বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধের পদধ্বনি: রাজনৈতিক সংকটের সূত্র ও এর সমাধান


১৯৭১ সালে তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় আধিপত্যবাদ (Indian Hegemony) এর সর্বগ্রাসী প্রবণতা বিগত আওয়ামী মাফিয়ার সরকারের আমলে বিভৎসরুপ ধারণ করে। সেই সময় ভারতীয় আধিপত্যবাদের খলনায়কদের বরাতে দেশের জনগনকে হুমকি দেয়া হয়েছিলো এই বলে যে বাংলাদেশে তারা এমনভাবে গেঁড়ে বসেছে যে সরকারের পালাবদলে তাদের অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হবে না।

বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ যতোটা না শারীরিক (physical) তার চাইতে মানসিক (psychological)। যতোটা না তাদের নিযুক্ত কর্তাব্যক্তিদের (RAW agent) কারনে তার চাইতে বেশী এদেশের মুসলমান বিশেষত রাষ্ট্র্যের অংশীদারগণ (stakeholder) এবং অদৃশ্যমান ব্যবস্থাসমূহের (deep state) চিন্তার অভ্যাসজনিত (habits of thought) কারনে। চিন্তার এই অভ্যাস এই দেশের মুসলমানকে উম্মতে মোহাম্মদীর সাথে যতোটা না সম্পৃক্ত করে তার চাইতে বেশী সম্পৃক্ত করে তার কল্পিত ভাষাগত, নৃতাত্ত্বিক, কিংবা রাজনৈতিক ভাবাদর্শগত পরিচয়ে। বাংলাদেশের মূল সংকট-টা এখানে।

কারন এই সব অধর্মগত সূত্রে বৃহত্তর বাংলা প্রভৃতি জাতীয় যেসব প্রকল্প উপস্থাপন করা হয় তার অসারতা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সূত্রে প্রমাণিত। পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীরা পূর্ব বঙ্গ থেকে ধর্মের সূত্রে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে ধর্মের কিংবা ভাবাদর্শগত বন্ধন ভাষাগত ও নৃতাত্ত্বিক বন্ধন থেকে অধিক শক্তিশালী বলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

চিন্তার সংকটগত এই অভ্যাসের ব্যাপকতা ও গভীরতা আমরা টের পাই পঁচিশে মার্চে মেজর জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহের ঘটনার সাথে ২৮ ফ্রেব্রুয়ারী বিডিয়ার বিদ্রোহের প্রতিক্রিয়ায় সেনা অফিসারদের বিদ্রোহের কিংবা বিদ্রোহের প্রচেষ্টাগত ঘটনাবলীর তুলনামূলক বিচারের নৈতিক মানদন্ড সম্পর্কিত অসংগতিতে।

অর্থাৎ ২৫'শে মার্চ যখন বাঙ্গালী অফিসারগণ বিদ্রোহ করেন তখনও কোন ধরনের ঘটন-অঘটনের সূত্রেই ২৮ ফেব্রুয়ারীর মতো এতো অধিক সংখ্যক হারে বাঙ্গালী সেনা অফিসারগণ হত্যার শিকার হন নাই। তথাপি এই যে বাঙ্গালী মানসে ২৫ মার্চের বিদ্রোহের বৈধতার বিপরীতে ২৮ ফেব্রুয়ারী পরবর্তীতে সেনা অফিসারদের বিদ্রোহের অন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পেতে পারছে আমার মতে এটাই ভারতীয় অধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা পাবার ক্ষেত্রে মূল অনুঘটক (catalyst)।

