শেখ মাখতুম সূত্রে

শেখ মাখতুমের ওপর বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত "তথ্যচিত্র"-টি আমি দেখিনি। গু-ঘাঁটাবার অভ্যাস নাই বলে আমি ঠিক প্রকৃত অর্থে একজন বাংলা হয়ে উঠতে পারিনি। তাছাড়া গাযযার গণহত্যার প্রেক্ষাপটে বিবিসির মিথাচ্যার ও অপসাংবাদিকতা চর্চার বিষয়টি দিবোলোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ফলত: তাদের নির্মিত এসব "তথ্যচিত্র" প্রকাশ পেলে আমরা তখন এর পেছনে বিবিসির ধান্ধা নিয়ে চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়ি।

তবে এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেলো বহু বছর আগে শেখ মাখতুমের একটি সাক্ষাৎকার। তাও খুব সম্ভবত বিবিসি এরই। সেখানে তিনি তাঁর শৈশবের স্মৃতিচারণ করেছিলেন। পিতার সাথে যখন লন্ডনে যেতেন তখন বিলাতীদের নির্মিত সভ্যতা তাঁকে মুগ্ধ করতো। তাদের সাজানো গোছানো রাস্তাঘাট, সুউচ্চ দালান, উন্নত মানের প্রকৌশল ও প্রযুক্তির ব্যবহার তাঁর শৈশব মনে এতো গভীর ছাপ ফেলেছিলো যদ্দরুন আধুনিক আরব আমিরাতের সভ্যতা নির্মাণেও এর ছাপ সুস্পষ্ট।

যতোদুর মনে পড়ে তিনি আরব আমিরাত-কে মানব সভ্যতার সর্বাগ্রে দেখবার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। এ কারনেই মহাশূন্যে অভিযান থেকে শুরু করে সর্বাধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে আরব আমিরাতের সভ্যতা ও আত্ম-পরিচয় বিনির্মাণের একটা প্রবণতা দেখা যায়।

এই বিষয়টাকেও আপনি শেখ হামজা ইউসুফের বর্ণিত হেরোডিয়ানিজমের আলোকে বুঝবার প্রয়াস চালাতে পারেন। অর্থাৎ বিজিত জাতি যখন বিজয়ী জাতির প্রতি পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে তখন সে বিজয়ী জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি অনুকরণের মাধ্যমে তাদের পর্যায়ে নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে প্রাণান্ত হয়। সমস্যা হলো নকল জিনিস কখনো মূল জিনিসের মর্যাদা লাভ করে না।

দেড়শো দুশো বছর আগেও মরুচারী, উষ্ট্রারোহী, মেষপালক আরবদের এই বিস্ময়কর উত্থানে অনেকেই শেষ জমানায় লম্বা-উঁচু ঘাড় ওয়ালা রাখালদের উত্থান ও সুউচ্চ অট্টালিকা নির্মাণে তাদের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়া সম্পর্কিত হাদীসের সত্যতা খুঁজে পান। যদিও আমি নিশ্চিত যে একে আরবীরা তাদের উত্থানে অনারবদের হিংসুটে মানসিকতার প্রকাশ হিসেবে-ই দেখে থাকে। কথা হলো ধর্ম তো আর হাই আইকিউ অপদার্থদের লিটমাস টেস্ট নয় যে বর্ণ পরিবর্তনের সহায়তায় প্রতিটি বিষয়ের সত্যাসত্য নির্ধারিত হবে।

তবে এও সত্য যে শুধু আরবীরা কেনো এমনকি চৈনিকেরাও যতো চটকদার সভ্যতার বিনির্মাণ-ই করুক না কেনো তার মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। সেই একই প্রশ্ন কিন্তু ইসলামের উত্থানে আরবে যে নবযুগের সূচনা হয়েছিলো তাকে কেন্দ্র করে উত্থিত হয়নি। কারন সেটা বাস্তবিকই ছিলো স্বত:স্ফূর্ত। তার ছিলো নিজস্ব চিন্তাধারা। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। সে গ্রীক, রোমীয়, এমনকি চীনা দর্শন ও জ্ঞান শাস্ত্র সমূহকে গ্রহণ করেছিলো বটে কিন্তু তাকে সে এমনভাবে আত্মস্থ করেছে যার ফলে সে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা-উপশাখার জন্ম দিতে পেরেছে। এবং তার সবকিছুতেই ইসলাম ছিলো একেবারে কেন্দ্রে। ইসলামই তাকে তাড়িত করেছে এমন মহা কর্মযজ্ঞে ব্যাপৃত হতে।

