মুরসি বনাম এরদোগান

বর্তমানে ইসলামপন্থীদের মাঝে "এরদোগানীয়" রাজনীতির একটা প্রবল গ্রহণযোগ্যতা আছে। যদিও "এরদোগানীয়" রাজনীতি বলতে একেকজন একেক জিনিস বোঝেন। আমার কাছে মনে হয়েছে যে শুধু বাংলাদেশে নয় বরং মোটাদাগে উম্মতে মোহাম্মদীর মধ্যে "এরদোগানীয়" রাজনীতির স্পষ্ট কোন ধারণা বিদ্যমান নেই। তবে যে বিষয়ে ঐক্যমত্য আছে তাহলো আধুনিক তুরস্কের রুপায়নে এরদোগানের সফলতা। ধরে নেয়া যায় যে, "এরদোগানীয়" রাজনীতি বলতে অধিকাংশ লোকই সফল হবার রাজনীতি বোঝেন।

আবার অনেকের মধ্যে এই বিষয়ে বিপদজনক বিভ্রান্তি-ও বিদ্যমান। তাদের দৃষ্টিতে "এরদোগানীয়" রাজনীতির অর্থ হলো পল্টিবাজির রাজনীতি। কিংবা ধর্ম তোষণের মাধ্যমে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের রাজনীতি। অথচ একটু খোঁজ খবর করলেই এ জাতীয় রাজনীতির অসারতা ও অক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খোদ বাংলাদেশে-ই স্বৈরাচার লুইচ্চা সেনাপ্রধানেরা পল্টিবাজির রাজনীতি করে ধিকৃত হয়েছেন। অনেকে নির্বাচনী মৌসুমে তসবীহ জপে, মাথায় পট্টি বেঁধে জনগণ-কে ধোঁকা দিতে সক্ষম হলেও পরবর্তীতে জনরোষের ভয়েই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

এরদোগানের সফলতার বিপরীতে উম্মতে মোহাম্মদীর মানসে আরেকটি গৎবাঁধা ধারণা হলো মুরসির "ব্যর্থতা"। ক্ষমতা গ্রহণের এক বছরের মাথায় ক্ষমতা হারানোর কারন হিসেবে নানা মুনির নানা মত বিদ্যমান। তবে সেই সব মত ছাপিয়ে বিশেষত ইসলামপন্থী ঘরানার লোকদের পক্ষ থেকে যেসব কার্যকারন এক যুগ আগেও উল্লেখ করা হতো তার কোনাটাই আমার বিচারবুদ্ধিতে যুতসই মনে হতে না। এজন্য আমার বরাবরই ইচ্ছা ছিলো যে মহান আল্লাহ সুযোগ দিলে এই বিষয়ে জানবার চেষ্টা করবো।

এই প্রেক্ষিতে সিরিয়া, মিশর, ও তুরস্কের ওপর আমার স্বল্প গবেষণায় বেশ কয়েকটি মূল বিষয় প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে চেষ্টা করবো পৃথক প্রবন্ধ রচনা করবার। যেমন একটি বিষয় হলো ইসলামী মানস। যে মানস একজন মুসলমানের অন্তর্দৃষ্টি-কে করে তোলে প্রখর। যার ফলে সে অনেক বিষয়ে বিস্তারিত, গভীর বা প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন না করেও তার স্বরুপ উপলব্ধি করতে পারে। বাদশাহ আরঙ্গজেব আলমগীরের বিতর্কিত কর্মকান্ড সমূহের বিস্তারিত জ্ঞান লাভ করবার পূর্বেই সেই সম্পর্কে আমার যে বিচারবোধ ছিলো, বোঝাপড়া ছিলো, অড্রি ট্রাশকির কিতাব তাকে কেবল প্রতিষ্ঠিত করেছে মাত্র। এই যে চিন্তার সাযুজ্য যা স্থান তো বটেই কালের-ও উর্ধ্বে এটাই ইসলামী মানস। এই মানস সূত্রে ইসলামপন্থীরা একে অপরকে বুঝতে ও জানতে পারে পরস্পরের মধ্য কোন রকম যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ছাড়াই। এই মানস সূত্রে-ই মাওলানা মওদূদী রঃ ও ইমাম বান্না রহ: এঁর কর্মপদ্ধতি ও চিন্তাধারার ঐক্যতান সংঘটিত হয়েছে পরস্পরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনরুপ যোগাযোগ বা ভাবের আদান-প্রদান ছাড়াই।

