শাতিমে রসুল: বাঙ্গালীর দেউলিয়াপনা

তথাকথিত ব্লগার ফারাবীর একটা ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। মানহাজি গং তাকে ছাড়িয়ে এনেছে। জুলাই'২৪ এর পর থেকেই আমরা দেখছি আওয়ামী ঘরানার দেওবন্দী, গোঁড়া, প্রতিক্রিয়শীল চরমপন্থী হুজুরদের প্রশ্রয় দেবার একটা প্রচলন শুরু হয়েছে। এ যেনো সিরিয়ার ১৯৭০-৮০ ও ২০১১-১২ এর সাম্প্রতিক ইতিহাসের-ই পুনরাবৃত্তি।

সিরিয়ার এ সময়গুলোতে অপশাসনের ভারে জর্জরিত গণমানুষের বিপ্লবের সম্ভাবনায় আতংকিত হয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চরমপন্থীদের কয়েদমুক্ত করে দেয়া হয়েছিলো। যাতে জনগণের স্বত:ফূর্ত আন্দোলন পোড় খাওয়া মুসলিম ভাতৃসংঘের নেতৃবৃন্দের হাত থেকে ফসকে গিয়ে অস্থিরচিত্তের উগ্রবাদী, অপরিণামদর্শী লোকদের হাতে চলে যায়। হিসাব-টা হলো এই যে এর ফলে আন্দোলন হয় পড়বে বিক্ষিপ্ত। আন্দোলনকারীরা পড়বে অন্তদ্বন্দের কবলে। এভাবে এক পর্যায়ে তা আত্ম-বিধ্বংসী রুপ ধারন করে বিশ্বব্যাপী তার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে। ফলত: আন্দোলন হয়ে পড়বে ব্যর্থ।

২৪'জুলাই পরবর্তী সময় থেকেই আমরা লক্ষ্য করছি ফারাবী-কে ছাড়িয়ে আনবার নানামুখী প্রচেষ্টা হয়েছে। যেকোন নির্দোষ, নিরাপরাধ ব্যক্তির দুর্ভোগ একটা জাতীয় দায়ভার। একটা নৈতিক গ্লানি। যার একটা অধিজাগতিক (meta-physical) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তো আছেই, তদুপরি পরকালে মহান আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার দায়ভারও আছে।

কিন্তু আওয়ামীপন্থী মানহাজী গং যাদের নিয়ে লম্ফ-ঝম্ফ করে তাদের ধর্ম সম্পর্কিত বিভ্রান্তি ও স্খলনের ব্যাপারে অন্তত আমার মনে কোন সন্দেহ নেই। এইটা নির্দিষ্ট ব্যক্তিসমূহের ব্যাপারে গভীর ভাবে জানার থেকে নয়। উম্মতে মোহাম্মদী এতোটা দেউলিয়া হয় নাই যে এইসব অকাটদের থেকে ইসলাম শিখতে হবে, তাদের বক্তব্য শুনতে হবে। বরং এই গোষ্ঠীটার প্রকাশ্য ও আদি চরিত্র সম্পর্কে জানার সুযোগে। পার্থক্য হলো আমাদের দৃষ্টিতে এদের স্খলন দেশীয় তথাকথিত আইনবিরুদ্ধ কর্মের দোষে নয় বরং ধর্মীয় অসার জ্ঞানের সূত্রে।

যে ফারাবী-কে ছাড়িয়ে আনবার জন্য তাকে বিকারগ্রস্থ বলেও প্রচারণা চালাবার প্রয়াস আমরা দেখেছি সেই ফারাবী অবলীলায় ও অকপটে স্বীকার করেছেন যে সামাজিক গণমাধ্যমে তিনি রসুল অবমাননাকারীকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি-ই আবার পরবর্তীতে সেই ব্যক্তিকে হত্যার দায় অস্বীকার করেছেন। এটা হচ্ছে প্রথম স্খলন ও দেউলিয়াত্ব। এর আরেকটা উদাহরণ আমরা দেখেছি মানহাজি গং এর নয়া ঈমাম জসীম উদ্দিন রাহমানীর জুলাই'২৪ পর মহুর্তে জেল থেকে অব্যহতি প্রাপ্ত হওয়ার পর প্রদানকৃত বক্তব্যে। যেখান তিনি স্পষ্ট করেই বলছেন যে তিনি "অন্যদের"-কে হত্যার জন্য উসকে দিয়েছিলেন বটে তথাপি অভিযুক্ত হত্যাকারীর সাথে তাঁর কোন সম্পর্ক নাই।