এ কারনে '৭১ পরবর্তী যতোবার ভারতীয় অধিপত্যবাদের নিষ্পেষণে অতিষ্ঠ হয়ে দেশের মানুষ ফুঁসে উঠে সেনাবাহিনীর বিপুলাংশের সহায়তায় সফল বিদ্রোহ সংঘটন করেছিলো ততোবার-ই কালক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বরাতে ভারতীয় আধিপত্যবাদ পুন:পুন: প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। অর্থাৎ যতোক্ষণ পর্যন্ত না মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনা-কে ইসলামী জযবা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে ততোক্ষণ পর্যন্ত ভারতীয় আধিপত্যবাদের কার্যকর বিনাশন সম্ভব হবে না।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটা আত্মঘাতী মানসিকতা হলো এই যে বাঙ্গালী মুসলমানকে তাদের ভাষাগত ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের বরাতে উম্মতে মোহাম্মদীর অন্যান্য ভাষাগত ও নৃতাত্ত্বিক জাতিসমূহ থেকে বিচ্ছিন্ন করবার প্রবণতা। এই চেতনার সূত্রে বাঙ্গালী মুসলমানের মানসে এক আষাঢ়ে শ্রেষ্ঠত্ব ও আত্মবিশ্বাসের পয়দা করে মুসলিম বিশ্ব থেকে তাকে এক ঘরে করে ফেলা হয়। শিকারী প্রাণি যেমন তার শিকার-কে দলছুট করে আক্রমণ, বশীভূত, ও ভক্ষণ করে ঠিক তেমন। অথচ বিশ্বমঞ্চে আমরা দেখতে পাই যে এমনকি পরাশক্তি সমূহ পর্যন্ত কেবল নিজেদের শক্তিমত্তা কিংবা শ্রেষ্ঠত্বের ওপর ভর না করে বিভিন্ন দেশ ও জাতিসমূহের সাথে কৌশলগত জোট গড়ে তুলে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর হয়।

'২৪ জুলাই এর সফলতার অন্যতম কারন ছিলো মুক্তিযুদ্ধের এই বয়ানকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার বিদ্রোহাত্মক প্রবণতা। ভারতীয় উপমহাদেশে 'রেযাকার'-গণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পক্ষ। উপনিবেশোত্তর আঞ্চলিক কাঠামোতে কাশ্মীর ও হায়দারাবাদের মতো কিছু অঞ্চল-কে সর্বসম্মতিক্রমে পাকিস্তান ও ভারতে অন্তর্ভূক্ত করা থেকে পৃথক রাখা হয়েছিলো। কাশ্মীর ছিলো মুসলিম সংখ্যাধিক্যের হিন্দু রাজা শাসিত অঞ্চল। বিপরীত পক্ষে হায়দারাবাদ ছিলো হিন্দু সংখ্যাধিক্যের মুসলিম নওয়াব শাসিত অঞ্চল। কিন্তু যখন দেখা গেলো অহিংসবাদী গান্ধীর ভারত সুযোগ বুঝে তার আস্তিন থেকে ছোরা বের করেছে অর্থাৎ কাশ্মীর দখলের প্রয়াস পাচ্ছে তখন হায়দারাবাদের নওয়াব পাকিস্তানে অন্তভুক্তির তোড়জোড় শুরু করেন। তা টের পেয়ে ভারত বিলাতীদের থেকে অধিক হারে প্রাপ্ত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র বাবদ হায়দারাবাদ দখল করে নিতে উদ্যত হলে সেখানকার দশ সহস্র রেযাকারগণ তাঁদের অপর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও সদস্যদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেন। সেই প্রেক্ষাপটে একাত্তর পরবর্তী রেযাকার বিরোধী একতরফা বয়ানকে নিরীহ দৃষ্টিতে দেখবার কোন সুযোগ নেই। বরং তা ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার অনেকগুলো ক্ষেত্রের (war fronts) একটি মাত্র।

এখন কথা হলো ভারতীয় আধিপত্যবাদের সবচাইতে বড়ো সুবিধাভোগী আওয়ামী ও বামবাদী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলসূমহ এতোটা বেক্কল নয় যে তারা এই সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে জবেহ করে বাঙ্গালী মুসলমানকে জেয়াফত খাওয়াবে। আমার "ধারণা" জিয়াউর রহমান সাহেব তাঁর জীবদ্দশাতেই একাত্তুরে তাঁর আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের ভয়াবহ পরিণতি আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাঁর রণাঙ্গণের কমরেডরা তো "মুক্তিযুদ্ধ" শুরুর অত্যল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের এই উপলব্ধির কথা স্পষ্টতই ব্যক্ত করেছেন।

