যতোই চেষ্টা করুক বিধির বিধান থেকেতো জাতিকে তারা ফিরাতে পারতো না। আওয়ামী দু:শাসন চলতে থাকলে বরং সিরিয়ার ইখওয়ানের মতো তারাও দেশের জনগণ ও তাদের সুবিশাল কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতো। কোন না কোন সময় দেশ পড়ে যেতো গৃহযুদ্ধের দজ্জালী ফাঁদে।
সুতরাং কোটা-বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকে ছাত্রদেরকে বিএনপির উস্কে দেয়ার প্রবণতা আমাকে বিস্মিত করেনি। করেছে অশ্রদ্ধ। ছাত্ররাও কিন্তু পুরোটা সময়ের কখনোই তাদের ম্যাজিক মামনির পতন চাওয়ার দু:সাহস দেখায় নাই। অথচ সেটাই ছিলো জনগণের সবচেয়ে বড়ো চাওয়া, সব সমস্যার মূল। কিন্তু যখন দেখা গেলো সরকারী বাহিনীর গুম-খুনের প্রেক্ষিতে ছাত্রদের আন্দোলন চুপসে যাচ্ছে সেই সময় ধাপে ধাপে ছাত্র হত্যায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পদত্যাগ ও বিচার চাওয়া থেকে নিয়ে সর্বশেষ হাসিনার পদত্যাগের কৌশল গ্রহণে আমার মনে হয়েছিলো যে খুব সম্ভব জামাত এর পেছনে থাকতে পারে। পরবর্তীতে যা দিবালোকের মতো উন্মোচিত হয়েছে।
এভাবে যে একটা নিষ্ঠুর, পাশবিক শোষক শ্রেনীর রাতারাতি পতন হতে পারে তা আমার নিকট ছিলো অকল্পনীয়। এর ফলে শাসন ক্ষমতায় জামাতের দক্ষতার প্রতি আমার আস্থা বেড়ে গিয়েছে ঢের। যদিও এই পরিবর্তনে আমি বাঙ্গালীর চিরায়ত অস্থিরমত্তা, সুবিধাবাদী, ও ভীরু স্বভাবকেই প্রধান নিয়ামক হিসেবে দেখতে চাই। যা জনগণের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা আওয়ামী প্রশাসনের রাতারাতি পলায়নের মাধ্যমে প্রমাণিত। এই দুশ্চরিত্র, দেশের নিরীহ জনগণের জন্য, শাপে বর হয়েছে এটাই স্বান্তনা।
সুতরাং আবারো বলছি, জুলাই পট-পরিবর্তন মূলত একটা গন-বিস্ফোরণ। কেননা বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের সুদীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে, থাকে কুশীলব-সংঘ। সর্বোপরি এ দুয়েরই থাকে অভীষ্ট লক্ষ্য। কিন্তু বিস্ফোরণ না সংগঠিত না লক্ষ্যভেদী। বরং তা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। দুশো বছরের সুদীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণ ও উপনিবেশোত্তর বিশৃঙ্খলার জাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে অতিষ্ঠ হওয়া জনগণের ক্ষণিকের তরে পৌন:পুনিক প্রতিক্রিয়া মাত্র।
সিরিয়ার পট-পরিবর্তনের সাথে তুলনা করলে আমরা তার প্রমাণ পাই। উপনিবেশোত্তর যে রাষ্ট্রযন্ত্র নাগরিকের পালন ও বিকাশের পরিবর্তে তার দমন ও শোষনে-ই ব্যস্ত ছিলো বেশী, যার সশস্ত্র বাহিনী সমূহ জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে জনগণের সম্মিলিত অভিপ্রায়ের প্রতিফলন ঘটানোর পরিবর্তে আন্তর্জাতিক শক্তির তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে কেবল নিজের স্বার্থ গুছিয়েছে, যার আমলাতন্ত্র রাষ্ট্র্যযন্ত্রকে সাজিয়েছে জনগনকে জিম্মি করে নিজের আখের গোছানোর জন্য, যার বিচার ব্যবস্থা করেছে শিষ্টের দমন, দুষ্টের পালন - সেই রাষ্ট্র্যের বিলোপ হয়েছে সমূলে। তার সশস্ত্র বাহিনীর কুলাঙ্গারগুলো কুয়োর ব্যঙ্গের মতো গর্তবাসী হয়েছে। তার আমলা, বুদ্ধিজীবি, মাফিয়া ব্যবসায়ীগুলো হয়েছে দেশান্তরী।