সেই তুলনায় আরবের বর্তমান চটকদার সভ্যতা ঠুনকোই ঠেকে। সে পরজীবির মতো। যতোদিন পাশ্চাত্য টিকে থাকবে স্রেফ ততোদিনই তার অবিকল নকল এই সভ্যতাও টিকে থাকবে। এরপর সে হয়ে পড়বে দিশেহারা। কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

এই সম্পর্কিত আলোচনায় শেইখ ওমর ফারুক আবদ-আল্লাহর একটি কথা আমার বেশ মনে ধরেছে। তিনি বলেছেন হাদীস শাস্ত্রে নজদের ব্যাপারে যে উন্নাসিকতা প্রদর্শন করা হয়েছে তাতে নজদের লোকদের হীনতার পরিবর্তে সরলতা এবং নজদ-কে অভিশপ্ত এলাকা হিসেবে সাব্যস্ত করার বদলে তাতে ভবিতব্য ঘটনা সমূহের ভয়াবহতার প্রতি ঈঙ্গিত করা হয়েছে।

তিনি বলছেন নজদের লোকেরা মানুষ হিসেবে সরল প্রকৃতির। হাদীস শাস্ত্রে যার প্রমাণ মেলে। এমন একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে এক মরুচারী আরব নবীজি সা: এঁর কাছে এসে শুধোলো যে সে যেহেতু অতো জটিল কথাবার্তা বোঝে না তাই তাকে যেনো সহজ ভাবে ইসলাম বুঝিয়ে দেয়া হয়। নবীজি সা: তখন ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভ তাকে শিখিয়ে দিলেন। তখন সে উত্তর দিলো যে সে এর এক চুল পরিমাণ কম কিংবা বেশী করবে না। এই বলে সে আপন মনে ফিরে চললো। তখন নবীজি সা: তার প্রতি ঈঙ্গিত করে সাহাবী রা: গণকে বললেন, তোমরা কি একজন জান্নাতি ব্যক্তি দেখতে চাও? তবে এই ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করো।

এ কারনে শেইখ ওমর বলছেন, যে নজদীরা সরল হওয়ায় তারা রাষ্ট্র্য পরিচালনার উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে বর্তমানের মতো সংবেদনশীল সময়ে তো নয়ই। অর্থাৎ নজদীরা মানুষ ভালো কিন্তু রাষ্ট্র্য ও রাজনীতির অনুপোযুক্ত।
 

শেইখ ওমর এঁর এই অনুকল্প (Hypothesis) সত্য বলেই মনে হয়। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাবের যে ধর্মীয় সংস্কারবাদী আন্দোলন তা মুসলিম উম্মতের মধ্যে নতুন তো কিছু নয়। বরং এ ধরনের সংস্কারবাদী আন্দোলন যুগে যুগে উম্মতের মধ্যে আবির্ভূত হবার ভবিষ্যত বাণী তো খোদ হাদীস শরিফেই উল্লেখ আছে। সমস্যা হলো নজদী আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারের পথে যে পরিমাণ রক্তপাত ও বিভাজন তৈরী করেছে তার দেখা মেলে কেবল শিয়াদের মধ্যে। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে এতো সাদৃশ্যের পরও তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটা প্রায় সাপে-নেউলে পর্যায়ের। কি আশ্চর্য!

তবে শেখ মাখতুমের শৈশবের স্মৃতিচারণ ও তাঁর মনোবাসনা আমার মধ্যে মানসের প্রজন্মগত পার্থক্যের (generational gap) বিষয়টি প্রতিভাত করেছে। আমরা যারা শহুরে কংক্রীটের জঞ্জালে বড়ো হয়েছি তারা যেভাবে গ্রাম্য নৈসর্গিকতায় কাতর হই, রোমাঞ্চিত হই, তা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে দেখা যায় না। কারন গ্রাম্য জীবন তাঁদের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার অংশ। কোন কল্পনা বিলাস নয়। যখন আমরা ধান ক্ষেতের মাঝে সাপের মতো এঁকেবেকে যাওয়া গ্রাম্য রাস্তার কল্পনায় কাতর হই, তখন বর্ষাকালে সেই রাস্তা দিয়ে চলাচল করবার কষ্টসাধ্য স্মৃতি তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। যেখানে আমরা পাখির কল-কাকলি নিয়ে সাহিত্য রচনা করি সেখানে গ্রাম্য জীবনের কাউয়া-কোকিল-চড়ুই-ব্যাঙ-ঘাস ফড়িং এর সমস্বরে কর্কশ হাঁকডাকের কান ঝালাপালা করে দেয়ার অত্যাচার থেকে নিস্কৃতি পাবার সুযোগে তারা ধন্য বোধ করেন।

