শাতিমে রসুলের রাজনৈতিক তাৎপর্য
যেহেতু বাংলাদেশের মানুষকে সবকিছু চুকে আনগুল দিয়ে দেকিয়ে দিতে হয়, সেহেতু আমি নিশ্চিত যে পূর্বের প্রবন্ধে শাতিমে রসুলের রাজনৈতিক তাৎপর্যের ব্যাপারে স্বল্প কথায় তাৎপর্যপূর্ণ যে আলাপ তুলেছিলাম তা এই দেশের মানুষ বিশেষত বুদ্ধিবেচি মহল অন্তরঙ্গম করতে ব্যর্থ হয়েছে।
শাতিমে রসুলের রাজনৈতিক তাৎপর্যের মূল সূত্র এই বুঝ ক্ষমতা যে এই লড়াই-টা রসুলে সীমাবদ্ধ নয়। তার মূল লক্ষ্য বস্তুও রসুল সা: নন। অর্থাৎ মদ প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতা চর্চার নামে যদি মুসলমানদের আরাধ্য বিষয় সমূহের অবমাননা করতে দেয়া হয় তখন কেবল প্রতিরক্ষার সীমা-কে (defense line) পিছিয়ে আনা হয় মাত্র।
অর্থাৎ অবমাননার এই আক্রমণাত্মক কৌশল শুধুমাত্র রসুল সা: কিংবা ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং তা সম্প্রসারিত হয়ে মানবের আরাধ্য যে কোন বিষয় যা তাকে রক্ষণাত্মক (protective) হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে তার সমস্ত বিষয় সমূহকেই অবমাননার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে থাকবে যতোক্ষণ পর্যন্ত না সে ঐ সমস্ত বিষয় সমূহে রক্ষণাত্মক হয়ে উঠবার সাহস ও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যেই মূহুর্তে এই বিষয়টি ঘটে সেই মুহুর্তে তার সর্বাত্মক পরাজয় ঘটে। সে পরিপূর্ণ রুপে অন্যের বশীভূত হয়ে পড়ে। দাসত্ব গ্রহণ করে। তখন নুতন কিংবা আধুনিক শিক্ষার নামে তার মানস জগতে নতুন নতুন এমন সব বিষয় সমূহের ব্যাপারে আরাধনার ধারণা তৈরী করা হয় যেই সব বিষয় সমূহ প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তাকে অনাদিকাল দাসত্বের জিঞ্জিরে বন্দী করে রাখবে।
বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চই উপলব্ধি করেছেন যে এই লড়াইয়ে মুসলমানদের মুল শত্রু অমুসলিমরা নয়। বরং এই অনাদি-অনন্ত লড়াইয়ের দুই পক্ষের একটি হলো আদম সন্তান ও অপরটি হলো বিতাড়িত ও মরদুদ ইবলীশ।
যেহেতু আদমের কারনেই আমি বিতাড়িত সেহেতু তাকে সরলপথচ্যতু করতে আমি ওঁৎ পেতে থাকবো। তার সম্মুখে কি পশ্চাতে, ডানে কি বামে, আমি আপতিত হতে থাকবো যাবৎ আপনি তাদের অকৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হতে দেখেন। --- আল কুরআন, সূরা আল 'আরাফ, আয়াত ১৭।।
কাফেরদের সাথে কিংবা গায়রে ইসলামের সাথে মুসলমানদের যে লড়াই, যে সংগ্রাম, যে জিহাদ তা-ও ইবলীশের সূত্রে প্রোথিত। অর্থাৎ গায়রে ইসলামের অনুসারীগণ নিজেদের জ্ঞাতে কিংবা অজ্ঞাতে ইবলীশের ফাঁদে পড়ে যায়। ইবলীশের দেখানো পথ সমূহ-কে তারা ঐশী পাথেয় হিসেবে গণ্য করা শুরু করে। কারন একদিকে কালের বিবর্তনে তাদের নিকট প্রেরিত ঐশী বিধান সমূহ বিকৃত ও সেকেলে হয়ে পড়েছে। অপরিদকে নবী মুহাম্মাদ মুস্তাফা সা: এঁর সূত্রে প্রাপ্ত নব্য ও সর্বশেষ কালোত্তীর্ণ ঐশী পাথেয় আল-ফুরকানকে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় সত্যাসত্য নির্ণয়ে তাদের নিজেদের মনগড়া মানদন্ড বারংবার তাদেরকে বিভ্রান্ত করছে।
