সেকুলার চিন্তা ও চিন্তক

আওমী বিরোধীতার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিজেকে বর্তমানে বিএনপির বুদ্ধিজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ডা. জাহেদ জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতার সাথে আলোচনা কালে দাবী করেছেন যে তিনি সেই যে কখন ছাত্র ইউনিয়ন করা ছেড়েছেন এরপর তিনি আর কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নাই। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে জুলাই'২৪ পরবর্তী কোন এক আলোচনায় মানুষ মাত্রই যে পক্ষপাতদুষ্ট এটা প্রতিষ্ঠিত করতে যেতে উনি বলেছিলেন তিনি নিজেও একটি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত।

বাংলাদেশে বামঘরানার সেকুলার বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তিনজনকে বিশেষ কেস স্টাডি ধরে ইসলামী মানসের দৃষ্টি থেকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। যদিও তিনজন একই শ্রেনীর বা ধরনের নন।

১. ডা. জাহেদুর রহমান
২. মাহমুদুর রহমান মান্না
৩. পিনাকী ভট্টাচার্য

এবং সেই সূত্রে বৃহত্তর পরিসরে সেকুলার চিন্তা ও চিন্তকদের চিন্তাপ্রক্রিয়া ও কর্মপরিণতির চিত্রাকংনের মাধ্যমে এর বিভ্রান্তিপূর্ণ মানসিক প্রক্রিয়ার ফলস্বরুপ-ই যে তা বারংবার মানব বিধ্বংসী পরিণতি ডেকে আনে তা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করা হবে।

ডা. জাহেদ নিজেকে বুদ্ধিজীবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করানোর প্রবণতা সম্পন্ন একজন আঁতেল বিশেষ। মোটাদাগে নিরীহ প্রকৃতির। আঁতেল এ কারনে যে তাঁর বক্তব্যে তাঁর শিক্ষা ও বুঝ ক্ষমতার অগভীরতা স্পষ্ট। তথাপি তাঁর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা আঁতেল প্রকৃতির লোকদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। অর্থাৎ আমরা আঁতেলের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিলাম, যে আঁতেল তিনি-ই যিনি পড়েন এক আনা, যা পড়েন তার সিকি বোঝেন কিন্তু বকেন ষোল আনা, ডা. জাহেদ যেনো তার আদর্শ প্রতিরুপ। তিনি নিরীহ প্রকৃতির আঁতেল-ও বটে। অর্থাৎ তাঁর প্রচেষ্টায় অন্যের ক্ষতি বা মানহানির চাইতে, নিজের প্রতিষ্ঠা পাবার প্রবণতা-টা বেশী। সমাজে, রাষ্ট্যে - এই ধরনের নিরীহ প্রকৃতির আঁতেলদের অত্যাচার সহ্য করা হয় প্রধানত সামাজিকতা ও মানবিকতা বিবেচনায়। অর্থাৎ এই ধরনের ব্যক্তিরা যে মহৎ উদ্দেশ্যে নিজেদের সমর্পন করবার প্রচেষ্টায় প্রাণান্ত তার উপযুক্ত তারা না হলেও অন্তত তাদের উচ্চ অভিলক্ষ্য ও প্রচেষ্টার স্বীকৃতি মানুষ দেয়ার পক্ষপাতি।

কিন্তু এই যে ডা. জাহেদ বাদানুবাদে জড়িয়ে মূহুর্তের মধ্যে অবলীলায় একটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে নিলেন এটা কিন্তু ব্যক্তি বিশেষের সমস্যা নয়। আমাদের দাবী হলো এটা মানসের সমস্যা। সেকুলার চিন্তাধারা ও মানস প্রক্রিয়ার সমস্যা। এর একদিকে যেমন শেকড়ে প্রোথিত কোন নৈতিক কাঠামো নেই অপরদিকে এর এমন কোন সর্বজনে প্রতিষ্ঠিত আচার-অনুষ্ঠানাদি (rites and rituals) নাই যা তাকে আত্ম-বিক্ষণে পরিচালিত, উব্ধুদ্ধ বা বাধ্য করে। এখানে নৈতিকতা, যদি থাকেও বা, তা হলো একটা চলমান প্রবণতা (passing phase) মাত্র। এবং শেকড়ে প্রোথিত না হবার কারনে দ্বন্দ-সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন উপযোগিতার প্রশ্নে বরাবরই পর্যবসিত হয়।