কিন্তু জীবনের কোলাহল থেকে, জীবন সমস্যা থেকে আসলেই কি নিস্কৃতি মেলে? নাকি সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে যাপিত জীবনের সমস্যারও উত্তোরণ ঘটে? পূর্বে কর্দমাক্ত-পিচ্ছিল রাস্তায় চলবার সংকট পীচ ঢালা উত্তপ্ত রাস্তায় ফোঁসকা পড়া দিয়ে প্রতিস্থাপিত হয় মাত্র। প্রাণীর ডাক যান্ত্রিক শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয় কেবল।

সমস্যার এই আধুনিকায়নের চক্র ঠেকাতেই বোধকরি পাশ্চাত্যে প্রকৌশল ও প্রকৃতির মেলবন্ধনের একটা প্রচেষ্টা দানা বাঁধছে। ঘুরেফিরে ঘটনা কিন্তু বিশ্বাসে গিয়েই ঠেকছে। রেনেসাঁ উত্তর বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় মুগ্ধ হয়ে এর ওপরেই অনেকে ঈমান এনেছিলেন। হাইজিনস (Christiaan Huygens) তো ঘোষনাই দিয়েছিলেন যে বিজ্ঞান-ই তার ধর্ম! কিন্তু বিজ্ঞান তো ধর্ম হতে পারে না। পারে নাই।

যেসব মৌলিক স্তম্ভের ভিত্তিতে ধর্মের গোড়াপত্তন হয়, বিজ্ঞানের গোড়াপত্তন হয়েছিলো তার প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। খোদাদ্রোহীতা-ই ছিলো এর মূল প্রেরণা। মানবতাবাদের মূল দাবী-ই হলো যে মানুষই মহাবিশ্বের কেন্দ্র। মানুষের উর্ধ্বজাগতিক এমন কোন স্বত্তা নাই যা তার নিয়ন্ত্রক। বরং মানুষই মানুষের নিয়ন্ত্রক। মানুষ চেষ্টা করলেই পারে তার ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রক হতে। এ কারনেই বিজ্ঞানবাদীদের মধ্যে প্রকৃতি-কে নিয়ন্ত্রণ করবার এক অসম্ভব তাড়না দেখা যায়। নিৎসের বর্ণনার মতো সে মৃত ঈশ্বরের শূন্যস্থান পূরনে নিজেই ঈশ্বর হয়ে উঠতে চেয়েছিলো। সে যে ফেল মেরেছে তাতো বলাই বাহুল্য। একের পর এক বিজ্ঞানের আবিষ্কার আদম সন্তানের মধ্যে যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মগরিমা তৈরী করেছিলো, জাগতিক জ্ঞানের সুবিশালতার ভারে জর্জতির হয়ে তাতে এখন অনেক খানি-ই ভাটা পড়েছে। এখন আর সে প্রকৃতি-কে "শাসন" করতে চায় না। বরং প্রকৃতির মর্জি বুঝে চলবার মধ্যেই তার দীর্ঘস্থায়ী কল্যাণ বলে মনে করা শুরু করেছে।

এ যেনো বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এক অনন্ত পেন্ডুলাম। এক সীমাহীন দোলাচল। নবুয়্যতের সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানে এক সময় সে প্রকৃতিকে মনে হয় যেনো জয় করে নিচ্ছিলো। তাতেও এক সময় ভাটা পড়লো। বিধাতা মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এরপর আদম সন্তান বিধাতার স্তরে উন্নীত হতে চাইলো। বিজ্ঞানের সহায়তায় এক কোয়ান্টাম লাফে সে উচ্চতর শক্তি বলয়ে উন্নীত হলো। কিন্তু সেই জোশ-ও বেশীদিন থাকলো না। বাধ্য হয়েই তাকে তার পূর্বের কক্ষপথে ফিরতে হয়েছে।

বোধকরি এই অনন্ত দোলাচলে, এই সীমাহীন ঘূর্ণিপাকের এক চূড়ান্ত পর্যায়ে মানুষের জানবার, প্রচেষ্টা চালাবার আর কিছু বাকী থাকবে না। এই ক্ষণস্থায়ী জগৎ তার গুঢ় রহস্য সহ আদম সন্তানের নিকট ধরা দেবে। ধর্মজ্ঞান হবে পুরোপুরি বিলুপ্ত। মানব কর্মযজ্ঞ তাকে উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে উত্তীর্ণ করবে। সংঘটিত হবে মহাপ্রলয়।

সেদিন শেখ মাখতুমের বিষয়ে যে আমাকে-আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হবে না এটা তো নিশ্চিত?

Popular posts from this blog

ইসলাম ও গণতন্ত্র

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

জুলাই কাহা-নি