লেজিটিমেসি: বৈধতার সূত্র
বছর খানেক পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছিলাম দেশের মানুষের যতো সমস্যা তার মধ্যে দুটো মৌলিক সমস্যা হলো: আকলগত, চরিত্রগত। বানলাদের আকল কম। এ কারনে সে পড়েও বোঝে না। কদাচিৎ যদিওবা সত্য তার উপলব্ধ হয় তাকে ধারণ করবার মতো, তার ওপর অবিচল থাকবার মতো চারিত্রিক শক্তি তার নেই।
জুলাই পরবর্তী আলোচনা সমূহে আকলগত সমস্যা-টা সবচেয়ে প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে বলে মনে করি। "বিপ্লবী"-দের সমর্থনে গঠিত সরকারের সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন তোলা, "বিপ্লব"-উত্তর প্রক্রিয়াকে পূর্বের কাঠামোর সাথে সংগিতপূর্ণ করবার আইনগত ভিত্তি নিয়ে ভ্রান্তিতে পড়া, "বিপ্লব"-এর মাধ্যমে পরাজিত শক্তির শাস্তি বিধানের আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি নিয়ে অসংলগ্নতা - এসবই বাঙ্গালীর দুরভিসন্ধিমুলক চরিত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধ্যাত্ব ও মানসিক নৈরাজ্যের প্রমাণ।
পাঠক, বৈধতার সূত্রের হিসাব-টি প্রতিষ্ঠিত করা সহজ কর্ম নয়। কারন এই আলোচনার মূলে রয়েছে "উৎসগত" বা "অস্তিত্বগত" প্রশ্ন সমূহ। যেগুলো চরিত্রগত ভাবেই চক্রাকারে আবর্তিত হয়। এর ঈঙ্গিত আমরা পূর্বে দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম বেড়ালের গলায় ঘন্টা পরানোর ধাঁধা উল্লেখের মধ্য দিয়ে। যেমন ধরেন, মানুষ ঘটনাবলী-কে পরিচালিত করে না ঘটনাবলীর ক্রমবিকাশ মানুষের গন্তব্য নির্ধারণ করে দেয় সেই প্রশ্ন। সুপন্ডিত আব্দুল কাদির আস-সুফীর ভাষায়:
Only Camus seemed to suggest that people activated events, while Malraux convinced the body of writers in his time to follow the materialist view that events made men.এজন্য আমরা আমাদের আলোচনা-কে বর্তমান ঘটনাবলীর আলোকে সীমিত ও সুনির্দিষ্ট করবার চেষ্টা করবো। আর যেহেতু বর্তমানের বিভ্রান্তি সমূহ মূলত ক্ষমতা ও বিচারের আইনগত ও নৈতিক ভিত্তি কেন্দ্রিক তাই আমাদের আলোচনার মাধ্যমে এই সম্পর্কিত একটা বোঝাপড়া দাঁড় করাবার চেষ্টা করবো।
এক্ষেত্রে প্রথম কথা হলো ক্ষমতা ও বিচারের বিষয়টি প্রধানত প্রায়োগিক। যদিও একটা নৈতিক ভিত্তি তাকে সর্বজনমান্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা দান করে। এ কারনেই ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মাত্রই শাসক হিসেবে মান্য যদাচিৎ তিনি বা তারা অকাট্যভাবে (কাত'ঈ) খোদাদ্রোহিতায় লিপ্ত হন বা তাতে মুসলিমদের পরিচালিত করেন। এই স্বীকৃতি বাস্তবতার স্বীকৃতি। নৈতিকতার নয়। যদিও নৈতিক (ইসলামী) পদ্ধতিতে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ ও পরিচালনা তার শাসন-কে অধিক মান্যতা, গ্রহণযোগ্যতা দান করে।