এরকম আরেকটি বিষয় যা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক অনেক কাজ করা প্রয়োজন তা হলো, বিশ্বব্যাপী ইসলামপন্থীদের মাঝে পরিলক্ষিত সাধারণ বৈশিষ্ট্য সমূহ এবং ইসলামপন্থার পথপরিক্রমার অভিন্ন পরিণতি লাভ। অর্থাৎ আমার কৈশরে যে সীমিত পরিসরে জামাত-শিবির এর নেতা-কর্মীদের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়া হয়েছিলো, তার মাধ্যমে আমি তাদের মধ্যে যেসব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছি, পরবর্তীতে দেখা গেলো সিরিয়া ও মিশরের ইসলামপন্থীদের মধ্যেও একই ধরনের চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছে। একই ভাবে আঞ্চলিক প্রভাব বলয় তৈরী হয়েছে। একই ভাবে তরুন জনগোষ্ঠী ও পোড় খাওয়া প্রাজ্ঞ প্রবীণদের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিতে টানা পোড়েন তৈরী হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর সাথে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী সমূহের সম্পর্কের যে পীড়ন (tension/dynamics) আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, ঠিক একই রকমের পীড়ন মুসলিম ভ্রাতৃসংঘের সাথে মিশর ও সিরিয়াতে-ও দেখা গিয়েছে।

এই অপ্রাসঙ্গিক স্বল্প চক্করের (small detour) এর মাধ্যমে এই বিষয় গুলোর ওপর একটা ছক (sketch) এঁকে রাখলাম। যদি সম্ভব হয় তবে এর ওপর আরও বিস্তারিত আলাপ করবো। এখন মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই।

মিশরের ঘটনাবলীর অধ্যয়ন মুরসি সম্পর্কে আমার ধারণাবলিকে প্রতিপাদিত করেছে কেবল। এবং তাঁর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সমূহ-কে করেছে দুর্বল। এতদ দর্শনে-ই আমি তুরস্ক ও এরদোগান সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী হয়ে উঠি। কারন আমার ধারণা ছিলো ঠিক যেসব বিষয়-কে মুরসির ত্রুটি বলে উল্লেখ করা হয় সেসব রাজনৈতিক বিভ্রম (political blunder) থেকে এরদোগান-ও মুক্ত ছিলেনা। এ ধরনের কিছু বিষয় তো আমরা নগদে প্রত্যক্ষ করেছি। নিজ দেশের জনরোষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সিরিয়ার উদ্বাস্তুতদের পক্ষাবলম্বন তার একটি।

তবে তার পরও কথা থাকে। হিসাব থাকে। এরদোগান পারলেন, মুরসি পারলেন না কেন? এই প্রশ্নের একটা পূর্ণ চিত্র আমি এখনও প্রতিষ্ঠিত করতে পারি নাই। তবে আমার বিবেচনায় মনে হয়েছে মুরসির "ব্যর্থতার" ক্ষেত্রে তাঁর দায়ভার যতোটা না বেশী তার চেয়ে বেশী তাঁর পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি। তাছাড়া মিশর ও তুরস্কের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এক নয়।

তবে এসব বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে মুসলমানদের দোষারোপ কিংবা দায়মুক্তির প্রান্তিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একদিকে সব অপকর্মের জন্যই কেষ্টা বেটাকে অভিযুক্ত করা অন্যদিকে সফল ব্যক্তিদের স্খলনের পক্ষে সাফাই গেয়ে তেলা মাথায় তেল দেবার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসাটাই কল্যাণকর।

সুতরাং আমরা মুরসি ও ভ্রাতৃসংঘের ওপর দায় চাপানোর নিমিত্তে তাঁদের কর্মকান্ড সমূহের চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্রত হবো না। বরং তাঁদের কর্মপদ্ধতি ব্যতিরেকে আর কি কি পথ অনুসরণ করা যেতে পারতো এবং তা করা হলে সম্ভাব্য কি কি পরিণতি হতে পারতো তার একটা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন-ই আমাদের লক্ষ্য। বিশেষত আমার স্পষ্ট মনে আছে, মিশরের সেই উত্তাল দিন গুলোতে তুরস্ক থেকে বেশ কয়েকবারই মিশরের ভ্রাতৃসংঘকে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে কোন এক ধরনের সমঝোতায় যাবার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছিলো। তুরস্ক যেহেতু নিজ দেশে সফল তাই তাঁদের উপদেশের একটা ভারত্ব (weight) আছে। তথাপি আমরা দেখার চেষ্টা করবো যে আদৌ তেমন পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিলো কিনা। আদৌ তা সম্ভব ছিলো কিনা।