ব্যাপারটা অনেকটা "আইন" এর অধ্যাপকের ঘাদানিক কর্মকান্ডের মতো। অর্থাৎ পরের মাথায় নুন থুইয়া বরই খাওয়ার যে চিরায়ত হিন্দুয়ানী বাঙ্গালী অভ্যাস সেটা এক শ্রেনীর ব্যক্তি, এমনকি হুজুদের ইসলাম চর্চায়-ও চলে এসেছে। নবী সা: এঁর শান-মান-মর্যাদা রক্ষায় তাঁর অবমাননাকারীকে হত্যা করবে অজানা, অপরিচিত লোক কিন্তু হত্যার দায়ভার না নিয়ে এই "মহতী" কর্মের জন্য নিজেকে "তৌহিদী জনতার" সামনে মহানায়ক হিসেবে হাজির করে তার সুফল ভোগ করবে মানহাজি গং। এটা স্পষ্টত শরীয়তের স্পৃহা (spirit) বিরুদ্ধ।

দ্বিতীয় স্খলন ও দেউলিয়াত্ব টা প্রথমটার চাইতে মৌলিক ও গুরুতর (fundamental and fatal)।  আর তা হলো শাতিমে রসুল এর শাস্তি ও তা কার্যকর করা সম্পর্কিত বিভ্রান্তি। এই বিভ্রান্তির ভেতরে যে আরেক বিভ্রান্তি তা হলো একে শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে সীমাবদ্ধ করে ফেলা। এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি না করা। সে বিষয়ে পরে আসছি। ‌যদিও আমি মুফতী নই তথাপি মহান আল্লাহর কৃপায় ধর্মজ্ঞানার্জনের ব্যাপারে আমি আশৈশব উৎসাহী ও উদগ্রীব ছিলাম। সেই সূত্রে আমি এক পর্যায়ে শুধু বাংলাদেশ নয় মোটা দাগে উপমহাদেশের বর্তমান ওলামা শ্রেনীর অধিকাংশের জ্ঞানগত ও বুঝগত দেউলিয়াত্বের ধারণা অর্জন করি।

ইসলামী শরিয়তের ব্যাপারে আমি যতোটুকু অধ্যয়ন করেছি তাতে এটা সুস্পষ্ট যে ইসলামী শরিয়ত কোন পাথরে খোদাইকৃত জড় বিধানাবলীর সমষ্টি নয়। বরং এটি অত্যন্ত গতিশীল ও আধুনিক বটে! তথাপি তার এই গতিশীলতা ও আধুনিকতা তাকে গায়রে ইসলামী আইনী ব্যবস্থার মতো কালক্রমে অসংলগ্ন ও সাংঘর্ষিক করে তোলেনি। তোলেনি এ কারনেই যে তার শেকড় গভীরে প্রোথিত (rooted)। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। একটা উদাহরন দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।