মনে করেন খালিদ বিন ওয়ালিদ রা: এবং জেঙ্গিস খান উভয়ে-ই বিশ্বজয়ী বীর ছিলেন। তাঁদের যুদ্ধ জয় তাঁদের ক্ষমতার বাস্তব ভিত্তি বা বৈধতা উৎপাদন করেছিলো। তথাপি নৈতিকতার বিচারে দুই জন সমান ভাবে গৃহীত বরিত হন নাই। ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ রা: এঁর প্রকল্প ছিলো খোদার যমীনে খোদায়ী করা মানুষদের হাত থেকে সাধারণ মানুষদের নিষ্কৃতি। এই কর্মে তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে মেলা। মানুষ মারতে হয়েছে বেশুমার। যারা প্রায় সবাই ময়দানের যোদ্ধা। কিন্তু মানব ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী কাদেসিয়ার ময়দানে জয়ী হবার পর খালিদ রা: পারস্যের শহর-গ্রাম সমূহ জ্বালিয়ে দেন নাই। লুট তরাজ করেন নাই। ধ্বংস যজ্ঞ পরিচালনা করেন নাই। বরং তাকে নতুন নিয়মে ঢেলে সাজিয়েছেন। তার শান-সৌকর্য বৃদ্ধি করেছেন।
এর বিপরীতে জেঙ্গিস তার নিজের ভাষ্যে খোদার আযাব হয়ে এসেছিলেন। শহর-গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। উর্ধ্ব আকাশে যেমন একজন সূর্য দেবতার (এরলি হান) আধিপত্য চলে তদ্রুপ এই মর্ত্যে কেবল এক জেঙ্গিস খানের শাসন চলবে। এই ছিলো তার প্রকল্প। যার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভাবে উপস্থিত ছিলো জিঘাংসাপরায়ণতা। যার কোন নৈতিক ভিত্তি আজ পর্যন্ত কেউ উপস্থাপন করতে পারে নাই। পারা সম্ভব-ও নয়। যদিও শাসন ক্ষমতায় তার জেঁকে বসাটা, তার যুদ্ধজয় সমূহ বাস্তবিক স্বীকৃত।
ঠিক এ কারনেই সকল যুদ্ধ বিজেতা সমান ভাবে বরিত হন না। কারন অনেকেই ক্ষমতার প্রয়োগে সফল হলেও তার নৈতিক ভিত্তি উৎপাদনে ব্যর্থ হন।
আবার ধরুন, কেউ আপনার আত্মীয়-কে খুন করলো। কোরআনের আইন অনুযায়ী খুনের বদলা খুন। তাহলে প্রশ্ন হলো এর মধ্যে আদালত, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করা, সাক্ষী-সাবুদ যোগাড়ের প্রসঙ্গ আসলো কিভাবে? এই আলাপের মজমা হলো এই যে, আপনি যখন আদালত প্রতিষ্ঠা করেন তখন আপনি আপনার প্রতিশোধের পক্ষে নৈতিক ভিত্তি তৈরী করেন। খুনি তো আপনি চেনেন-ই। তার শাস্তিও নির্ধারিত। নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু আপনি যদি এক তরফা ভাবে তাকে হত্যা করেন তবে তার প্রয়োগিক বৈধতা হয়ে গেলো, কিন্তু তার নৈতিক বৈধতা কেবল আপনি ছাড়া আর কারও কাছে স্পষ্ট হলো না।
এ কারনেই গণপিটুনি-তে একজন স্বৈরাচার ও তার চিহ্নিত চ্যালা-চামুন্ডাদের নিহত হবার ঘটনা প্রায়োগিক ও নৈতিক বিচারে আঞ্চলিক পর্যায়ে স্বীকৃত। কারন ঐ অঞ্চলের বাসিন্দারাই তার অপরাধের শিকার হওয়ার মাধ্যমে তার অপরাধ সংঘটনের সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ বা সাক্ষী। তথাপি বৃহত্তর পরিসরে এর স্বীকৃতি পেতে হলে তার নৈতিক ভিত্তিও বৃহত্তর পরিসরে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। যার উপযোগীতা বৃহত্তর পরিসরে স্বীকৃতি পাবার মধ্যেই সীমিত।
তদ্রুপ স্বৈরাচারী সরকার ব্যবস্থা, তার সংবিধান, ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে জনবিদ্রোহের মাধ্যম যখন সেই অপশাসনের বিলোপ ঘটে তার সাথে সাথেই সেই রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সংবিধান তার প্রায়োগিক বৈধতা হারায়। তার কিংবা বিদ্রোহের নৈতিক বৈধতা কালের বিচারে এবং ধর্মের বিচারে যাচাইকৃত হবার অপেক্ষায় থাকে। তাই পূর্বের সংবিধানের সূত্রে জনবিদ্রোহ বা তার পরবর্তী কর্মপ্রণালীর বৈধতা তালাশ করা বিভ্রান্তিপূর্ণ।