অত্রাঞ্চলে আমি-ই রাষ্ট্র্য, আমি-ই তার পতি
যে সময় সামরিকতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ – এর কিম্মুতকিমাকার সংমিশ্রণের রাজনীতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একে একে বিনাশ হচ্ছে সেই সময় এই পোড়ার দেশে সেই রাজনীতি নতুন করে যেনো প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। গাদ্দাফী, সাদ্দাম, বাশার এর মতো কুলাঙ্গারদের পরিণতি বরণ করাই যার চূড়ান্ত গন্তব্য।
মিশর ও পাকিস্তান, উপনিবেশোত্তর সোনাপট্টির এই স্বার্থান্ধ রাজনীতির সর্বশেষ দুর্গ। যদিও পাকিস্তানের বিষয়টি অনন্য। তাদের বাহিনীসমূহের এ যাবৎকৃত সমস্ত অপকর্ম স্বত্তেও সামরিক খাতে তাদের এমন কিছু অর্জন আছে যা তাদের বিরুদ্ধাচারণে মুসলিম চিন্তাশীলদেরকে দ্বিন্ধাণ্বিত করে তোলে। মুসলিম বিশ্বে তারাই একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর। তারা এভিয়েশন ও মিসাইল প্রযুক্তিতে প্রশংসনীয় সফলতা অর্জন করে কুফরী ও তাগুতি শক্তির বিরাগভাজন হয়েছে। তবে সে সকল অর্জনের শেকড় সন্ধান করলে তাতে ঘুরে ফিরে আব্দুল কাদির খানদের মতো ইসলামপন্থীদের পরিচয় মেলে।
তুরস্কের বিষয়টিও পাকিস্তানের মতো ব্যতিক্রমী ঘটনা। যদিও তার কারন ভিন্ন। যেহেতু তুরস্ক কখনোই সরারসরি উপনিবেশবাদের কবলে পড়েনি তাই তাকে আর সকলের সাথে এক করে বুঝবার চেষ্টা করাটা হবে ভ্রান্তিজনক। বাদ থাকে মিশর। যা উন্নয়ন ও দেশপ্রেমের আড়ালে সমরতন্ত্রের অপরাজনীতির এক ব্যর্থ প্রকল্পের নাম।
যে প্রকল্প জামাল আব্দেল নাসেরের নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্যের আর পাঁচটা শেখ পট্টির সহীহ বাহিনী সহকারে সপ্তাহান্তের ভেতর ইসরায়েলের কাছে মারা খেয়ে বিজয়োল্লাস করেছিলো। অথচ ইসলামপন্থী ইখওয়ানুল মুসলিমীন বা মুসলিম ভাতৃসংঘ এর গর্ভজাত হামাস একাকী গত প্রায় দেড়টা বৎসর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের জিহাদ চালিয়ে যাবার পরও ক্ষান্তি দেবার, পশ্চাদপসরণ করবার কোন লক্ষণ দেখাচ্ছে না। এই হামাস চারিদিক শত্রুভাবাপন্ন রাষ্ট্রসমূহের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েও মিসাইল প্রযুক্তি রপ্ত করেছে। অথচ মিশরের সোনাবাহিনী পুরো দেশ গিলে খাবার পরও সামরিক প্রযুক্তিতে তাদের কোন অর্জন দৃশ্যমান নয়।
বাংলাদেশের অবস্থাও তদ্রুপ। এরা ঠিকাদারীর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়, রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত খুলে বসেছে। কিন্তু সামরিক খাতে এদের অর্জন কি? যে বাহিনীর মূল দায়িত্ব ছিলো দেশের সার্বভৌমত্ব জাহির করা, বিগত এক যুগে দেশের সবচেয়ে সংকলীন সময়ে তারা বরং জনদ্রোহী কর্মকান্ডে ছিলো লিপ্ত।
যে বছর মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বললেন যে একত্তারের পর সাতক্ষীরার মুসলিম লীগের কোন এক সংসদ সদস্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে স্বাধীন করবার জন্য, যা বাতিল করে দিয়ে তিনি বলেছিলেন যেখানে মোটে পাকিস্তানকেই এক রাখা গেলো না সেখানে আবারও বিভক্তি জাতির কি কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে? - সে বছর খবর হলো যে ভারতের সেনাপ্রধানের অনুরোধে ‘৭১ পরবর্তীকালে সর্বপ্রথম বাৎসরিক সামরিক অনুশীলনে ভারতকে লক্ষ্য না করে সাতক্ষীরাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছিলো। এর চাইতে বড়ো দেশদ্রোহীতা আর কি হতে পারে?
