প্রেসিডেন্ট এরদোগানের তারুণ্য ভাবনা

 (তুরস্কের চতুর্থ যুব সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যের কিয়দংশের ভিত্তিতে রচিত ভাবানুবাদ)

 

প্রিয় সুধী,

আজকের এই তারুণ্যের সমাবেশে আমি কিছু মনখোলা আলাপচারিতা করতে চাই।

আপনারা জানেন গতকাল ইস্তাম্বুল বিজয়ের ৫৭২-তম বার্ষিকী উৎযাপিত হয়েছে। আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছি সেই বীর সেনানিদের এবং ইস্তাম্বুল বিজয়ী একুশ বছর বয়সী সুলতান মেহমেদ-কে যিনি একটি নবযুগের সূচনা করেছিলেন। সুলতান মেহমেদ আমাদেরকে শুধুমাত্র ইস্তাম্বুল রক্ষারই দায়ভার দিয়ে যান নাই বরং এই বিজয়ের স্পৃহাকে লালন করবার দায়িত্বও দিয়ে গিয়েছেন।

আমাদের পূর্বপুরুষদের নিকট থেকে আমরা শিখেছি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিপীড়িতের পাশে দাঁড়াতে। আমরা শিখেছি জালিমের বিরুদ্ধে সিনা টান করে দাঁড়াতে। আমরা শিখেছি কঠিন দু:সময়ে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে। আমরা এমন ধর্মীয় প্রত্যয়ে দৃপ্ত এবং আত্মোৎসর্গকৃত যাকে কোন কিছু দিয়েই আটকানো যায় না। আমরা শিখেছি কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে জালিমের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখতে।

তথাপি আমাদের লড়াই কেবল মোড়লিপনা, অনধিকারচর্চা, এবং স্বেচ্ছাচারি মানসিকতার বিরুদ্ধেই ছিলোনা। বিগত পঞ্চাশ বৎসরেরও অধিক সময় যাবৎ আমরা সংগ্রাম করেছি বিদ্বেষ এবং চেতনাবাজির বিরুদ্ধেও। আমলাতান্ত্রিক দুষ্টচক্র সমূহের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই ছিলো যতোটা না ক্ষিপ্র, তার চাইতে আরও কঠিন যুদ্ধ আমাদের করতে হয়েছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে।

প্রিয় ভাই ও বোনেরা,

বামবাদী কেমালিস্ট (CHP) মানসিকতা আমাদের গৌরবাণ্বিত অতীত-কে ধারণ করবার বিপরীতে তাকে করেছে পরিত্যাজ্য। তারা আমাদের ইতিহাসকে বিগত একশ বছরের ভেতরেই সীমিত করে ফেলেছে। আমাদের শেখানো হয়েছে অতীত ভুলে যেতে। আমাদের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ-কে কার্যত করা হয়েছে বিস্মৃত।

একদলীয় ফ্যাসিবাদী দু:শাসনকালে আমাদের জাতিকে ভুল নীতিতে পরিচালিত করা হয়েছিলো। জাতীয় আত্মবিস্মৃতিই ছিলো যার উদ্দেশ্য। এর পরিণতি আজও আমাদের বহন করতে হচ্ছে। আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধকে সমাজ জীবন থেকে মুছে ফেলা হয়েছিলো। এমন গ্লানিকর পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের যেতে হয়েছে যখন আরবী বর্ণমালা ছিলো নিষিদ্ধ। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সেই সব দিন যখন কুরআনের দরস বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো। আঠারো বছর ধরে আমাদের মিনারগুলো থেকে এমন আজান ভেসে আসতো যা আমাদের নিকট ছিলো অপরিচিত।

আমাদেরকে আমাদের আধ্যাত্মিক শেকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করতে তারা হেন কোন প্রচেষ্টা বাদ রাখে নাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই অপকর্মে তারা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। আমরা এখনও কেমালিস্টদের দেখি সেলজুক, উসমানীয় এবং তৎসংশ্লিষ্ট হাজার বছরের ঐতিহ্যের প্রতি বিরুপ মনোভাবাপন্ন। সুলতান আল্প আর্সলান, ওসমান গাজী, বিজেতা সুলতান মেহমেদ, সুলতান প্রথম সেলিম, মহানুভব সুলাইমান, এবং সুলতান আব্দুল হামিদ খান প্রমুখদের নাম শুনলে এই সব লোকজন অস্বস্তিতে পড়ে যায়।

মনে রাখবেন, এরা তারাই যারা দীর্ঘদিন যাবৎ আমাদেরকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলো কারন আমরা বলেছিলাম, "তুর্কি জাতির রুপায়ন হয়েছে ইসলামের সূত্রে" এবং "একজন তুর্কী ইসলাম ব্যতীত অস্তিত্ববিহীন"। তারা নির্মমভাবে আমাদের সমালোচনায় মুখর ছিলো কারন আমরা চেয়েছি আমাদের অতীতকে আঁকড়ে ধরতে, শেকড়ে প্রোথিত হতে, এবং আমাদের জাতির প্রতিষ্ঠাকালীন মূল্যবোধ সমূহকে ধারণ করতে।