বর্তমান গায়রে ইসলামের "সভ্যতা" সমূহের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এর সর্বত্র ইবলীশ শয়তানের হাতের ছাপ (fingerprint) সুস্পষ্ট হয়। প্রথমে তাদেরকে ইসলামে বীতশ্রদ্ধ করে খৃস্টবাদে মদমত্ত থাকবার ওয়াসওয়াসা দেয়া হলো। কিন্তু বিবর্তিত, বিকৃত, ও সেকেলে এই ধর্মের অনুপোগীতায় সেই ধর্মের প্রতি-ও তারা আস্থা হারিয়ে ফেললো। এরপর এলো বৈজ্ঞানিক ধর্মবাদ। যার ফলশ্রুতিতে খোদাকে সরিয়ে মানুষ নিজেই তার আসনে বসে পড়লো। বিগত কয়েক শতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত আবিষ্কার ও উন্নতির সূত্রে যতো মানুষ নিপীড়িত ও নিহত হয়েছে তার পূর্বের সমস্ত কালেও আদম সন্তানের এতো ক্ষয়ক্ষতি হয় নাই।
নিৎশে তাঁর কিতাবে পাগলের চরিত্র-কে দিয়ে যখন বলিয়েছিলেন যে,
ঈশ্বর মৃত। আমরাই তাঁকে হত্যা করেছি। তাঁর রক্ত বিধৌত আমাদের এই করতল ক্ষালনের এখন কি উপায়?
নিৎশের অন্তর্দৃষ্টির প্রখরতা (prophetic insight) আমাকে একদিকে যেমন তাঁর প্রতি অনুরক্ত করে তুলেছিলো, অপরদিকে তাঁর আজীবন গোমরাহী আমাকে করে তুলেছে ঈমানের সহিত সফলভাবে মৃত্যুবরণ করবার ব্যাপারে সংশয়যুক্ত। হেদায়াত যে প্রকৃত অর্থে বান্দার প্রতি মহান আল্লাহর দান বিশেষ তার গুঢ়ার্থ-ই আমার উপলব্ধ হয়েছে। কেননা এক সময় আমার ধারণা ছিলো মানুষের এবাদত, বুদ্ধিমত্তা-ই তার হেদায়াত প্রাপ্তির কার্যকারণ বিশেষ। কিন্তু যদি তা-ই হতো তবে নিৎশের মতো প্রখর বুদ্ধিমত্তার ব্যক্তিগণ কুফরের এইরুপ ভয়াবহ বিভ্রান্তি-তে সারাজীবন অতিবাহিত করতে পারতেন না।
যদিও অপ্রাসঙ্গিক তথাপি এতোটুকু বলা প্রয়োজন মনে করছি যে হেদায়াত মানে এই নয় যে মানুষ তার জীবনের গভীর সব প্রশ্ন সমূহের মোক্ষম উত্তর লাভ করেছে। সে লিটমাস টেস্টে বর্ণ পরিবর্তনের মতো ঈশ্বর ও বিশ্বাসগত সমস্ত অদেখা বিষয় সমূহের অস্তিত্ব চাক্ষুস্মান হয়েছে। বরং হেদায়াত হলো সেই মানসিক অবস্থা যাতে ঈশ্বর ও অদেখা বিষয় সমূহের ব্যাপারে তার মধ্যে এক ধরনের অব্যাখ্যাগত প্রত্যয় জন্ম নেয়। এই সম্পর্কিত নান প্রশ্ন ও জিজ্ঞাস্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও তার সেই বিশ্বাস থাকে অটুট।