কিন্তু জুলাই পট-পরিবর্তনের পর তথা-কথিত "বিপ্লবী”-রা নিজেরা ক্ষমতা না নিয়ে অন্যদের বসিয়েছে। এবং তা এ কারনেই যে ক্ষমতা আদপে তাদের নিকট যায় নাই। যায় নাই বলেই ১/১১ এর পুরান পাপীরা ফিরত এসেছে। রাজনীতি বিরোধী ও সামরিক-পুঁজি তন্ত্রের সহায়ক সেই পুরনো বয়ান ফিরে আসছে। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ১/১১ এর কুশীলবরা ২৮ অক্টোবরে লগি-বৈঠার নৃশংসতার সূত্রে ক্ষমতা দখল করলেও তার বিচার কিন্তু অদ্যবধি তারা করে নাই। জোট সরকারের ওপর ভুয়া ভোটার তালিকার দায় চাপিয়ে জনগণকে ফিঙ্গার দেয়া হলেও সুষ্ঠ ভোট কিন্তু আর হয় নাই। হয়েছে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং। রাজনীতিকে, রাজনীতিবিদদের বলির পাঁঠা বানানো হলেও বিগত এক যুগে ধরে চলা অপরাজনীতির প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগ করেছে এই গোষ্ঠীটি।
বর্তমানে চলছে পঁচন আলো ও দিল্লী স্টার গ্যাং এর সাগরেদ সহযোগে বিপ্লবের ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নয়া সংবিধানের নামে এক মড়া মূষিক প্রসবের নাটক। যে অঞ্চলের বাসিন্দারা একত্ববাদী তাদের ওপর বহুত্ববাদের বিশ্বাস চাপানোয় প্রতিবাদ হয়েছে মেলা। কিন্তু জনরোষের ডামাডোলের চিপা দিয়ে যে কমিউনিস্টবাদী সাম্যের আলাপও জুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা নিয়ে কথা বলছে না কেউ।
এটা ব্যাখ্যা করা দরকার। কারন এর সাথে কোটাবিরোধী আন্দোলন কিংবা যাহা লাউ তাহাই কদুর মতো একই জিনিসকে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন বলে পুন:নামকরন করার বাটপারি জড়িত। কারন যদি একে কোটাবিরোধী বলা হয় তবে তা ফুলার রোড কিংবা পলাশীর টাট্টিখানাগুলোর কামড়া-কামড়ির যে বর্ণাঢ্য ইতিহাস তারই বিরক্তিকর পুনরাবৃত্তি। কিংবা উপনিবেশোত্তর বাঙ্গালীর যে স্রেফ পেটে-ভাতের লড়াই তারই নয়া সংস্করণ। কিন্তু যদি এটাকে বৈষম্য বিরোধী বলা হয় তাহলে ক্ষেত্র বিশেষে তা হয়ে ওঠে খোদাদ্রোহী। কারন সাম্য বা বৈষম্যের এই অবাস্তব আলাপের সূত্রেই ফরাসী বিপ্লব ও তৎপরবর্তী যতো অঘটন, সহিংসতা, গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো যা সর্বশেষে খোদাদ্রোহীতায় পর্যবসিত হয়।
এই যে সরকারি-বেসরকারি টাট্টিখানার বলদগুলোর মাথায় সাম্য ও বৈষম্যের আলাপ ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে এর অবশ্যম্ভাবী ফল হলো খোদাদ্রোহীতা। কারন অচিরেই তারা উপলব্ধি করবে যে অসাম্য কিংবা বৈষম্য মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের তৈরী এই ক্ষণস্থায়ী জগতের অন্যতম নিদর্শন। আফটার অল কেউ সুস্থ সবল ভাবে জন্ম নেয় আর কেউ বিকলাঙ্গ বা দৃষ্টিশক্তিহীন হয়েই জন্ম নেয় - এর চাইতে অধিক বৈষম্য আর কি হতে পারে? পাশ্চাত্যে হাল আমলের যে লিঙ্গ বিভ্রান্তি কিংবা লিঙ্গ-দ্রোহ তার মূলে কি বৈষম্যের এই উদ্ভট ধারনাই নয়? তাদের ভাবগুরুরা কি একথা বলেনি যে মানবজাতির প্রতি সৃষ্টিকর্তার কৃত সর্বপ্রথম অপরাধ হলো লিঙ্গ বৈষম্য?
তার ওপর রয়েছে সর্বনাশা মার্ক্সবাদী সাম্যের আলাপ। শোনা মিয়ারা। এই যে তোমরা বলো, মানুষ সব সমান কিংবা আইনের চোখে সবাই সমান এটা যে সংয়ের আলাপ তা বোঝ? দুজন মানুষকে পাশাপাশি দাঁড় করাও। কিসের ভিত্তিতে তারা সমান? ওজনে? কর্মশক্তিতে? উচ্চতায়? বচনে? সৌন্দর্যে? যদি ধরে নেই পাশ্চাত্যের খয়রাত করা বিভ্রান্তিকর দর্শানাক্রান্ত হয়ে তুমি বলতে চাচ্ছো যে মানুষের মানুষ হয়ে বেঁচে থাকবার, বিকশিত হবার সুযোগ প্রাপ্তি ইত্যাদিতে সবাই সমান। এটাই বলতে চাচ্ছো? এটাযে কতটা বাস্তবতা বিবর্জিত তাও চককে আনগুল দিয়া দেখাইয়া দিতে অইবো?
