বাঘে-হরিণে খানা
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে সে দেশের সফর শেষ করে জামায়াতে ইসলামীর দল দেশে ফিরে যে যৌথ বক্তব্য দিয়েছে তার আমীরের ভাষনের অংশটি পুরোটা দেখলাম। চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের অনুবাদ পাঠ করে শোনানো হলেও তা শ্রুতিগোচর হয়নি। জামায়াতে ইসলামীর উচিত উভয়ের বক্তব্যের শ্রুতলিপি প্রকাশ করা।
মুহতারাম আমীরের বক্তব্যে প্রথম দিকে বিস্মিত হয়েছি। এরপর দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। এরপর আশাণ্বিত হয়েছি। একদম শেষে খুশির চোটে দাঁত বের করে ভেটকি দিয়ে ফেলেছি।
বিস্মিত হয়েছি এ কারনে যে চীন ইতিমধ্যে ঢাবি-তে চীনা কর্ণার প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে। মনে পড়ে গেলো কদিন আগেও বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ কর্ণারের নামে, বাংলাদেশ-ভারত ফ্রেন্ডশীপের নামে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছিলো। স্বাভাবিকভাবেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে আমরা কি কখনো ভারতে বা চীনে বাংলা কর্ণার খুলতে পেরেছি?
পরে মূহুর্ত খানেক চিন্তা করে বেকুব বনে গেলাম। নিজের গালে নিজে চড় মেরে বললাম ওরে বানলা তুই কস কি? এই যে যৌথ বিবৃতির আয়োজন তাতেও আমীর মহোদয়ের বাংলা ভাষণ চীনা ভাষায় রুপান্তরিত করে রাষ্ট্রদূত-কে শোনানোর দুরুহ কাজটি করছেন দৃশ্যত একজন চীনা নাগরিক। তারমানে বানলাদের যেতে হয়নি, চীনারাই বানলা চিনে নেবার কাজ শুরু করে দিয়েছে। আর বানলারা বাসা-কে বালোবেসে বিদেশে কামলা গিরি করে বিদেশী ভাষায় ভুলভাল কথা বলে বাহাদুরী করে যাচ্ছে। এটা সিসিপির আয়োজন হিসেবে যদি ঐ নারী পার্টির কর্মীও হন তথাপি আমি নিশ্চিত চীনা সরকারের পররাষ্ট্র দফতরে এমন বাংলা জানা, বাংলাদেশের নাড়ীর খবর জানা প্রাজ্ঞজন আছেন মেলা। এর বিপরীতে বাংলাদেশের খোদ পররাষ্ট্র দফতরেও যে কুশল বিনিময়ের মতোও দক্ষ কুটনীতিক নাই তা আমি নিশ্চিত।
এরপর কথা হলো চীনাদের যে চোখ ধাঁধাঁনো উন্নতি তাতে শুধু বাংলাদেশ কেনো সবাই তাদের ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু ভিন্নদেশে বাংলা কর্ণার করার মতো আমাদের অর্জন-টা ঠিক কি? তথাপি মুসলমান হিসেবে আমাদের হিসাব দুনিয়া কেন্দ্রিক নয়। তাই আমাদের দুশ্চিন্তা গুলোও ধর্ম নিয়ে। চীনা কর্নার যদি ধর্মহীন কমিউনিস্ট মতবাদ প্রচারে ব্যবহৃত হয় তাহলে তো বিপদ।
এর বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী কি চীনে নিজেদের কর্ণার খুলতে পারবে? আল্লাহর রহমতে কর্ণার খুলবার মতো যথেষ্ট রাজনৈতিক অর্জন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উপাদান তাদের আছে। কিন্তু টেহা নাই। তাছাড়া চীনে তো পার্টি একটাই। তাই চীনা কর্ণার মানেই কমিউনিস্ট পার্টির কর্ণার। কিন্তু বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও তো আরও দল আছে। আমরা সবাই রাজার এদেশের পক্ষ থেকে চীনে বাংলা কর্ণার প্রতিষ্ঠা করা হলে তা কোন রাজার গীত গাইবে?