যেমন ধর্মচ্যুত কিংবা মুরতাদের শাস্তি। এই শাস্তির ক্ষেত্রে গৃহবন্দী করা থেকে শুরু করে নৃশংসতম পন্থায় হত্যার উল্লেখ থাকলেও আমাদের মানসে তার কেবল নৃশংস রুপের ধরনটিই প্রতিষ্ঠা পয়েছে। এবং তা হয়েছে ধর্মীয় শ্রেনীর অজ্ঞতার সূত্রে ও সাধারণ মুসলমানের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে। একদিকে একশ্রেনীর ধর্মবেত্তারা কথায় কথায় যাকে তাকে মুরতাদ ঘোষণা দিয়ে নৃশংসতম কায়দায় তাকে হত্যার জিঘাংসায় মত্ত হয়ে সেকুলার শিক্ষায় দিক্ষীত মুসলিমদের নিকট ইসলাম-কে একটি অসহিষ্ণু ও নৃশংস ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন, অপরদিকে সেকুলার মুসলিমরা শরীয়তের এরুপ কঠোরতায় মুখর ও বিতৃষ্ণ হয়ে উঠলেও এই আধুনিক সময়েও বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহীদের সাথে অমুসলিম সেকুলার রাষ্ট্রসমূহ কি নৃশংস আচরণ করে তা সম্পর্কে বেখবর, উদাসীন, নিস্পৃহ থাকছেন।

শাতিমে রসুলের বিষয়টি সাম্প্রতিক ইতিহাসে সামনে আসে সর্বজনে ঘৃণ্য সালমান রুশদীর কর্মকান্ডে। এরপর বিগত দশকে আইসিসের উত্থানের পর তাদের দ্বারা প্যারিসের নবী অবমাননাকারীদের ওপর হামলার ঘটনায়। এছাড়রাও ইসলাম ও তাগুতি শক্তির লড়াই যতোই ঘণীভুত হচ্ছে এই সম্পর্কিত ঘটনার পুনরাবৃত্তিও ততো অধিকহারে ঘটছে।

এই বিষয়ে খৃস্টান ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত এবং পরবর্তীতে মালিকী মাযহাবে দিক্ষীত শেইখ আব্দুল কাদির আস-সূফী একটি মন্তব্য কলাম লিখেছিলেন যাতে তিনি ইসলামপন্থী আলিমগণের যেমন জগৎবিখ্যাত পন্ডিত ইউসুফ আল-কারদাভি প্রমুখদের ফতোয়ার অপোনোদন করবার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু এই প্রয়াস থেকেই এই বিষয়ে আলিমগণের মধ্যকার বিদ্যমান মতপার্থক্যের বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়। তথাপি আমি যে বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করতে চাচ্ছি তা হলো যদি আমরা শেইখ আব্দুল কাদির এঁর ফতোয়া মেনে নেই যে শাতিমে রাসুল কারীর মৃত্যদন্ড কার্যকর করা মুসলমানদের জন্য স্থান নির্বিশেষে ফরজ তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে তা সম্পাদন করা হবে কিভাবে?

শেইখ আব্দুল কাদির সেই প্রক্রিয়া সুস্পষ্টভাবে বাতলে দিয়েছেন। কিন্তু তার পূর্বশর্ত হিসেবে মুসলমানদের একটি সংঘবদ্ধ, সুসংগঠিত, নিয়মানুগ সম্প্রদায় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। সেই সূত্রে তিনি বলছেন যে, শাতিমে রসুলের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হবে। তার দোষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এরপর তাকে হত্যার জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের আমীরের পক্ষ থেকে একজন আততায়ী নিযুক্ত করা হবে। আততায়ী তার কর্ম সম্পাদনে সফল হলে আমীরের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে এর দায়ভার প্রকাশিত করা হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে এই প্রক্রিয়া তিনি বিবৃত করেছেন, সালমান রুশদীর মাথার দাম নির্ধারণ করে প্রদত্ত ইমাম খোমেনীর আলগা ফতোয়াবাজীকে অপনোদন করে। ঠিক যেমন দেশীয় মানহাজি গং এবং মুক্তিযুদ্ধ-বাঙ্গালী চেতনাধারী বুদ্ধিজীবিরা করে থাকে। এবং আমরা ধারণা করতে পারি যে আততায়ীর প্রসঙ্গ এসেছে কেবল একটি ইসলামী রাষ্ট্র্যের অনুপস্থিতির জেরে। কেননা আমরা জানি সুলতান আব্দুল হামিদ ফ্রান্সে হামলা করবার হুমকি দিয়ে সেখানে নবীজি সা: কে নিয়ে আয়োজিত ব্যঙ্গনাটকের মঞ্চায়ন থামিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু উপমাহদেশে আমরা এর ব্যতিক্রম দেখি। আল্লাহর কি কুদরত যে মাওলানা মওদূদী এঁর বিশ্বখ্যাত কিতাব রচনার সূত্রপাত হয়েছিলো শাতিমে রসুলের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ উপনিবেশবাদের শেষ সময়ে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের মতো হিন্দুত্ববাদীরা শুদ্ধি অভিযানের নামে মুসলমানদের হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রচারণা শুরু করে। এই ব্যক্তি বিভিন্ন সময়ে নবীজি সা: এঁর সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও বানোয়াট ঘটনা প্রচার করতো। এক ব্যক্তি তখন তাকে হত্যা করে পুলিশের কাছে গিয়ে তার দায়ভার স্বীকার করে।