সিরিয়া, মিশর, ও তুরস্কের ঘটনাবলীর তুলনামূলক অধ্যয়নে ইসলামপন্থীদের উত্থানের পথে কয়েকটি মূল প্রতিবন্ধকতার উপস্থিতির বিষয়টি পরিষ্কার হয়। এক হলো উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্র ও তার মানস কাঠামো দুই হলো বামাতি চিন্তাধারার সর্বগ্রাসী ও সর্বনাশী প্রভাব ও কর্মকান্ড।

এক্ষেত্রে উপনিবেশোত্তর রাষ্ট্র কাঠামোর একটি হলো মানসিক দিক অপরটি হলো উপনিবেশবাদের ছত্র ছায়ায় উত্থিত হওয়া শ্রেনী বিশেষ। এই শ্রেনী মিশর ও সিরিয়ায় প্রায় একই বামবাদী রুপ পরিগ্রহ করলেও তুরস্ক ছিলো তার ব্যতিক্রম। ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার প্রাণপন লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থাকায় বলশেভিক বিপ্লবের উন্মত্ততা তাকে সেভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। ঠিক এ কারনেই মিশর ও সিরিয়ার মতো সেখানে সামরিক পুঁজিতন্ত্র-ও জেঁকে বসতে পারেনি বলেই মনে হয়েছে। এ বিষয় আরও বিস্তারিত অধ্যয়নের প্রয়োজন।

একটা বিষয় লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন আর তা হলো সমরতন্ত্রের ফলে শ্রেনী বিশেষের উত্থান ঘটা আর সামরিক-পুঁজিতন্ত্র এক বিষয় নয়। সামরিক-পুঁজিতন্ত্র তখনই তৈরী হয় যখন সমরতন্ত্র রাষ্ট্র্যের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। তুরস্কের যে অভিজাত শ্রেনীর বিরুদ্ধে এরদোগান সেই আশির দশক থেকেই জনমত সংগঠিত করে আসছেন তাদের কামাল পাশা পন্থী সমরতান্ত্রিক অংশটি কিন্তু উপনিবেশবাদের জন্ম নয়। বরং তা উসমানীয় সাম্রাজ্যের-ই ধারাবাহিকতা। সেকারনে ঐ শ্রেণীটির স্খলন ছিলো সাময়িক। তাদের ক্ষেত্রে মানসিক ও পদ্ধতিগত ত্রুটির চাইতে পরিবেশ-পরিস্থিতি গত বিভ্রাট-ই ছিলো প্রধান নিয়ামক।

পক্ষান্তরে মিশরে ও সিরিয়ার সমরতান্ত্রিক অংশটি ছিলো উপনিবেশবাদের অবৈধজাত। মানসিক ও পদ্ধতিগত ত্রুটি-ই ছিলো তাদের প্রধান সমস্যা। এ কারনে মুসলমান হয়েও উপনিবেশবাদী মানস ও কূটকৌশল তারা শুধু রপ্ত-ই করেনি বরং তার প্রয়োগ ঘটিয়েছিলো স্বজাতির বিরুদ্ধে। আর এর পেছনে প্রধান নিয়ামক ছিলো বৈদেশী উপনিবেশবাদিদের নিকট থেকে স্বজাতি বিদ্বেষের মানসকে ধারণ করা।

এ কারনে মুসলমান হয়েও ইসলাম বিদ্বেষী রাষ্ট্র্য পরিচালনার রীতিতেই তারা অটল থেকেছে। বিশেষ করে বামাতি চিন্তার একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো সম্পদ বন্টণের আইন সংক্রান্ত নিপীড়ন। এটা আমরা আফগানিস্তানে দেখেছি। সিরিয়া সহ অন্যত্র-ও দেখেছি। প্রতিটি জায়গায় সম্পদের সুষম বন্টনের নাম করে সুস্পষ্ট ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধাচারণের প্রচেষ্টা ও প্রক্রিয়া দেখা গিয়েছে। দিন শেষে তা সম্পদশালী শ্রেনীর পুনর্গঠনের (reshuffling) প্রক্রিয়াতে-ই পর্যবসিত হয়েছে।