সমস্যা হলো এটা এমন সাঙ্ঘাতিক প্রকৃতির বিভ্রান্তি (blunder) ছিলো যার প্রকাশ্য স্বীকৃতি এর সংঘটকদের অস্তিত্বের জন্য সংকটজনক ছিলো। তথাপি এর সত্যতা ছিলো অনস্বীকার্য। এর ভয়াবহ পরিণতি ছিলো অনিবার্য। যা একাত্তর পরবর্তী মুজিব শাসনমালেই প্রকাশ পাচ্ছিলো। আমার মতে এ কারনেই জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে OIC এর বরাতে এই ফাঁদ থেকে মুক্তি পাবার একটা প্রয়াস নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিসমূহের সাথে মিটমাট (reconciliation) ও তাঁদেরকে রাষ্ট্র্য ক্ষমতার অংশীদার করা-টা ছিলো প্রয়াসের একটা লক্ষণ। তথাপি মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া তাঁর ও তাঁর দলের কোন রাজনীতি নাই। তাই সেটার বিনাশন-ও তাঁর পক্ষে ছিলো অসম্ভব। এ এমন-ই এক কাঁটা যা না তিনি পেরেছেন গিলতে না উগরে ফেলতে। ফলত: ভারতীয় আধিপত্যবাদের সমূলে উৎপাটনে তিনি হয়েছিলেন ব্যর্থ। যার জন্য তাঁকে জীবন দিয়ে মূল্য চুকাতে হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এই কাঁটার চুলকানি আমরা ২৪'জুলাই পরবর্তী বিগত এক বছর যাবৎ লক্ষ্য করেছি। যেসব মূহুর্তে বাংলাদেশের মুসলমান অতীতের দায়ভার মুক্ত হতে চেয়েছে সেই সব মুহুর্তে একাত্তরকে হাজির করে তাকে বিভ্রান্ত ও দ্বিধাগ্রস্থ করা হয়েছে। কারন যেই মুহুর্তে সে একাত্তরের দায়ভার মুক্ত হয়ে ইসলামে উজ্জীবিত হবে এবং সেই ধর্মীয় সূত্রে উম্মতে মোহাম্মদীর বৃহত্তর অংশ সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে আবির্ভূত হবে, সেই মুহুর্তে ভারতীয় আধিপত্যবাদের কবর রচনা হবে। বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে হয়ে উঠতে স্বাধীন, সার্বভৌম।

বাংলাদেশে ২৪'জুলাই পরবর্তী নৈরাজ্যকর ঘটনাবলী প্রমাণ করে যে ভারতীয় আধিপত্যবাদের নিয়ামক শক্তি তাদের কূটকৌশল বজায় রেখেছে। ভারতীয়দের পক্ষ থেকে এর চাইতে ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা করবার সুযোগ নাই। কিন্তু তাদের এদেশীয় প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ, সচেতন কিংবা অসচেতন, দালালদের এটা উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে বিশ্বব্যবস্থায় একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। পুরনো ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠী সমূহ বিশ্ব ময়দানের গুরুত্বপূর্ণ অক্ষশক্তি হয়ে আবির্ভূত হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি বড়ো অংশ বর্তমানে স্বল্প বয়সী তরুন। তারা ইসলামের প্রশ্নেও তাদের পূর্বের জেনারেশনের চাইতে উল্লেখযোগ্য হারে অধিক মাত্রায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিগত দেড় যুগ যাবৎ খোদাদ্রোহীদের দ্বারা তাদের নিপীড়িত হবার স্মৃতি সহজে বিস্মরণযোগ্য নয়।

আওয়ামী হিসাব অনুযায়ী জুলাই'২৪ এ কয়েক লক্ষ আওয়ামী ভারতীয় সেবাদাসের মৃত্যু ঘটে নাই বলেই তাদের দু:সাহসিক হয়ে ওঠা উচিত হবে না। তরুনদের রক্ত প্রতিশোধের বহ্নি শিখায় টগবগ করে জ্বলছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার যে কোন প্রচেষ্টা আগুনে ঘি ঢালার মতো বিপদজনক। কখন কোন মুহুর্তে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো জুলাই'২৪ এর গণ বিস্ফোরণ হঠাৎ পুনরায় কালবৈশাখীর রুদ্ররুপ ধারণ করে সব লন্ডভন্ড করে দেবে তার পূর্বানুমাণ কিংবা গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করা অসম্ভব। একবার পার পেয়ে গিয়েছেন বলেই বারংবার সিহের লেজ দিয়ে কান চুলকালে এক সময় দেখতে পাবেন নিজের মাথা সিংহের মুখগহ্বরে।

তুরষ্কের একটা প্রবাদ স্মরণ করিয়ে দেই:

গযে গয, দিশে দিশ। (göze göz dişe diş / চোখের বদলে চোখ, দাঁতের বদলে দাঁত)
খানা খান, জানা জান। (kana kan cana can / রক্তের বদলে রক্ত, জানের বদলে জান)

Popular posts from this blog

ইসলাম ও গণতন্ত্র

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

জুলাই কাহা-নি