মাহমুদুর রহমান মান্না সাধারন বামবাদী রাজনৈতিকদের থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। তাঁর মধ্যে নিজেকে জাহির করবার কুৎসিত প্রবণতা অনুপস্থিত। বরং এক ধরনের চিন্তার স্পষ্টতা তাঁর মধ্যে বিদ্যমান যা বামবাদীদের মধ্যে বিরল। ভণিতা ও আত্মপ্রবঞ্চনার আশ্রয় না নিয়ে নিজের বুদ্ধিবৃত্তির সীমাবদ্ধতার সচেতনতা পূর্বক বাস্তবতার নির্মোহ পাঠ ও তাকে গুছিয়ে উপস্থাপন করার একটা আকর্ষনীয় ক্ষমতা তাঁর আছে।

সম্প্রতি ফরহাদ মাযহার সাহেব যখন বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার নামে পালংবাদ, সিরাজুল আলম, বৃহত্তর বাংলা - ইত্যাদি করে গুয়ে-গোবরে লেপ্টে একাকার হয়ে যাচ্ছিলেন তখন মান্না সাহেব সেই বিক্ষিপ্ত, উদভ্রান্ত আলোচনাকে যথেষ্ট শিষ্টাচারজনিত ও ভদ্রোজনিত উপায়ে যেভাবে সামলে নিয়েছেন তা লক্ষ্যনীয়। কিন্তু ঘুরেফিরে তিনিও চলে গিয়েছেন বা যেতে বাধ্য হয়েছেন সেই মার্কসবাদী সর্বনাশা ও উদভ্রান্ত সেকুলার চিন্তাকাঠামোতে। আমি মাঝে মাঝে বিস্মিত হই যে এরকম বুদ্ধিবৃত্তির একটা লোক কি করে বামবাদী বিভ্রান্তিকর একটা চিন্তাধারার ফাঁদে জীবন নষ্ট করে ফেললো?

তার ক্ষেত্রে আমার বিবেচনা হলো সমস্যা-টা যতোটা না চিন্তাগত তার চাইতে বেশী দীক্ষাগত। যতোটা না চরিত্রের তার চাইতে বেশী কলবের। মাওলানা সাঈদী রহ: এরঁ মৃত্যু পরবর্তী আলোচনায় সরকার কর্তৃক তাঁকে মৃত্যুর দিয়ে ঠেলে দেয়া ও মৃত্যু পরবর্তী তাঁর জানাযা অনুষ্ঠান নিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের আলোচনা যখন দেশে তুঙ্গে সেই জেরবারে মান্না এক আলোচনায় মাওলানা সাহেবের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়েও মাওলানার প্রতি সূক্ষ বিদ্বেষের পরিচয় দিয়েছিলেন। মাওলানার নিপীড়ন প্রসঙ্গে তার বক্তব্য-টা অনেকটা এরকম ছিলো যে একটা চোরকেও তো শাস্তি প্রদানের বাইরে নিপীড়ন করার অধিকার রাষ্ট্র্যের নাই! অর্থাৎ তিনি ইঙ্গিত দিলে যে আওয়ামী মাফিয়া সরকারের বিচারের নামে প্রহসনের আদালত কর্তৃক দন্ড প্রাপ্ত হওয়াটা তার জন্য যথার্থ ছিলো। কিন্তু এখন আওয়ীরা নিপীড়নের মাধ্যমে কেনো জামায়াতে ইসলামীর প্রতি মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে দিচ্ছেন সেজন্যই মূলত তাদের আক্ষেপ।