ঐখানে গিয়ে যদি মুক্তিযুদ্ধ করেন তাইলে তো আপনাদের বাংলা মারা শ্যাষ। কারন ভারতীয় জয়ের গীতিকথা চীনে গিয়ে গাইলে তো হবে না। মারা খাওয়া লাগবে। বুঝেন নাই? না বুঝলে দুদু খান। দুদু খেয়ে মুইতা ভাসায়া দেন। তো কথা হইলো বাঙলামী বাদ দিতে হবে। বাংলা আউট। আউট মানে আউট। চীনে কেনো দুনিয়ার কোথাও বাংলা কর্ণার খুলবার বেইজ্জতি মার্কা কথা বা চিন্তা করা যাবে না। ঠিকাছে?
কিন্তু এই যে আমীর মহোদয় সাদা দিলে আরও কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়েও চীনা কর্ণার খুলবার পরামর্শ দিয়ে আসলেন তাতে মনের ভিত্রে খচখচ করতে আছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ময়লানা বাসানি কবর থেইকা ভেটকি মারতে আছে। হেই ব্যাডা মনে করেন যে মাওবাদী কমিউনিজম কইরা ইঁন্দুরা গান্ধীর কাছে আসামে ছাউথ এশিয়ার বেশট পোলোড ভিক্ষা করেছিলেন। হালায় সেয়ানা মাল। আর আমাদের ইসলাম পন্থী রাজনীতিবিদেরা বিশেষত জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা বিংশ শতকে মুসলমানদের মধ্যে কমিউনিজমের সয়লাবকে রুখে দিতে জান-মাল-সর্বস্ব খোয়ানোর পর এখন কি সে-ই দাওয়াহ বাংলাদেশে যেচে পড়ে নিয়ে আসছেন? আমরা কি তালিবানদের বকাঝকা করে তাঁদের দেখানো পথেই হাঁটছি? অবশ্য তালিবানেরা তাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে চীনা কর্ণার বা এই জাতীয় কিছু খুলেছে কিনা সেটাও জানা প্রয়োজন।
এই দুশ্চিন্তা আরও ঘণীভূত হলো যখন আমীর সাহেব চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস বাতলাতে থাকলেন। যে ইতিহাস তাঁকে বলা হয়েছে সেখানে নিশ্চই তাদের হাতে অগুণিত চীনা নাগরিকদের নিহত হবার ইতিহাস বলা হয়নি। তবে চীনা কর্ণার আশা করি বলবে। এবং তারা বলবে তাদের বয়ানে। বাংলারা যদি বুদ্ধিমান হয় তবে তাদেরও উচিত এই সুযোগ নেয়া। যাতে এই সূত্রে শুধু সিসিপির বয়ানে নয় বরং তাদের বিরোধী সহ সাধারণ চীনাদের সার্বিক বয়ানে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের পাঠ ভালোভাবে নেয়া যায়।
বিশেষত আমীর মহোদয়ের সরকার থেকে সরকারে এবং জনগন থেকে জনগনে সম্পর্ক তৈরীর প্রস্তাবনা এক কথায় চ্যালেঞ্জিং। কারন এতে দেশের মুসলমানদের চীনাদের বিশ্বাস, আচার, আচরণ, সংস্কৃতি প্রভৃতি দিয়ে প্রভাবিত হয়ে পড়বার সম্ভবনা আছে। অবশ্য উল্টোটাও সত্য। তবে আমাদের ধর্মীয় ও জীবন-যাপনের যে মান তাতে উল্টো-টা হবার সুযোগ কম। যদিও এটা ঠিক যে চীনাদের কাছ থেকে দুনিয়াবী ও জ্ঞানগত অনেক কিছুই শিখবার আছে। আরবী প্রবাদে যে বলা হয়, জ্ঞানার্জনের জন্য সুদুর চীনে যাও, তাতো এমনিতে নয়।