এর জেরে পুরো ভারত জুড়ে হিন্দু রাজনৈতিক নেতারা ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধাচারনে উঠে পড়ে লাগে। করমচাঁদ গান্ধী তো মন্তব্য করে বসে যে, ইসলামের ইতিহাস থেকে রক্তের গন্ধ আসে। তখন এক সমাবেশে মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর আফসোস করে বলেন যে মুসলমানদের মধ্যে কি এমন কেউ নেই যে এইসব প্রপাগান্ডা ও মিথ্যাচারের খন্ডন করতে পারে? মহান আল্লাহর পরিকল্পনায় মাওলানা মওদূদী তখন ঐ সমাবেশে উপস্থিত। উনিশ বছরের সেই তরুনের মনে এ নিয়ে কাজ করবার বাসনা তৈরী হয়। এর তিন বছরের মাথায় প্রকাশিত হয় আল-জিহাদ ফিল ইসলাম কিংবা ইসলামে জিহাদ নামক গ্রন্থটি।

তাতে কিন্তু ঐ ব্যক্তির হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করবার মামলা-টি খারিজ হয় না। অর্থাৎ শাতিমে রসুল সম্পর্কিত অন্যায়ের প্রতিবিধান ব্যক্তি উদ্যোগে সাধিত হতে পারে কিনা সেই প্রশ্নটি। অর্থাৎ ফারাবী যদি নিজ উদ্যোগে যাচিত হয়ে হত্যাকান্ড সংঘটিত করতো তাহলেও শুধু তাকে দন্ডিত করার মধ্য দিয়েই মামলার পূর্ণ সুরহা হতো না। কারন এটা একটা চিন্তার প্রক্রিয়াগত বিভ্রান্তি। যা সে এক শ্রেনীর হুজুরদের বরাতে প্রাপ্ত হয়েছে।

আমি ব্যক্তিগতভাবে এর সাথে নিজেকে সম্পর্কিত (relate) করতে পারি কারন স্কুলে পড়াকালিন হুজুরদের দাঁড়ি সম্পর্কিত ফতোয়াবাজিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দাঁড়ি রাখবার ব্যাপারে গোঁ ধরে বসলে স্কুল প্রিন্সিপালের পক্ষ থেকে বহিষ্কারের হুমকি প্রাপ্ত হই। এখন আমার সেই কর্ম কতোটুকু ধর্মিকতা তাড়িত আর কতোটুকু বয়:সন্ধিকালের ঠেলা (juvenile delinquency) তার হিসাব হাশরের ময়দান ছাড়া সম্ভব নয়। তার প্রয়োজনও নেই। কারন মুল যে আলাপ তা হলো কোথা থেকে এবং কেনো এই মানসিক বিভ্রান্তি তৈরী হতে পারলো। কারন বড়ো হয়ে যখন খোঁজ করলাম দেখা গেলো দাঁড়ির সুনির্দিষ্ট মাপ দুরে থাকুক এমনকি দাঁড়ি রাখার ব্যাপারেও মযহাবভেদে মতপার্থক্যতো আছেই উপরন্তু খোদ হানাফী মযহাবের পন্ডিতগণের মাঝে এই নিয়ে মতভেদ বহু পুরোনো।