গুজরাটে হিন্দুদ্ববাদী বিজেপি গুন্ডাদের দ্বারা যখন একজন মুসলিম সংসদ সদস্যের সন্তান সম্ভবা স্ত্রীর পেট চিরে অনাগত সন্তানকে হত্যা করা হয়েছিলো সে প্রসঙ্গে গুজরাটের কসাই ও পরবর্তীতে হিন্দুদের বিপুল ভোটে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি এক প্রশ্নের জবাবে মন্তব্য করেছিলো যে রাস্তায় চলার পথে গাড়ি চাপা পড়া কুকুর বাচ্চার জন্য মানুষের যেমন আফসোস হয় তেমনি গুজরাটে হিন্দুদের হাতে নিহত মুসলিমদের জন্যও তার আফসোস হয়।

এবার আশা যাক পিনাকীদার প্রসঙ্গে। পিনাকী বাংলাদেশের রাজনীতি চর্চার সংস্কৃতি-কে একটা নতুন মাত্রা দান করেছেন। মানে তাঁর কটু-কাটব্যের বদ-অভ্যাস যদি একদিকে সরিয়ে রাখতে পারেন আরকি। দেশীয় মিডিয়ায় রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রে জ্ঞান ভিত্তিক ও অনুসন্ধিৎসা তাড়িত একটা মাত্রা পিনাকীর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সেই সাথে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় মানুষের রাজনৈতিক বিবর্তনের একটি উদাহরণ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। অর্থাৎ শাহবাগ থেকে শাপলা চত্বরে তার যে রুপান্তর এইটা জনমানুষ প্রত্যক্ষ করেছে।

তথাপি সেকুলার চিন্তাধারার বিষক্রিয়া এখনও পিনাকীদার মাঝে পরিলক্ষিত হয়। তিনি আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী অন্যতম অনুঘটক। সেই সূত্রে আওয়ামী উত্তর রাষ্ট্র্যের ওপর তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠার একটা শিশু সূলভ আচরণ তাঁর মধ্যে প্রকাশ পায়। এক ধরনের আত্ম-গরিমার ক্লেদ প্রায়শ তাঁর প্রক্ষেপিত (projected) সাম্যবাদী (egalitarian) ব্যক্তিত্বকে ম্লাণ করে। বামবাদী প্রতিশোধ পরায়ণতা, সেকুলার কায়দার অসহনশীলতা (zero tolerance), প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে জিঘাংসা চরিতার্থ করবার ছাপ এখনও তার বক্তব্যে বিদ্যমান। সর্বোপরি তিনি আত্মপক্ষ ছাড়াও আসলে আর কোন কোন পক্ষের সে বিষয়টি-ও খোলাসা নয়। যদিও আমার নিকট তাঁর চীনা ঝোকপ্রবণ বামবাদী মানস সুস্পষ্ট। যেটা আওয়ামী উত্তর প্রেক্ষাপটে বেগবান হয়েছে ১৫-ই আগস্টের কুশীলব মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ব্যক্তি বিশেষের সরলতা, অনুসন্ধিৎসা, মানসিক স্পষ্টতা ইত্যাদি বহুবিধ গুণাবলী কখনও অকার্যকর হয়ে পড়ছে শেকড়হীন নৈতিকারবোধের কারনে, কখনও দীক্ষাগত, কখনও কলব, কখনও চরিত্র দোষে। ফলত: সেকুলার দৃষ্টিভঙ্গীর চশমার ফোকর দিয়ে দুনিয়ার দর্শন হয়ে পড়ছে অন্ধের হস্তি দর্শনের মতো। যার যেদিক উৎকর্ষতা সে সেই দিক দিয়ে হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে তথাপি শেষমেশ তা কোন সার্বিক চিত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না।

এই যে হাতড়ে বেড়ানো এটা সেকুলার চিন্তাকর্মের, চিন্তা প্রক্রিয়ার একটা লক্ষ্যনীয় বৈশিষ্ট্য। সে বুদ্ধিবৃত্তি কপচাতে (critical thinking) গিয়ে বৈকল্য ও জড়তায় (analysis-paralysis) আক্রান্ত হয়। চক্রে ঘুরপাক খায়। কিছুতে-ই স্থির হতে পারেনা। তার শেকড় গজাতে পারে না। ঐ যে ঈমাম গাজ্জালী রঃ বলেছিলেন ক্রমাগত চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকা (infinite digression)। দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে হন্যে হয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ানো।