যদি তারা ইতিহাসে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতো তবে উপলব্ধি করতো যে আধুনিক তুর্কি রাষ্ট্র বিগত ৬০০'শ বছরের বাদশাহী সাম্রাজ্যের এক নতুন প্ররোহ মাত্র। চেতনাবাজি বাদ দিয়ে যদি তারা ইতিহাসের পাতাগুলো ওল্টাতো তবে লক্ষ্য করতো যে:

- শতাব্দীকাল যাবৎ আমাদেরকে ন্যায়বিচারের সমার্থক বলেই গন্য করা হয়েছে।
- শতাব্দীকাল যাবৎ আমরাই ছিলাম আভিজাত্যের মূর্তরুপ।
- মহান আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা বিশ্বব্যাপী উৎকর্ষ সাধন করেছি, মাধুর্য ছড়িয়েছি, বিবেকবোধ জাগ্রত করেছি, অনুকম্পা প্রদর্শন করেছি।
- আমাদের জ্ঞানগরিমা, ন্যায়নীতি, সভ্যতা, সংস্কৃতির মাধ্যমে বিশ্বের একটি বড়ো অংশের রুপায়ন, উজ্জীবন, এবং সমৃদ্ধি ঘটেছে।

এই কথাগুলো অনেকের কাছে তিক্ত শোনালেও আমরা সত্যিকার অর্থেই তেমন একটি জাতি-ই ছিলাম।

এই জমকালো ইতিহাসের অভিজ্ঞতা কালের সঞ্চয়নে আমাদের জাতীয় মানসপটে, সত্ত্বায়, এবং ধমনীতে প্রবাহিত।

হে তরুণ সমাবেশ!

শেকড়হীন বৃক্ষ যেমন বাঁচে না, তেমনি যে সমাজ তার শেকড়ের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে সেও বেশীদিন টিকতে পারে না। আধুনিক বিশ্ব প্রযুক্তির আবহে যখন ভারসাম্য হারাচ্ছে, তখন টিকে থাকার জন্য আমাদেরকে আরো শক্ত করে আমাদের শেকড় আঁকড়ে ধরতে হবে। যারা আমাদেরকে আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে বিস্মৃত করতে চায় তাদেরকে আমরা নজরে রাখবো। আমার প্রত্যাশা যে তোমাদের প্রত্যেকেই ইতিহাসের পরম্পরায় প্রাপ্ত এই অতুলনীয় ঐতিহ্যকে বহন করে সামনে এগিয়ে যাবে। তোমরা কখনোই তাদের ফাঁদে পা দেবে না যারা তোমাদের সাহস, প্রত্যাশা, এবং সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করতে চায়। তাদের দিকে কর্ণপাত কোরো না যারা বলে, "তোমরা পারবে না; তোমরা ব্যর্থ হবে"।

আমার প্রিয় তরুণ ভাই ও বোনেরা!

বর্তমানে যদিও আমরা দু:খ-দুর্দশার সম্মুখীন, তথাপি খোদা চাহে তো আমাদের জন্য রয়েছে অনন্ত জীবনের হাতছানি। মনে রাখিও, এই দুনিয়ায় কেবল একজন পর্যটক হিসেবেই আমাদের আগমন ঘটে নাই বরং এই সরাইখানার রক্ষণাবেক্ষণের দায়ও আমাদের। আগন্তুক-অতিথিদের সেবা করাই আমাদের কাজ। আমাদের জন্ম এখানে, বেড়ে ওঠা এখানে, জীবন-যাপনও এখানেই।

এমনও লোক ছিলো যারা পত্রিকার শিরোনাম দিয়ে আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে চেয়েছিলো। তারাও ছিলো যারা আমাদেরকে বিশ্বমানচিত্রে আমাদের অবস্থান চিনিয়ে দিতে চেয়েছিলো। এছাড়াও ছিলো তারা যারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের ভরসায় আমাদের চরিত্রহনন করেছে, আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে, এবং আমাদেরকে শাসাবার দু:সাহস দেখিয়েছে।

আজ তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাদের চিরাচরিত স্বভাবানুযায়ী একবারের জন্যও পেছনে ফিরে না তাকিয়ে তারা পালিয়ে গেছে। তাদের বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য চুকাতে হয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে গ্লানিকর শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের মধ্যে দিয়ে।

কিন্তু আমরা স্বদেশেই। আল-হামদুলিল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত। এবং মহান আল্লাহর নির্দেশ আশা পর্যন্ত এখানেই আমরা কায়েম থাকবো। এই দেশ আমাদের জন্মভূমি। যার প্রতিটি ইঞ্চি মাটি এক অদম্য স্পৃহায় পরিপূর্ণ।

বিভাজনের রাজনীতির ইতি ঘটেছে। আমাদের ঐক্যে কারও নোংরা হাতের ছোবল ফাটল ধরাতে পারবে না। ইনশাল্লাহ আমরা আমাদের দেশে এমন পরিবেশের সূচনা করবো যা বিভাজন-বিসংবাদ মুক্ত। যেখানে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত।

আমি এই সংগ্রামে আপনাদের অবিচল সমর্থন প্রত্যাশী।

মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।

Popular posts from this blog

অত্রাঞ্চলে আমি-ই রাষ্ট্র্য, আমি-ই তার পতি

জুলাই কাহা-নি

The Case for Rohingyas