সেই সূত্রে বক্তব্যের এই পর্যায়ে এসে আমীর মহোদয় কাজের কথা বলা শুরু করলেন। অর্থাৎ চীনা আলাদিনের প্রদীপ কুন দুকানে কিনতে পাওয়া যাবে - সেই প্রশ্ন। ক্যাবাবে ডাকা সানহাই অয়ে উটতে পারে? ছার! আমাদেরকে কি চুকে আনগুল দিয়ে দেকায় দেবেন? শনদর করে বুজায় বলবেন ক্যাবাবে বরোলুক হওয়া যায়? কিভাবে আমরা বেডারি চালিত বুয়েট ছাট্টিফাইড বদনার বদলে আধুনিক প্রযুক্তির বদনা প্রকৌশল ও নকশার চর্চা করতে পারি? মানে মনে করেন যেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছুঁছে দেয়। ঐটা অবশ্য জাপানের বানানো। তবে জাপানি আর চাইনিজরা তো দ্যাকতে একই রকম এজন্য বললাম আরকি! হেঁ হেঁ।
তো বক্তব্যের শেষে এসে উনি যখন বললেন শি জিনপিং-কে সিসিপি এর পার্টি প্রধান হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আসবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তখন উদ্দীপিত হয়েছি। শি জিনপিং একজন উচ্চ মানের রাষ্ট্র্য নায়ক। তাঁর ব্যাপারে আমার কৌতুহল পুরোনো। তবে চীনা ভাষার চেংচুং বাদে ইংরেজীতে যা আছে তার পুরোটাই চীনের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের প্রপাগান্ডা। এজন্য এ বিষয়ে জানাটা-ই একটা অসাধ্য ব্যাপার। শি জিনপিং যেভাবে দং শাও পিং এর "চীনা ধাঁচের সোশিয়ালিযম" - এর ধারণার সফল বিকাশ ঘটিয়েছেন এটা না হলে আমরা হয়তো সোভিয়েতের মতো চীনেও কমিউনিযমের বিলোপ দেখতাম মাও সে তুং এর মৃত্যুর পর পরই।
যাই হোক বিবৃতি শেষে চীনা রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতি-তে জামায়াতের ইসলামীর নেতা-কর্মীগণ যেভাবে আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে তকবীর দিলেন তাতে খুশীতে কাইন্দালাইসি। আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে চীনের নিজস্ব প্রযুক্তি নির্ভর যে বিস্ময়কর উত্থান সেটা আমাকে বরাবরই কৌতুহলী করেছে। তার সফল প্রয়োগ পদ্ধতি তাদের থেকে শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহ থাকলেও তাদের ধর্মহীন সমাজবাদী ধারণার সাথে ইসলামের সাংঘর্ষিক বিশ্বাসের ব্যাপারটি আমাকে বরাবরই বিহ্বল করেছে। আমার এই উপলব্ধিও হয়েছে যে এর মেলবন্ধনে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ করবার যথেষ্ট সুযোগ আছে।
তবে এমন কথাও প্রচলিত আছে যে চীনারা মানে মেইন ল্যান্ড চাইনিজরা বরাবরই ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে বর্তমান রাজনৈতিক কাঠামোর কাছাকাছি। তারা সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে তাদের ভক্তি প্রকাশ করেন সম্রাটের পুঁজোর মাধ্যমে। এ কারনেই মাও সে তুং এর কিংবা শি জিনপিং এর পক্ষে নয়া অবতার বা খোদা হয়ে ওঠাটা তেমন বিশেষ গুরুত্ববাহী ঘটনা নয়। সত্য-মিথ্যা জানি না।
যদিও এটা সত্য যে আধুনিক চীনা রাষ্ট্র্য বড়ো ধরনের সংঘর্ষ এড়িয়ে চলবার নীতি নিয়েছে। কিংবা তার বয়ানে সে যুদ্ধংদেহী হয়ে ওঠার বাসনা প্রকাশ করছে না। দং শাও পিং এর একটা কথা চালু আছে যে যেদিন চীন একটি আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র্য হয়ে উঠবে সেদিন জগতের সকল মানুষের উচিত হবে সেই রাষ্ট্র্যের বিলোপ সাধনে সক্রিয় হওয়া।