বুদ্ধিমান পাঠক হয়তো ধরতে পারবেন যে, আমরা যেভাবে ব্যক্তি বিশেষের নির্দিষ্ট সংখ্যক স্খলন উল্লেখ করে তাদের চিন্তাধারার অযৌক্তিকতা বা অসারতা প্রমান করতে চেয়েছি তদ্রুপভাবে কোন ইসলামী চিন্তকের স্খলন-বিশেষ উল্লেখ করে ইসলামী মানস ও চিন্তাপ্রক্রিয়াকে বাতিল করবার প্রশ্ন উত্থাপন করাটা যৌক্তিক কিনা? এর উত্তর হলো, না যৌক্তিক নয়। এটা এই কারনে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। মানুষ মাত্রই ভুল হয়, এটা সত্য। কিন্তু সব ভুল এক ধরনের ও এক মাত্রার নয়। সেকুলারদের ভুল তাদের চিন্তাকাঠামো ও চিন্তাপ্রক্রিয়াগত। মুসলমানের ভুল তার নিজস্ব বিশ্বাস, শিক্ষা, ও চারিত্রিক দুর্বলতাগত।

ঠিক এ কারনেই ইতিহাসে দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় সেকুলার চিন্তার ধারক ও বাহকেরা, যারা আপাত দৃষ্টিতে সৎ ও উত্তম বলে বিবেচিত, তারা সম্পদ কিংবা ক্ষমতার বেড়াজালে জড়িয়ে কিভাবে যে মানব বিধ্বংসী একেকটা দানব হয়ে ওঠে তা তারা নিজেরাই উপলব্ধি করে না। কিন্তু মূল সমস্যা সেখানে না। মূল সমস্যা হলো এই যে তারা কুৎসিত কিংবা মানব বিধ্বংসী হয়ে উঠলো তা নির্ধারনের সর্বজনে প্রতিষ্ঠিত কোন নৈতিক কাঠামো সেকুলার চিন্তায় অনুপস্থিত।

যখন ইসলামী শাসকদের স্খলন নিয়ে আলোচনা হয় তখন ইসলামের শরীয়তের মানদন্ড মোতাবেক-ই তা করা হয়। বা করবার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যখন কোন অমুসলিম হিটলার বা বামবাদী স্টালিন জাতীয় নেতাদের স্খলন নিয়ে আলোচনা হয় তখন তার আলোচনা প্রায়শ বিচিত্র রুপ লাভ করে ঘুরপাক খেতে থাকে কিন্তু কখনই স্থিত হতে পারে না।

মুসলিম সমাজ ও রাষ্ট্র্য নিয়ে পাশ্চাত্যের যেসব সেকুলার বুদ্ধিজীবিরা গবেষণা করেন তাঁদের চিন্তাকর্মে এই অস্থিরতা স্পষ্ট। উপনিবেশবাদের করুন পরিণতি (fatal consequence) কে তাঁরা অস্বীকার করতে না পারলেও তার দায়বদ্ধতার মাত্রা ও সীমার ব্যাপারে তাঁরা উদাসীন। জুলুম নয় বরং জুলুমের বিপরীতে মজলুমের আক্রোশ-ই তাঁদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

সিরিয়াতে আসাদ সরকারের সময় আলাওয়ী সংখ্যালঘুদের ব্যাপক উত্থান, কমিউনিস্ট চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের পুনর্বিন্যাসে তাদের আগ্রাসী দখলদারিত্ব, এর বিপরীতে সংখ্যাগুরু সুন্নী সম্প্রদায়ের পুঞ্জীভুত ক্ষোভ বৃদ্ধি, যা আলাওয়ীদের আরও অধিকহারে আতংকগ্রস্থ ও হীনমন্য করে সুন্নী সম্প্রদায়ের ওপর তাদের আরও নৃশংসভাবে চড়াও হওয়ার দুষ্টচক্র-কে বেগবাগ করে, তা সংখ্যালুঘদের ক্ষমতায়ন প্রকল্পকে সুস্পষ্টভাবে অপনোদন করলেও পাশ্চাত্যের সেকুলার চিন্তকগণ যেনো সে বিষয়ে উদাসীন।