আফগানিস্তানে মুসলিম পরিবারের যে কুলাঙ্গারগুলো স্টালিনের লেওড়া চোষার মধ্যেই নিজের জীবনের চূড়ান্ত সফলতা খুঁজে পেতে চাচ্ছিলো, সম্পদের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় মুসলিম সম্পত্তি আইনের লঙ্ঘণের বিরুদ্ধে যখন পুরো আফগানি জাতি ফুঁসে উঠলো, বিক্ষোভে ফেটে পড়লো, তার ফলশ্রুতিতে দিন শেষে আফগান জাত কমরেডগণ রাশিয়ান জাত কমরেড দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়েছিলো। অর্থাৎ যে "বিপ্লব"-এর সূচনা হয়েছিলো শ্রেণী বৈষম্য দুর করতে দেখা গেলো তা-ই জাতি বিদ্বেষের হাতিয়ার হয়ে উঠলো।

উপনিবেশবাদী মানসের আরেকটি লক্ষ্যণ হলো ঐতিহ্যবাহী ভাবে মুসলিম সাম্রাজ্য কাঠামোর যে স্বত:সিদ্ধ ও অন্তর্নিহিত নীতিমালা (underlying principles) ছিলো, আধুনিকতার নাম করে সেই সব নীতিমালা বিরুদ্ধ নীতি গ্রহণ করা। এর একটা হলো সংবিধানতন্ত্র। তথাকথিত স্বাধীন বিচার বিভাগের আলাপ-ও উঠেছে এই সংবিধানতন্ত্রের সূত্রে-ই।

এর যে সবকিছু উপনিবেশবাদীদের গভীর ষঢ়যন্ত্রের ফল তা কিন্তু নয়। বরং এটা তাদের বিভ্রান্তিসমূহের-ও আত্মস্থকরণের ফসল। এই বিভ্রান্তির একটা লক্ষণ আমরা দেখি রথবার্ডের কিতাবে। অর্থাৎ ১৯৩০-৪০ এর দশকে পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র্যবিজ্ঞানীগণ বিড়ালের গলায় ঘন্টা ঝুলানো সম্পর্কিত ত্যানা প্যাঁচানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

ধরেন রাজা কিংবা রাষ্ট্র্য প্রধান স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারেন। এই ভয়ে তাঁর ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করা হলো। তখণ রাজার কার্য সম্পাদনের ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন উঠলো। অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন হইলো যে আপনি একজনকে কাজ করতে বলছেন কিন্তু কাজ করতে দিচ্ছেন না। আবার বলা হইলো রাষ্ট্র্য প্রধানসহ, সরকার ও রাষ্ট্র্যর কর্তাব্যক্তিদের কার্যক্রম সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হবে। তখন প্রশ্ন উঠলো যদি সংবিধানের ব্যাখ্যায় সরকার ও বিরোধীদল একমত না হতে পারে, তখন কি হবে? ওয়েল, তার জন্য আবার বিচার বিভাগ-কে টেনে আনা হলো। তখন প্রশ্ন উঠলো বিচার বিভাগ যে নিজ স্বার্থ রক্ষায় সরকারের পক্ষেই রায় দেবে না তার নিশ্চয়তা কি? কিংবা এর ফলে জনসমর্থিত একটা সরকারের উপরে একটা অনির্বাচিত গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে কিনা? তার ফলে যে সেই গোষ্ঠীটি-ই স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে না তার-ই বা নিশ্চয়তা কি?

পাঠক এইসব বুদ্ধিবৃত্তিয় সমস্যা গুলো পাশ্চাত্যের জন্য কখনই অস্তিত্ব বিনাশী হয়ে ওঠে নাই কেননা তাদের মধ্যকার সমস্ত বিভাজন থাকা স্বত্তেরও কিছু মৌলিক বিষয়ে তারা এক জাতীয়। কিন্তু এই মানস, এই প্রক্রিয়া, এই কাঠামোগুলোই যখন উপনিবেশোত্তর মুসলিম দেশ সমূহে আমদানি করা হলো তখন তা বিদ্যমান বিভাজনকে উসকে দিয়েছে কেবল।

আর ঠিক এই বিভাজনের সূত্রেই উপনিবেশবাদী পক্ষশক্তি মুসলিম জাতি রাষ্ট্র্য সমূহকে বারংবার নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে দেখা যায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই ইসলামপন্থীদের ভোট দেয়। কিন্তু ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায়নে উপনিবেশবাদের তোষক শ্রেনী-টি আতংকিত হয়ে ওঠে। কেননা তখন তাদের জনশোষণের রাষ্ট্র্যকল্প ভেস্তে যাবে। তখন-ই তৈরী হয় দ্বন্দ ও সংঘাত।