সুতরাং হেদায়াত মানবলব্ধ নয়। বরং আল্লাহর মর্জিতে (Divine will) প্রাপ্ত। এই প্রাপ্তি জান্নাত ও জাহান্নামের যৌক্তিকতাকে খন্ডন করে না। কেননা মহান আল্লাহ বান্দাহর গুঢ়ার্থের জ্ঞানের সূত্রেই তাঁর মর্জির প্রকাশ ঘটান। সুতরাং এইটা বলবার সুযোগ নাই যে মহান আল্লাহ অন্যায্য ভাবে তাঁর মর্জি মোতাবেক কাউকে হেদায়েত দান করেছেন আর কাউকে করেছেন বঞ্চিত। বরং প্রজ্ঞাবানেরা সাক্ষ্য দেবেন যে যদি একজন সর্বশক্তিমান, কালোত্তীর্ণ স্রষ্ট্রার অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়, এবং তার অস্বীকার মূর্খতার ভয়ংকর রুপ মাত্র, তাহলে এই যাপিত জীবন আদম সন্তানের স্বপোলব্ধির, আত্ম-আবিষ্কারের প্রক্রিয়া মাত্র। তার যাপিত জীবন তার পূর্বলিখিত তকদীরের যথার্থতা প্রমাণের জন্য। তার যাপিত জীবন তার তকদীরের সম্পূর্ণতার (finality) এক জ্বলন্ত সাক্ষী মাত্র। যেমনটা হাদীসে শরীফে এসেছে: লিখন-ও সমাপ্ত, রায়-ও চূড়ান্ত (The pens have been lifted and the pages have dried)।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। মহান আল্লাহ এবং কেবল মহান আল্লাহ-ই যে আদম সন্তানের একমাত্র আরাধনার বিষয় হওয়া উচিত এটা আমরা উপলব্ধি করি যখন গায়রুল্লাহর সূত্রে আদমের বিকার, অধ:পতন, ও ধ্বংস দেখি। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ একদা মন্তব্য করেছিলেন যে জীবনের একটা পর্যায়ে এমনও ছিলো যে মনে হতো প্রিয়ার গালের একটা তিলের জন্য জীবন দিয়ে দেয়া যায়। উনি রস করে তা বললেও রসালাপে এর তাৎপর্য সীমাবদ্ধ করে রাখবার সুযোগ নেই। কারণ ঈমান ও কুফরের দ্বন্দ্ব-টা এখানেই। কারন প্রিয়ার গালের জন্য জীবন দেয়ার বিষয়টি রসের আলাপ মনে হলেও খোদার জন্য জীবন দেয়ার আলাপ-টি জঙ্গিবাদী ঠেকে।
বিষয়টি একবারে ঘটেনি। প্রথমত ঐশী বিধানাবলির অবমাননার মাধ্যমে একে ব্যঙ্গাত্মক ও হাস্যরসের বিষয়ে পরিণত করা হলো। দ্বিতীয়ত মানুষকে শেখানো হলো সে নিজেই তার নিয়ন্ত্রক। তৃতীয়ত যেহেতু আদম সন্তানদের অধিকাংশ-ই নিরীহ অনুসারী মাত্র এবং যেহেতু নেতৃত্বের স্থান থেকে ঐশী বিধানাবলির উত্তরাধিকারীদেরকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, সেহেতু তাদের স্থান দখল করে নিলো ইবলীশের অনুসারীগণ।
ফলত: এই যুক্তি তোলা হলো যে যেহেতু বেশ্যাগমনের ইতিহাস মানবের জন্মলগ্ন থেকে তাই এর নিষিদ্ধকরণ অযৌক্তিক। তাছাড়া কেবল নিষিদ্ধ করার মাধ্যমেই যেহেতু এর চর্চা থামানো যাবে না সেহেতু এর বিধিবদ্ধ চর্চা হওয়াটাই অধিকতর যৌক্তিক। এভাবে বেশ্যাবৃত্তির বৈধকরনের পরবর্তীতে দেখা গেলো বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক শুধুমাত্র অনুমোদন প্রাপ্ত বেশ্যাগার সমূহে সীমাবদ্ধ নেই। বরঞ্চ তা পুরো সমাজকে গ্রাস করে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সুত্রে বেশ্যাগারকে বর্তমানে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। স্বামী-স্ত্রী এর যে সম্পর্ক এক সময়ে শুধুমাত্র পরস্পরের জন্যই নির্দিষ্ট ও রক্ষিত ছিলো তার নিয়ন্ত্রণ চলে গেলো অদৃশ্য সুবিধাভোগী (beneficiary) চক্রের নিকট। কেননা বেশ্যা ও তার খদ্দেরের মধ্যেই যে কেবল মাগীবৃত্তির অর্থনীতি সীমাবদ্ধ তা তো নয়!