আলাওয়ী রাষ্ট্র্য বিনাশী শাসকেরা যখন সুন্নী মসজিদের মিম্বর কামানের গোলায় গুড়িয়ে দেয়, মসজিদের দেয়ালে যখন বাশার ছাড়া কোন মাবুদ নাই লেখা অঙ্কিত হয়, যখন সেনা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার সন্তানের তালাশ করতে যাওয়া পিতাকে পুত্রের শোক ভুলে বাড়িতে গিয়ে নতুন পুত্র সন্তান পয়দা করা এবং তাতে সক্ষম না হলে তার স্ত্রীকে সন্তান সম্ভবা করবার জন্য বাহিনীর হাতে তুলে দিতে বলা হয় তাতে নিপীড়নবাদী রাষ্ট্র্যের বিনাশন মুখ্য বিষয় না হয়ে জুলুমের বিপরীতে মজলুমের আর্তচিৎকার ও ক্ষোভের বহি:প্রকাশের ধরন কি করে মূল আলোচ্য বিষয়ে পর্যবসিত হতে পারে?

আমরা বারংবার এ কথাই বলতে চাচ্ছি যে নৈতিক বিচারের এরকম ভারসাম্যহীনতা সেকুলার চিন্তাধারা ও কর্মপ্রক্রিয়ার সূত্রেই কেবল ঘটতে পারে। এটা বুদ্ধি চর্চার ক্ষেত্রে এমন একধরনের মন:বিক্ষেপ তৈরী করে যা প্রত্যক্ষ (immediate) থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে পরোক্ষের (derived) দিকে নিয়ে যায়। মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টিকে ঘুরিয়ে সমস্যা থেকে উৎগত উপসর্গের দিকে মনোনিবিষ্ট করা হয়।

বিচারশক্তি ও বুঝক্ষমতার এই দৈন্যতার একটা ভালো উদাহরণ হলো আরঙ্গজেবের ওপর অড্রী ট্রাশকী (Audrey Truschke) রচিত কিতাব-টি। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে এই কিতাব-টি রচনার জন্য লেখকের ভারতে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ কিতাব-টি আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে আনিত হিন্দুদ্ববাদী বয়ানকে খন্ডন করেছে মোক্ষম ভাবে। তথাপি তার মুল সুরে সেকুলারবাদী একটা বিক্ষেপ, একটা বিভ্রান্তির ছাপ সুস্পষ্ট।

লেখক একদিকে হিন্দুত্ববাদীদের আরোপিত মিথ্যাচারের খন্ডন করছেন অপরিদকে ঘুরেফিরে সেকুলার চিন্তা কাঠামোর ঘুনার্বতে আবর্তিত হয়ে আরঙ্গজেবের স্খলন তালাশ করছেন। কয়েকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপার পরিষ্কার হবে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সেটা প্রাসঙ্গিক তো বটেই এমনকি দিক নির্দেশবাহী।

আরঙ্গজেবের পরিবর্তে দারা শিকোহ মোঘল সম্রাট হলে মোঘল সাম্রাজের এতো দ্রুত পতন হতোনা, তদুপোরি ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের কবলেও এই উপমহাদেশকে পড়তে হতো না বলে যে হিন্দুত্ববাদী বয়ান চালু আছে লেখক ট্রাশকী একদিকে যেমন তার খন্ডন করছেন সেকুলার চিন্তাকাঠামোর বরাতে অন্যদিকে সেই কাঠামোর বরাতেই আরঙ্গজেব কর্তৃক দারা শিকোহের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করবার ঘটনার সূত্রে আরঙ্গজেবের ধর্মপরায়নতা কিংবা নিষ্ঠা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং একটা সেকুলার চিন্তাকাঠামোর আলোকে লেখকের এবং অন্যান্য সেকুলার পন্ডিতদের দৃষ্টিতে বিশ্বাস ও কর্মের এই আপাত: সংঘর্ষের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর প্রয়াস পেয়েছেন।