মিশরে মোবারক বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতেই সে দেশের Supreme Council of the Armed Forces একে নস্যাত করতে চেয়েছে। যদিওবা ক্ষেত্র বিশেষে আন্দোলন-কে তারা সমর্থন করে থাকে তা করেছিলো গোষ্ঠীগত স্বার্থে। অর্থাৎ মোবারক ও তার পরে তার সন্তানের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার বিষয়টা সামরিক-পুঁজিতন্ত্রের সুবিধাভোগী শ্রেনীটির পছন্দ ছিলোনা। তাদের কথা হইলো মোবারক তো অনেক খাইছে এবার আমাগোরে এট্টু খাওয়া সুযোগ দেওন যায় না? প্রসিডেন্ট মুরসী তাদের ঠিক এই দুর্বলতা-কে পুঁজি করেই মোবারক আমলের সুবিধাভোগীদের বিতাড়িত করেন নবাগত সিসি ও তার সমার্থক গোষ্ঠাটির দ্বারা। এবং সামরিক বিষয়ে তার সরকারের হস্তক্ষেপ না করার নীতি-ও গ্রহণ করেন। অর্থাৎ এরদোগানের মতোই তিনি-ও সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলবার নীতি-ই গ্রহণ করেন।

কিন্তু সামরিক-পুঁজিতন্ত্র-ই মুরসির একমাত্র প্রতিবন্ধক ছিলো না। বামাতি নৈরাজ্যবাদী ও ধর্মীয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠীও তাকে কম ভোগায় নাই। বাংলাদেশে অরাজনৈতিক হেফাজত যেমন রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণে সুযোগ-কে হাতছাড়া করতে কখনোই পিছপা হয় না, তদ্রুপ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই রাজনীতি বিরুদ্ধ সালাফি গোষ্ঠী-টি দেখা গেলো চান্সে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে গেলো। এবং একটা দীর্ঘ সময় ধরে সমরতন্ত্রের দ্বারা রাজনীতি বিশেষত ইসলামপন্থী রাজনীতির পীড়নের ফলে জনগণের মধ্যে যে রাজনীতি বিমুখতার প্রসার ঘটলো তাতে সালাফি অরাজনৈতিক চিন্তাধারা জনপ্রিয়তা পেয়ে গেলো। এ কারনে নির্বাচনের সময়ও দেখা গেলো একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট তারা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলো।

কিন্তু রাজনীতি টংয়ের দোকান নয় যে মন চাইলে খুলবেন আর উদাস ভাব হলে বন্ধ করে রাখবেন। রাজনীতি একটি দীর্ঘ মেয়াদী প্রক্রিয়া। একটি সুদীর্ঘ পথচলা। এর অভাবে হঠাৎ রাজনীতিতে আসার ফলে দেখা গেলো সংকটজনক সময়ে বাংলাদেশের তথাকথিত ইসলামী ঐক্যজোটের মতো-ই সালাফী পার্টিতে-ও ভাঙ্গন ধরে গেলো। এই সংকট কিন্তু সালাফিরা তৈরী করেনি। বরং ধর্মীয় বিষয় সমূহে তারা-ই ছিলো ভ্রাতৃসংঘের সবচেয়ে কট্টর সমর্থক। সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঘাঁটি। কিন্তু অনভিজ্ঞতার দরুন রাজনীতিতে এসে তারা গোল খেয়ে গেলো।

এই সংকট মূলত তৈরী হয়েছিলো বামাতি ও জাতিয়তাবদীদের দ্বারা। অর্থাৎ বাংলাদেশের বিএনির সাথে মিশরের ওয়াফদ পার্টির অনেক বিষয়েই সাজুয্য বিদ্যমান। তাদের উভয়ের জন্ম সেনাপট্টিতে। তারা উভয়েই নিজ নিজ দেশের তথাকথিত স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলো। বস্তুত বাংলাদেশের মতো মিশরেও সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে প্রায় ডজন খানেক রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি হয়েছিলো। এর মধ্যে ভোটের মাঠে কেবল ওয়াফদ এর অবস্থান ছিলো উল্লেখ করবার মতো। বাদ বাকী গুলো আমাদের দেশীয় কিংস পার্টি কিংবা রাম-বাম নেতা সর্বস্ব পার্টিগুোর মতোই।

এই সব কিছু ছাপিয়ে মিশরের যে মূল সংকট তার সাথে সিরিয়া এমনকি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থারও একটা আশ্চর্যজনক মিল আছে। ঘটনা হইলো ভোট হলেই দেখা যায় পাবলিক ইসলামপন্থীদের ভোট দেয়। কিন্তু তার বিপরীতে রাজনৈতিক বিভিন্ন হিসাব নিকাশের বরাতে ইসলামপন্থীরা কখনোই নিজস্ব দলীয় লোকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হারে নিযুক্ত করে না। বরং দলের বাহির থেকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেনী, পেশা, এমনকি অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে লোক নিযুক্ত করে তারা একটা তথাকথিত "অন্তর্ভক্তিমূলক" (inclusive) ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করে।