যিনি সর্বজনে ঘৃণ্য ও যিনি সর্বজনে মান্য তাদের বিচার কোন্ কালে একই কায়দায় পরিচালিত হয়েছে? কোথায় তাদের উভয়কেই একই দন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে? এই যে তোমার সংবিধান রাষ্ট্রপতির নিকট বিশেষ ক্ষমার বিধান রেখেছে তা এ জন্যই যে একজন সর্বমান্য, সর্বপ্রশংসিত জন যখন ক্ষণিকের বিভ্রান্তিতে পতিত হয়ে গুরুতর অপরাধ সংঘঠন করেন, শয়তানের ফেরেবে পড়ে পাপে জড়িয়ে পড়েন তাকে কুখ্যাত-দাগী আসামীদের অনুরুপ শাস্তি দিতে বাধে। অপরাধীর শাস্তি তো হতেই হবে। তবে একই অন্যায় করেও সকল অপরাধীকে এক কাঠগড়ায় কখনোই বিচার করা হয় নাই। মানুষের বিবেক, তার কৃতজ্ঞতা বোধই তা হতে দেয় নাই।
সুতরাং এইসব ভংছং ছাড়ো। এইগুলা গোমরাহী, শেরেকী আলাপ। আর শেরেক হলো দুইমাত্র অপরাধ যা মহান আল্লাহ কখনোই ক্ষমা না করবার ঘোষনা দিয়েছেন। কারন শেরেক সকল পাপের উৎস। যখন মানুষ শেরেকে লিপ্ত হয় সে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে, প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে পাপে জড়িয়ে পড়ে। লোকমান হাকিম (Lokman The Wise) আ: এমনিতে তদীয় পুত্রকে উপদেশ দেন নাই, "ইয়া- বুনাইয়া। লা- তুশরিক বিল্লা-হ! ইন্নাশশিরকা লা জুলমুন আযীম!!"।
সুতরাং এই শেরেকীর আলাপ বাদ দিয়া ইসলামের পথে আসো। স্মরণ রাখিও এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। এই দুনিয়ার প্রতিটা মূহুর্ত, প্রতিটা বিষয় মহান রবের নিকট থেকে আগত পরীক্ষা বিশেষ। অর্থাৎ আমরা সবাই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। যিনি সুন্দর তাঁর জন্য সৌন্দর্য একটি রহমত এবং একই সাথে একটি পরীক্ষা। কারন মানুষ সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাতে জশখ্যাতি, সংসার ধর্ম করার সুবিধা হয়। একই সাথে তাতে ব্যভিচার সহ অন্যান্য খোদাদ্রোহীতায় লিপ্ত হবার সম্ভাবনা নিহিত। তদ্রুপ যিনি কুৎসিত তাঁর জন্যও এটা একই সাথে পরীক্ষা ও রহমত। কারন তা একই সাথে বিবাহ-শাদীর এবং ব্যভিচারের অন্তরায়। এভাবে যিনি শক্তিশালী তাঁর এ রহমত তাঁর জন্য পরীক্ষাও বটে। যিনি ধনী তাঁর জন্য ধন-সম্পদ রহমহ ও পরীক্ষা। যিনি দরিদ্র তাঁর জন্য দারিদ্রও রহমত ও পরীক্ষা। ক্ষণস্থায়ী এই দুনিয়ার যা কিছু বিশৃঙ্খল, যা কিছু বৈষম্যমূলক, যা কিছু অসাম্যের তার সবই মানবের পরীক্ষা ক্ষেত্র। যেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আদম সন্তানদের মধ্য হতে তাঁর প্রকৃত বান্দাহদিগকে বাছাই করে নিতে পারেন।
সুতরাং তথাকথিত দারিদ্র দুরীকরণ মোমেন বান্দার মূল লক্ষ্য বা কর্মসূচি হতে পারে না। তার মূল লক্ষ্য হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তার কর্মসূচী হলো মহান আল্লাহর হুকুম পালন। দারিদ্রের বিমোচন তার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। এ কারনেই ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে জাতি যতো আল্লাহ মুখী হয়েছে, তাঁর হুকুম বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়েছে, তাদের মধ্যে ততো বেশী জুলুম বিলোপ পেয়েছে, আদল ও এহসান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তা কখনোই রাজা আর প্রজাকে, পরিশ্রমী ও অলসকে, ধনী ও দরিদ্রকে, জোরপূর্বক সমান করার প্রচেষ্টায় অর্জিত হয় নাই।
পরিশেষে বলতে চাই, জুলাইয়ের পট-পরিবর্তন জাতির পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে পুনর্গঠনের একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। এটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত বিশেষ। এর মর্যাদা রক্ষা করতে হলে মহান রবের নির্দেশিত পন্থায়-ই এগুতে হবে। গায়রে ইসলাম দিয়ে নয়। কিংবা বাস্তবতার বিভ্রান্তিকর পাঠে নয়। অথবা মহামতি এরদোগান কিংবা বীরপুঙ্গব ইমরান খানের রাজনীতির, স্বস্তা বোঝাপড়ায় নয়।
সামনের পথ পাড়ি দিতে হবে পুলসিরাতের মতো সন্তর্পণে। আর এ পথে নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় হকদার তারাই যারা এই পথ বিগত একশ বছর ধরে পাড়ি দিয়ে চলেছেন। তারা জামায়াতে ইসলামী।