অথছ শরীয়তের বিচারে এখানে কোন অসঙ্গতি (contradiction) নাই। একজন আমীরের নেতৃত্বে মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধ হবার পর শরীয়তের সুস্পষ্ট কারন ছাড়া দ্বিতীয় কোন ব্যক্তির পক্ষ থেকে ক্ষমতার লড়াই শুরু করার প্রচেষ্টা ইসলামে ফাসাদ কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এবং কুরআনে একদিকে যেমন বলা হয়েছে যে অন্যায্যভাবে একজন মানুষের হত্যা সমগ্র মানবতাকে হত্যার সমরুপ অপরাধ তেমনি একথাও বলা হয়েছে যে ফিৎনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা হত্যার চাইতে জঘন্য অপরাধ। এ কারনে প্রমান সাপেক্ষে ফাসাদ সৃষ্টিকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

যেখানে মৃত্যুদন্ডের পূর্বেও দারা শিকোহ আরঙ্গজেবের প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিয়েছিলেন যে আওরঙ্গজেবের স্থলে তিনি থাকলে আওরঙ্গজেবের শরীর চার টুকরো করে শহরের চার কোনে ঝুলিয়ে রাখতেন, সেখানে দারা শিকোহ-কে জীবিত রাখবার কোন সুযোগ ছিলো কি? দারা শিকোহ খোদ রাজধানীতে বসে নিৎশের মতো ওপিয়াম খেয়ে দ্বীন-ই-ইলাহী ওরফে পালংবাদ ওরফে Abraham Accord, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন কপচাতেন, ডিবেট ক্লাব-টকশোর মজমা বসাতেন, আর সময়ে সময়ে যুদ্ধের ময়দানে মুঘল সাম্রাজ্যের কল্যাণে নিজের ঘাম আর রক্ত ঝরাতে থাকা আওরঙ্গজেবের একের পর এক যুদ্ধ জয়ের খবরে হিংসা তাড়িত হয়ে তাকে হত্যা করবার ফন্দি ফিকির করতেন, আততায়ী পাঠাতেন। যা শাহজাহানের নিকট পাঠানো আরঙ্গজেবের অভিযোগপত্র সমূহ থেকে স্পষ্ট। তথাপি আরঙ্গজেব তো ভাইয়ের লাশের অবমাননা করেন নাই। রাজ কবরস্থানে-ই তাকে দাফন করেছিলেন।

এই ঘটনা যেনো উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদের সাথে জেম সুলতানের ক্ষমতার দ্বন্দকে স্মরণ করিয়ে দেয়। জেম সুলতান ক্ষমতার লোভে মত্ত হয়ে নিজের ভাইকে মসনদ থেকে উৎখাতে ক্রুসেডারদের শরনাপন্ন হয়। এবারের সংগম - বলে হুংকার দিয়ে কাফিরের দেশে পৌঁছানোর পর গৃহবন্দী হয়ে পড়েন। ঐ যে আমাদের সাড়া জাগানো বিখ্যাত পঙক্তি:

তুমি-ই গুরুজী নম: নম:
ঘন ঘন।

ক্রুসেডারদের পক্ষ থেকে জেম সুলতানকে সুলতান বায়েজিদের বিরুদ্ধে সহযোগিতা করার লোভ দেখিয়ে গৃহবন্দী করে বায়েজিদের সাথে দেন দরবার করা হয়। কারন তখনও প্রতাপশালী বায়েজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার সামর্থ্য ক্রুসেডারদের ছিলো না। তাই তারা সুলতানের সাথে দেখা করে তার বিদ্রোহী ভাইকে গৃহবন্দী করার খবর জানায় এবং তার নিরাপত্তা ও ভরণপোষণ বাবদ একটা মোটা অংকের বাজেট দাবী করে। পরবর্তীতে নানা ধরনের অন্তর্ঘাতে উসমানীয় সালতানাতের যেসব ঘেঁটু 'উই রিভল্ট' বলে জেম সুলতানের দলে ভিড়েছিলো এক সময় দেখা গেলো তারাই তাকে খেয়ে দেয় এবং নিজেরা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে ধ্বংস প্রাপ্ত হয়।