কিন্তু বিশেষত বামাতিদের তাতেও মন ভরে না। তাদের কথা হলো পাবলিকে ইসলামপন্থীদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। এরপর ইসলামপন্থীরা বামাতিদের নেতা মেনে তাদের কথামতো রাষ্ট্র্য চালাবে। এই হলো তাদের রাষ্ট্র্যকল্প!

কথা হলো এই রকম এক পেশে দাবী-দাওয়া করেও তারা টিকে থাকতে পারলো কিভাবে? ওয়েল আওয়ামী লীগ যেমন লগি-বৈঠা ও গণহত্যার পরও পুনর্বাসিত হবার সুযোগ পাচ্ছে স্রেফ ভারতের সেবাদাস ও দেশীয় রাজনৈতিক স্বার্থান্ধ ও অপদার্থদের কারনে। ঠিক তেমনই। এটা উপনিবেশবাদী রাষ্ট্র্য কাঠামো, স্বার্থান্ধ জাতিয়তাবাদী রাজনৈতিক মানস, রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ধর্মীয় শ্রেনীর বিভ্রান্তি, সামরিক-পুঁজিতন্ত্র, ও উপনিবেশবাদীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদ - এই সমস্ত অপশক্তির সম্মিলিত ইসলামপন্থী বিদ্বেষী মানসের ক্ষমতা ও প্রভাব এর ফসল।

প্রেসিডেন্ট মুরসি নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও বিপ্লব রক্ষা করবার ব্যাপারে যে বারংবার তাঁর সমর্থকদের এবং বৃহত্তর পরিসরে দেশবাসী-কে আশ্বস্ত করছিলেন তার গুরুত্ব এই প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি করা যায়। অর্থাৎ জনগনের সংখ্যা গরিষ্ঠ অংশটির চাওয়া ছিলো ইসলামপন্থীরা-ই দেশ চালাক। আর সংখ্যা লঘিষ্ঠ অংশটি ছিলো তার ঘোর বিরোধী। এই দুইয়ের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে মুরসি আশ্বস্ত করছিলেন যে তিনি আর যা-ই করুন তাঁর ওপর ওর্পিত দায়িত্বের বরখেলাপ করবেন না। বিপ্লব নষ্ট হয় এমন কিছু তাঁর দ্বারা হবে না।

কিন্তু ভোটার দুরে থাক, তাঁর দলীয় নেতা-কর্মীরাও তাঁর ওপর রুষ্ট ছিলো তাঁর "অন্তর্ভক্তিমূলক" (inclusive) নীতির ব্যাপারে। তাদের কথা ছিলো পাবলিকে ভোট দিসে ভ্রাতৃসংঘ-কে দেশ চালানোর জন্য। তারাই দেশ চালাবে। যদি ভালোভাবে চালাতে না পারে, পরের নির্বাচনে মানুষে তাদের ভোট দেবে না। হিসাব সহজ। কিন্তু তা না করে যদি দলের লোক ছাড়া অন্য লোকদের ক্ষমতায়ন করা হয় তখন নিজস্ব কর্মকান্ডের দায়ভারের হিসাব হয়ে পড়বে জটিল। মানে যদি দলীয় লোকদের দায়িত্ব দেয়ার পরও তারা ব্যর্থ হতো তখন না হয় বোঝা যেতো যে এরা অযোগ্য। কিন্তু এখন নানা পদের লোক জড়ো করে কে কি উদ্দেশ্যে কি করছে, কার কি দায়ভার তার হিসাব তো জট পাকিয়ে গেলো। মানে দাঁড়ালো যে এখন দলের বাইরের লোকের ভুলের দায়ভারও এসে পড়বে দলের ওপর। আর এটাই-তো বিরোধী পক্ষের চাওয়া।

বিরোধী পক্ষের এই অসদাচরণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন এই "অন্তর্ভক্তিমূলক" (inclusive) নীতিতে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে সরকার গঠনের প্রচেষ্টার পরও বিরোধীদের পক্ষ থেকে ভ্রাতৃসংঘের ওপর স্বৈরাচারীতা ও দলান্ধতার অভিযোগ আনা হলো। বলা হলো যে ভ্রাতৃসংঘ তাদের দলের বাইরে থেকেও যাদের নিয়োগ দিয়েছে তারাও গুপ্ত শিবির। কেনো? কেনো মানে? দেখেন না? এরাও পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। দাঁড়ি রাখে। ইসলামের কথা বলে!