বাংলাদেশের মতো একই কায়দায় এখন আমরা দেখছি মিশরের বাহিনী হামাসের ওপর চাপ সৃষ্টি করবার জন্য গাজ্জার সমীন্তে সৈন্য-সামন্ত-ট্যাংক প্রভতি জড়ো করছে। কথা কিন্তু সেই "উন্নয়ন” এবং "স্বাধীনতা"। যে স্বাধীনতা ও উন্নয়নের পথে হামাস ও ইসলামপন্থীরাই একমাত্র বাধা। সেই উন্নয়নের গল্প আমরা অন্য লেখায় তুলে ধরেছি। যেখান বলা হয়েছে যে মুরসীর পতনের পর তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী মহিলাকে পরবর্তীতে ময়লার ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজতে দেখা গেছে। এই সেই উন্নয়ন। এই সেই স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা ও উন্নয়ন, ভাত দে নইলে পাতাকা খাবো -এর স্বাধীনতা ও উন্নয়ন।
এখন বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও সেই একই বাকওয়াজির রাজনীতি শুরু হয়েছে। ফুলার রোডের যে বেয়াদব গুলো এতোদিন শোর তুলেছিলো যে বুইড়া ভামদের সরিয়ে তারাই দেশকে এগিয়ে নেবে এখন তারাই সোনাপট্টির মেয়াদোত্তীর্ণ, রিটার্ডেড মাল নিয়ে হাজির হয়েছে জনগণের সামনে। অথচ তাদের চোখের সামনেই জামায়াতে ইসলামীর ভেটেরান পলিটিশিয়ান অর্থাৎ পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদেরা ছিলেন। যাঁদের অনেকের রাজনীতির বয়স এই ছোকরাদের বয়সের চাইতে বেশী।
এই দীর্ঘ সময় তাঁরা একই দাবিতে অনঢ় ছিলেন। সেই দাবী মহান আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়াইয়া ধরবার দাবী। সেই রাজনীতি মহান আল্লাহর কওলকে সর্বোচ্চে আসীন করবার রাজনীতি। অর্থাৎ আদম সন্তানদের ওপর এক আল্লাহ ছাড়া আর কারও খবরদারি চলতে না দেবার রাজনীতি।
দেরীতে হলেও কওমী আলিমরা উপলব্ধি করা শুরু করেছেন যে জামায়াতের নিবন্ধন তথাকথিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাতিল করা হয় নাই। তাদের নিবন্ধন ধর্মীয় মাসলাগত ইস্যুতে বাতিল করা হয় নাই। তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে এই কারনেই যে জামায়াতের সংবিধানে মহান আল্লাহর কওলকে সর্বোচ্চে আসীন করবার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। এবং সেই কাজটি কিন্তু শুরু করেছিলো ১/১১ পরবর্তী সোনা সমর্থিত সরকারের হুদা-সাখাওয়াত কমিশন। তাদের পাপের ফিরিস্তি বর্ণনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, এই পুরানা পাপিরাই এখন নতুন দরবেশ হিসেবে হাজির হয়েছে।
জনগণের দু:সময়ে যাদেরকে পাওয়া যায় নাই, তারাই ছাত্র-জনতার রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সর্বোচ্চ সুযোগ ভোগ করতে চাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো উপনিবেশোত্তর মুসলিম বিশ্বে সোনাপট্টির এই বাকওয়াজি রাজনীতির একটা চাহিদা আছে।
বিএনপি যার প্রকৃষ্ট উদাহরন। সোনাপট্টিতে পয়দা হওয়া এই দলটি প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিবর্গ ও চিহ্নিত রাজাকারদের নিয়ে। কিন্তু তারাই এখন জামাতের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরুধীতার শোর তুলেছে। কদিন পর এরাই হাসিনার মতোই তসবীহ নিয়ে, মাথায় পট্টি বেঁধে ভোট ভিক্ষা করবে। এটাই বাকওয়াজির রাজনীতি। বিলাতী এসটাবলিশমেন্টের উত্তরসূরীদের নিকট থেকে, তাদের পত্তন করা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত হওয়া লোকদের নিকট থেকে এর চাইতে আর কি প্রত্যাশা করা যায়?
পাঠক লক্ষ্য করুন ‘৭১ এর পূর্বে ভারত ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে বাড়াবাড়ি করবার দু:সাহস করেনি। আর এখন ফারাক্কা বাদ থাকুক, "স্বাধীনতা” অর্জনের ৫৩ বৎসর পর এসে বাংলাদেশের মানুষকে তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পাটি বন্টনের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। আমরাই যদি সব করি তাহলে বাহিনী সমূহের কাজ কি? আমি বলি তাদের কাজ কি। তাদের কাজ হলো ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে পাবলিকের পয়সায় নিজেদের আখের গোছানো। এইটাই উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশসমূহের আসল বন্দোবস্ত।
তবে মানুষ সজাগ হয়ে উঠছে। মুসলমানতো বটেই উপমহাদেশের অমুসলিমেরাও উপলব্ধি করা শুরু করেছেন যে "বৈদেশী" মোগলদের শাসন কিভাবে উপমহাদেশকে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে রুপান্তরিত করেছিলো। আর তা সম্ভব হয়েছিলো মোগলদের জাতিগত, নৃ-তাত্ত্বিক উৎকর্ষতার জন্য নয়। বরং এ কারনেই যে তাঁরা শরীয়ত অনুযায়ী রাজ্য শাসন করেছিলেন। ঠিক যেমন ভাবে মৌর্যরা শাস্ত্রে দক্ষতার ভিত্তিতে ক্ষমতার নৈতিক দাবী করেছিলেন।
কিন্তু দু হাজার বৎসর পূর্বের যে শাস্ত্র তা যে যুগের অনুপোযোগী মোদির দু:শাসন তা প্রমাণ করেছে। আর তার পূর্বের কংগ্রেসের বাটপারি তো প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং অচিরেই ধর্ম নির্বেশেষে উপমহাদেশের জনগণ উপলব্ধি করবে যে খোদাভীরু একদল শাসকগোষ্ঠীর মাধ্যমেই তাদের ঈপ্সিত মুক্তি সম্ভব। আর সেই সময় যতোই দেশ্রদ্রোহী, স্বাধীনতাবিরুধী বলা হোক, যতোই রাষ্ট্র্যের হাইকোর্ট দেখানো হোক, জামায়াতে ইসলামকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে হবে,
বুরাদা- বেইদে বেনিম, দেভলেতলে বেনিম।
অর্থাৎ,
অত্রাঞ্চলে আমি-ই রাষ্ট্র্য, আমি-ই তার পতি।