কিন্তু তাতে কি বায়েজিদ খুশী হয়েছিলেন? নাহ। তিনি অতন্ত্য মর্মাহত হয়েছিলেন। এবং একটা বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ভাইয়ের মরদেহ দেশে এনে রাজ কবরস্থানে দফন করেছিলেন। এসব ঘটনা আমাদের বারংবার উত্থাপিত সেই দাবীকেই প্রমান করে যে সবাই কে নিয়ে মিলেমিশে থাকার বাংলা সিনেমা মার্কা সস্তা আলাপ দেশের জন্য বিপদজনক। বরং এটা উপলব্ধি করা দরকার যে চোরে আর গৃহস্থে একসাথে খেতে পারে না একথা যেমন সত্য তেমনি সকল গৃহস্থদের নিয়ে মিলেমিশে থাকবার জন্য সমাজে নূন্যতম একটা বোঝাপড়া কিংবা সংগঠনের প্রয়োজন হয়।

তারপর ধরুন লেখক বলছেন যে শাহজাহান-কে গৃহবন্দী করে আরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহনের পর তার ক্ষমতার বৈধতা উৎপাদনের নিমিত্তে মক্কার শরীফের নিকট পাঠানো উপঢৌকন যখন প্রত্যাখ্যাত হলো তখন আরঙ্গজেব নাকি মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছিলেন এই বলে যে শাহজাহান তাঁর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। অথচ গৃহবন্দী শাহজাহানের সাথে রাজকার্য বিষয়ে যে আরঙ্গজেব পরামর্শ করতেন এটাতো উক্ত লেখকের কিতাব থেকেই স্পষ্ট। তাহলে কেন এমন মনে হলো না, যে আরঙ্গজেব তার পিতার নিকট তার ক্ষমতা দখলের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পেরেছিলেন এবং শাহজাহান এক পর্যায়ে তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন?

পাঠক, আরঙ্গজেব মিয়ারে হক না। আরঙ্গজবের কর্মকান্ড দিয়ে ইসলামের শরীয়ত নির্ধারিত হয় না। বরং ইসলামের শরীয়ত দিয়েই আরঙ্গজেব সহ তামাম দুনিয়ার বড়ো বড়ো খলিফা, সুলতান, ও রাষ্ট্রনায়কদের কর্মকান্ড ও নীতির যথার্থতা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ আরঙ্গজেবকে ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে একজন ফেরেশতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের লক্ষ্য নয়। আমাদের লক্ষ্য যে বিক্ষিপ্ত সেকুলার মানসের আদলে আরঙ্গজেবের বিচার করা হচ্ছে তার বিরোধীতা। কারন তাতে আর যাই এহসান প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

সুতরাং আরঙ্গজেব যেমন অমুসলিমদের নিকট থেকে খেদমত নিয়েছিলেন তেমনি শরীয়তের আলোকে জাহেদ, মান্না, কিংবা পিনাকী'র মতো ব্যক্তিবর্গদের নিকট থেকেও রাজকার্যে খেদমত নেয়া সম্ভব। কিন্তু যদি তার উল্টোটা হয় অর্থাৎ এরা তাদের সেকুলার মানসের ভিত্তিতে তাড়িত হয়ে মানুব কল্যাণে ব্রত হন তাতে কখন যে তারা আওয়ামী বুদ্ধিজীবি ড. জাফর ইকবালের মতো মানব খেকো, রাষ্ট্রবিনাশী, সমাজ বিধ্বংসী, রাক্ষস হয়ে উঠবেন তা তারা নিজেরাও টের পাবেন না।

Popular posts from this blog

ইসলাম ও গণতন্ত্র

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

জুলাই কাহা-নি