এই হলো অবস্থা। পাঠক আপনারা নিশ্চই ইতিমধ্যে এর সাথে দেশীয় পরিস্থিতির মিল খুঁজে পাচ্ছেন। কিন্তু এই একই অবস্থা সিরিয়া ও তুরস্কেও দেখা গেছে। হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর সিরিয়ার নিপীড়িত জনমনে যখন নতুন করে আশা দাঁনা বাঁধলো যে হাফিজের পোলা বাশার বাপের মতো এতোটা খারাপ হবে না। মানে হাফিজ আশির দশকে হামা-তে যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছে অন্তত বাশার এতোটা খারাপ হবে না। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা এই যে সাপের পেটে সাপ-ই হয়।

তথাপি ২০০২-০৩ সালের ঐ যুগসন্ধিক্ষণে ভ্রাতৃসংঘের সাথে সরকারের একটা বোঝাপড়ার ক্ষেত্র তৈরী হচ্ছিলো। মানে সিরিয়ার জনগনের সাথে সরকারে দুরত্ব ঘোঁচাবার একটা পরিবেশ তৈরী হচ্ছিলো। সেই সময়ও মূল যে কয়েকটি শক্তির কারনে ঐ সব রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ভেস্তে যায় তাহলো ঘুরেফিরে সেই বামাতি, সেই জাতিয়তাবাদী, সেই অরাজনৈতিক ধর্মীয় গোষ্ঠী। এবং তাদের প্রতিবন্ধকতা তৈরীর ধরন-ও ছিলো একই। ভ্রাতৃসংঘ সিরিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হওয়া স্বত্তেও ঐ সময়ে গঠিত সমস্ত কমিটিতে মিশরের মুরসি সরকারের মতোই তাদের প্রতিনিধিত্বের হার ছিলো অর্ধেকেরও কম। তথাপি বাকিদের প্রতিও ভ্রাতৃসংঘের প্রভাব বলয়াধীনে থাকবার অভিযোগ তোলা হলো। অথচ জাতিয়াবাদীদের নিদেনপক্ষে একটা জনসমর্থনের ভিত্তি থাকলেও বামাতিদের কখনোই কোন জনভিত্তি ছিলো না।

কথা হলো এই সংকটের সমাধান কি? এরদোগানের ওপর যতোবার স্বৈরাচারীতার অভিযোগ এসেছে, ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে থাকবার অভিযোগ এসেছে উনি ততোবার-ই নির্বাচন দিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক সময় নির্বাচন এগিয়েও এনেছিলেন। এবং পাশ্চাত্যের পোঁদপাকা নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মুখে ছাই দিয়ে প্রতিবারই সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসেছিলেন।

আমার মতে এক্ষেত্রে পার্থক্য হলো মিশরের মতো তুরষ্কে সামরিক-পুঁজিতন্ত্র গড়ে না ওঠায় একদিকে যেমন সামরিক বাহিনী সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি অপরদিকে নির্বাচন পরবর্তী যেকোন ধরনের বিশৃঙ্খলায় তারা নির্বাচিত সরকারের সহযোগী হিসেবেই কাজ করেছে। মূল খেলাটা এখানেই।

এ কারনেই আমরা দেখি যে মুরসির বিরুদ্ধে, ইখওয়ানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারীতার অভিযোগের সমাধান তিনিও নির্বাচনের মধ্যে-ই খুঁজতে চেষ্টা করতেন। সমস্যা হয়েছিলো যে নির্বাচনে ঘুরেফিরে যখন তাঁর ও তাঁর দলের শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হতো তখন বামাতিরা আরও তীব্র ও নৈরাজ্যবাদী হয়ে তাদের বিরোধীতায় নেমে পড়তো। আর এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছিলো মিশরের সামরিক-পুঁজিতন্ত্র।