ঘটনার জটিলতা বুঝবেন যখন দেখবেন যে আমার কৈশরের সেই মানসিক ভ্রান্তির দায় কেবল আলেমোলামার নয়। বরং আমার সেই প্রিন্সিপালও অংকের শিক্ষক হয়ে প্রতি জুম্মায় ছায়েন্টিফিক খুৎবা দিতেন। এটা নিয়া প্রবন্ধ না লিখে পুরো কিতাব লেখা যায়। কারন আমার প্রিন্সিপালের যে ভ্রান্তি জামালুদ্দিন আফগানী থেকে নিয়ে "স্যার" সাইয়েদ আহমদ খান পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর বহু দিকপালের ভ্রান্তিও সেই একই সূত্রে গাঁথা। যদিও আমার প্রিন্সিপালেরটা পাতলা প্রকৃতির অর্থাৎ কম পড়ে বেশী বাকওয়াজির প্রবণতা আর আফগানী প্রমুখেরা বিশ্ব স্বীকৃত পন্ডিত - এই হলো পার্থক্য।

এই ভ্রান্তির সূচনা মূলত প্রকট হয়েছে মুসলিম জাতি সমূহের পড়তি কালে। কারন উঠতি কালে কেউ কোন দোষ খোঁজে না। দোষ খোঁজে পড়তি কালে। সবার প্রশ্ন কিংবা জিজ্ঞাস্য কিন্তু একটাই, কেন এভাবে ধপাস করে পড়ে গেলাম? কিন্তু উত্তর নানাপদের।

আমি তো বলি মানসিক এই বিভ্রান্তির ব্যাপকতা টের পাওয়া যায় জুলাই'২৪ এর ঘটনাবলীর সূত্রেও। আওমী মাফিয়া সরকার তার শাসনের বৈধতা তৈরী করতে গিয়ে '‌৫২ এর ভাষা আন্দোলন, '৬৯ এর গণঅভ্যত্থান, '৮০ এর দশকের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকাকে মানে নিজেদের কেরামতিকে সিনামার নায়কদের মতো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করতো। কিন্তু ছাত্ররা যখন নিপীড়নে শিকার হয়ে ঐসব বয়ানের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠলো তখন আওয়ামীরাই বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন তুললো, 'এরা কারা? কোথা থেকে এলো ওরা?'।

কিন্তু শাতিমে রসুলের রাজনৈতিক তাৎপর্যের গুরত্বটাও ফুটিয়ে তোলাটা অত্যন্ত জরুরী। যখন কাফির বিশেষত পাশ্চাত্যের দেশসমূহ মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে নবীজি সা: কে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে উদ্যত হয় তখন তারা মূলত এর বিপরীতে মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ পূর্বক মুসলমানদের জাতিগত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের শক্তিমত্তার পরিমাপ করে। এর সাথে সাথে তারা কিছু হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে। একদিকে তাদের দেশ সমূহে সমান নাগরিকত্বরে প্রলোভন দিয়ে আমদানি করা তুলনামূলক স্বস্তা শ্রমের মুসলিম জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থানকে দুর্বল করে তোলা হয় অর্থাৎ তারা যে প্রকৃত অর্থে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেনীর নাগরিক সেটা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, অপরদিকে চরমপন্থী, উগ্রবাদী অমুসলিমদের সমর্থনও আদায় করা হয়।