সে যা-ই হোক, ইসলাম সব সময়ই শান্তি-কে প্রাধান্য দিয়েছে। খোদ নবীজি সা: এঁর সময়ে ও তাঁর পরবর্তী খোলাফয়ে রাশিদার সময়ে পারস্য ও রোমীয় শাসকবর্গের সাথে কূটনৈতিক পর্যায়ে যে পরিমাণ দেন দরবার, কথা চালাচালি হয়েছে তা তখনকার তো বটেই বর্তমান সময়ের জন্যও বিরল ঘটনা। অর্থাৎ ওনারাও যুদ্ধ ব্যতীত সমস্যা সমাধানে আগ্রহী ছিলেন বেশী। এর বিপরীতে জেঙ্গিস খান-তো সরাসরি বলেই দিতেন হয় আমার দাস হও নাইলে মরো। আর খালিদ রা: বলতেন, যদি ইসলাম গ্রহণ করো তাহলে তোমরা হবে আমাদের ধর্মের ভাই। তখন আল্লাহর কিতাব আমাদের মধ্যে ফয়সালা করবে। আর না হয় আত্ম-সমর্পন করো। তখন তোমাদের নিরাপত্তা আমাদের জিম্মায়। আর না হয় তরবারী। এমনকি যুদ্ধ শুরু হবার পর ময়দানে নেমে দ্বৈত লড়াইয়ের শুরুতেও ওনারা দাওয়াতে তবলীগের সুযোগ হাতছাড়া করতেন না। যার ফলশ্রুতিতে খালিদ রা: এঁর দাওয়াতে যুদ্ধের ময়দানেই এক পারসিক সেনাপতি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি সেই যুদ্ধেই শাহাদাৎ বরণ করেন।
আমার স্বল্প পাঠে মনে হয়েছে যে কনফুসিয়াস ও লাউ ঝু এঁর মতো চীনা দার্শনিক গণের চিন্তাভাবনা ইসলামের মৌলিক ও দুনিয়ার তাবৎ আদি বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আশা করি জামায়াতে ইসলামীর সংস্পর্শে এসে সিসিপি ইসলাম ধর্মে উজ্জীবিত হবে। উপমহাদেশের মুসলমানরাও চীনাদের সাথে বন্ধুত্বে উপকৃত হবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে বাংলাদেশে সুলতানী আমলের শাসনকালকে তুলনামূলকভাবে স্বাধীন শাসনকাল বলে গন্য করা হয়। অর্থাৎ ঐ সময়টাতে এ অঞ্চলে ভারতীয় আধিপত্য প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। এবং এর পেছনে গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সফল চীন কেন্দ্রিক রাষ্ট্রনীতি-কে উল্লেখ করা হয়। শুনেছি মাও সে তুং মৃত্যু শয্যায়ও নাকি পাকিস্তানের খোঁজ খবর করেছিলেন। এরকম অকৃত্রিম বন্ধু ও শুভাকাঙ্খি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ইসলামের সাথে সিসিপির মেলবন্ধন হয়তো পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা কার্যকর, কল্যাণময়ী অক্ষশক্তির জন্ম দিতেও পারে। জামায়াতে ইসলাম ও সিসিপির মধ্যে বিশ্বাসগত দিক থেকে সাংঘর্ষিক তথাপি ভূরাজনৈতিক বিচারে আবশ্যকীয় এই চ্যালেঞ্জিং সম্পর্কের অগ্রযাত্রার প্রতি শুভ কামনা থাকলো।
যদিও শেষমেষ বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মেলমন্ধন-টা কিভাবে হবে সেই প্রশ্নটা থেকেই যায়। একটা গান আছে এমন:
থাকিলে ডোবাখানা,
হবে কচুরিপানা,
বাঘে হরিণে খানা
একসাথে খাবে না
স্বভাব তো কখনো যাবে না!