অথচ বামাতি ও জাতিয়তাবাদীরা যদি দায়িত্বশীল রাজনীতির চর্চা করতো, সুষ্ঠু নির্বাচন মুখী, গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করতো তাহলে সামরিক-পুঁজিতন্ত্রের পক্ষেও নির্বাচিত সরকারের বিরোধীতা করা দুরুহ হয়ে পড়তো। বিশেষত ওবামার আমলে যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পক্ষে অন্তত বাহ্যিকভাবে হলেও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো যাবৎ ভ্রাতৃসংঘ সরাসরি ইসরায়েলের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি স্বরুপ কোন পদক্ষেপ না নেয়। কিন্তু যখন দেখা গেলো মুরসি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তাঁর ক্ষমতা আরোহণের পরপরই ইসরায়েল ও গাযযার হামাসের সাথে বেঁধে যাওয়া সংঘর্ষকে মোকাবেলা করেছেন তখন তাঁর রাজনৈতিক ধীমত্তার ব্যাপারেও তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের আস্থা তৈরী হয়েছিলো। যেই প্রেক্ষাপটে মিশরের সামরিক-পুঁজিতন্ত্র ঘুটু করবার চেষ্টা করেও সুবিধা করে উঠতে পারতো না।

ঘুরেফিরে এই টানাপোড়েন যখন একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থা (deadlock) তৈরী করলো তখন এক পর্যায়ে বামাতিদের কিছু অযৌক্তিক দাবীও মুরসি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মেনে নিতে রাজী ছিলেন। কিন্তু তখন দেখা গেলো বামাতিরা অনৈতিক দাবী করে বসলো। মুরসি যদি তা মেনে নিতেন তখন এই বামাতিরাই তাঁর প্রতি বিপ্লব ও  জনসমর্থনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবার অভিযোগ আনতো।

ঘুরে ফিরে ঘটনা চলে গেলো সংবিধানতন্ত্রের কূটচালে। আইনি খুঁটিনাটি ও মারপ্যাঁচ দিয়ে তাঁর সরকারকে কার্যত অক্ষম করে ফেলা হলো। এবং শেষ পর্যন্ত যখন পরোক্ষ মার্কিন মদদে বামাতি ও বিরোধীপক্ষীয়রা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে তাঁর পদত্যাগের দাবীতে অনড় অবস্থানে বসে গেলো তখন সিসির পক্ষ থেকে মুরসি-কে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সরে যাবার অথবা মিলিটারী ক্যূ এর শিকার হবার আল্টিমেটাম দেয়া হলো।

এটা-ই ছিলো বিপ্লবের সাথে সবচেয়ে বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা। কারন মুরসি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতেন তবে ঘুরেফিরে রাজনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য নির্বাচন ও ব্যালট বাক্সেই ফেরত যাওয়া ছাড়া অন্য কোন গণতান্ত্রিক উপায় ছিলো কি? আর যদি নির্বাচনে-ই ফেরত যাওয়া হয় তখনও তো ভ্রাতৃষংঘ-ই সংখ্যাধিক্যের ভোটে জিতে আসতো। তখন যে বিরোধী পক্ষের অযৌক্তিক, অনৈতিক দাবীদাওয়ার দুষ্টচক্র আবারও শুরু হতো না তার নিশ্চয়তা কি?

আর এটা উপলব্ধি করেই প্রেসিডেন্ট মুরসী সিনা টান করে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি নিজের জীবন দিয়ে বিপ্লব-কে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে মূল দায়ভার মিশরের সামরিক-পুঁজিতন্ত্রের। তাদের উচিত ছিলো বিপ্লব পরবর্তী জনরায়ের ওপর শ্রদ্ধা রেখে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের আদেশ সমূহ শিরোধার্য করে পালন করা। সামরিক-পুঁজিতন্ত্র ছাড়াও আরবের দুটি দেশের ন্যাক্কার জনক ভূমিকাও মিশরের এই করুণ পরিণতির জন্য বিশেষত দায়ী। সে বিষয় না হয় আরেক দিন আলাপ করা যাবে।

শেষ কথা হলো হিসেবে কুরুলুস ওসমানের সে-ই উক্তির উদ্ধৃতি দেয়া যায়, যার সরল বাংলা অনুবাদ হলো এই যে, সংগ্রাম বান্দার আর বিজয় আল্লাহর। এটাই প্রকৃত সত্য। জয়-পরাজয় মহান আল্লাহর ইচ্ছাধীন। বান্দাহ কেবল চেষ্টা করতে পারে মাত্র। আমরা আমাদের অতীত কর্মকান্ড থেকে শিক্ষা নেবার চেষ্টা করতে পারি এবং তা করা উচিত-ও কিন্তু এমনটা ভাবা উচিত নয় যে বান্দাহ তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক।

Popular posts from this blog

জুলাই কাহা-নি

অত্রাঞ্চলে আমি-ই রাষ্ট্র্য, আমি-ই তার পতি

The Case for Rohingyas