সেই বিবেচনায় মানহাজি গংদের ছাড়া পাওয়াটা বিশেষত আমেরিকান নাগরিকত্ব প্রাপ্ত যে দেশী অভিশপ্ত কুলাঙ্গারটা রসুলের অবমাননা করেছে তার হত্যা মামলার আসামীদের ছাড় পওয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ নাই। এটার একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য-ও বিদ্যমান। অর্থাৎ এর ফলে আওয়ামী-ভারতীয় পক্ষ তাদের আমেরিকান আব্বুদের কাছে এই বলে প্রচারণা চালাবে যে জুলাই'২৪ পরবর্তীতে মূলত ইসলামপন্থী জামাত-শিবির-লাদেনপন্থীদের উত্থান ঘটেছে। যদি দেখা যায় যে সেই পক্ষটি-ই মানহাজিদের কাছে গিয়ে তাদেরকে জামাত বিরোধী করে তুলছে এই বলে যে দেখো জামাত আমেরিকা আব্বুর ভয়ে এরকরম নিরপরাধ লোকদের ছাড়িয়ে আনার কথা বলেনি - তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই।

কয়েকদিন পূর্বে যুক্তরাষ্ট্র্য প্রবাসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেনের আয়োজিত অনলাইন আলাপচারিতায় একটা বিষয় উঠে এসেছে যে এই সরকার অর্থাৎ একদিকে সেনাপ্রধান ওয়াকার অপরদিকে সরকারী অন্যান্য মন্ত্রনালয় যেমন আইন মন্ত্রনালয় প্রভৃতি এর কর্তা বক্তিরা বিডিআর বিদ্রোহ উত্তর মেজর জিয়ার বিদ্রোহাত্মক কর্মকান্ডকে সন্ত্রাসবাদী বলে ফাঁসিয়ে দেবার মামলা নিয়ে আমেরিকা আব্বুর ভয়ে কিছু করার সাহস করছেন না।

সে প্রসঙ্গে রাষ্ট্রীয় কর্মের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কিছু ব্যক্তিবর্গও বলেছেন যে আমেরিকা বা কোন দেশ কি মনে করবে তাতে বাংলাদেশের কিছু আসে যায় না। তাই নাকি? এটা একটা সাধারন মানুষ বললে এড়িয়ে যাওয়া যেতো। প্রকাশ্য দিবালোকে গাযযার গণহত্যার পর, আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কুফরী শক্তিসমূহের হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করার পরও যে মুসলমানদের একাংশ কুফরী ও তাগুতি শক্তির অপরাধ সংঘটনের পৈশাচিক সক্ষমতার ব্যাপারে উদাসীন এটাই মুসলমানদের জাতীয় প্রতিরক্ষার বড়ো দুর্বলতা।

এর মানে এই নয় যে শাতিম রসুল করে তাগুতি ও কুফরী শক্তি পার পেয়ে যাবে। যে নিরাপরাধ ব্যক্তি বর্গের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকারকে খর্ব করতে হবে। বরং এর মানে হলো এই সব বিষয় মোকাবেলা করবার জন্য আমাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে আরও সক্ষম ও মোক্ষম হয়ে উঠতে হবে। এর উদাহরন হলো শাতিমে রসুল কারীর অন্যায়ের কার্যকর জবাব। এটা হতে পারে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার বরাতে ব্যক্তি বিশেষের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, এমনকি তার থেকে দেশে অবস্থিত আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তদের আইনি প্রক্রিয়ায় মোকাবেলার মাধ্যমে, এটা হতে পারে পরাশক্তি সমূহের নিরাপত্তা জনিত আশংকাকে বিবেচনায় নিয়েও সেই আশংকায় বলি হওয়া নিরাপরাধ ব্যক্তিবর্গের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সুনিশ্চিতকরনের মাধ্যমে।

যদিও প্রবন্ধের আলোচনা মূলত ইসলামী জ্ঞানের দৈন্যতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত তথাপি তা কেবল ধর্মীয় গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। বরং পূর্বে যেমন বলেছিলাম:

এখানে মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত হলেও তা অর্ধসত্য। পূর্ণ সত্যটা হলো এখানকার বুদ্ধিজীবিদের দৌড় সেকুলাঙ্গারি পর্যন্ত। আর চরম সত্যটা হলো বাঙ্গালী জাতে দৈন্য।

Popular posts from this blog

ইসলাম ও গণতন্ত্র

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

জুলাই কাহা-নি