পাঠক লক্ষ্য করুন এক সময় বৈবাহিক সম্পর্কের বিষয়টি একটি পুত:পবিত্র, সংবেদনশীল, আরাধ্যের বিষয় ছিলো। কিন্তু ধর্মাবমাননার সূত্রে যখন থেকে মানুষের সংবেদনশীতা ও রক্ষণশীলতাকে নষ্ট করা হলো তখন থেকেই তাকে পর্যায়ক্রমে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হতে থাকলো। এক পর্যায়ে তার নিজ গৃহের, এমনকি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ-ও তার হাতে থাকলো না। সে ঐশী বিধানবলীর বন্ধন থেকে স্বাধীন, জিঞ্জির মুক্ত হয়েছে বটে তবে তদস্থলে শয়তানের নাগপাশে তাকে বন্দী করা হয়েছে। তার শরীর বিকিকিনির স্বাধীনতা স্বীকৃত কিন্তু নাগিরক পরিচয় পত্র না থাকলে তার মানবতা, তার অস্তিত্ব-ই স্বীকৃত নয়।
যারা জিহাদ-কে তুচ্ছ করতো এবং এখনও করে যাচ্ছে তারা কিন্তু যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে আসেনি। বরঞ্চ তাদের যুদ্ধের ময়দান মুসলমানের গৃহ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। পাশ্চাত্যের যতো বৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সমূহকে দেখেন তারা কোন না কোন ভাবে বিশ্বব্যাপী পরজাতির সম্পদ লুন্ঠনকল্পে যুদ্ধ, যৌনতা, এবং নেশা জাতীয় দ্রব্যের ব্যবসার সাথে যুক্ত। যার প্রত্যেকটি মানব বিধ্বংসী। অথচ মানবতাবাদের দোহাই দিয়ে, পরমতসহিষ্ণুতার নামে ধর্মজ্ঞানের তুচ্ছকরণের মধ্য দিয়েই কিন্তু এর সূচনা হয়েছিলো।
কিন্তু এই যে আপনাদের বুদ্ধিবেচিদের শাতিমে রসুলের রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝাতে এতো কিছু খুইল্লা বলতে হইলো এটাই আপনাদের একিলিস হিল (Achilles heel)। কারন আপনারা তাদের খরিদ্দার না হইলে তারা তো বুদ্ধি ব্যাচতে পারতো না। এই যে শাতিমে রসুলের প্রেক্ষাপটে সুলতান আব্দুল হামিদের যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠের মধ্যে আপনাদের বুদ্ধিবেচিরা কেবল মধ্যযুগীয় যুদ্ধোন্মাদনা দেখে এইটাই মুল সমস্যা। মুসলিম সমাজের এরাই অভ্যন্তরীণ শত্রু (Trojan Horse)। এদের কারনেই আপনারা বারংবার হেরে যান। মনে রাখবেন পীর দেখে যেমন মুরিদ চেনা যায়, তেমন মুরিদ দেখেও পীর চেনা যায়।