বৈধতা উৎপাদনের প্রক্রিয়া

মোটা দাগে দুই প্রক্রিয়ায় বৈধতা উৎপাদিত হয়। এক. বাহুর জোরে দুই. পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে।

বাহুর জোরে উৎপাদিত বৈধতা কেবল বাহুর জোরে টিকিয়ে রাখা যায় না। বরং তাকে টিকিয়ে রাখতে হয় তার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বাহুর জোরে উৎপাদিত বৈধতা যেমন বহুবিধ প্রক্রিয়ায় ঘটে থাকে তেমনি তার ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার ধরনও হয় নানা প্রকারের।

পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বৈধতা তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ। তবে তা যে সব সময় গণতান্ত্রিক এমন নয়।

প্রায়শ যা ঘটে তা হলো বাহুর জোর ও পারস্পরিক বোঝাপড়া এ উভয়ের সংমিশ্রণে বৈধতা উৎপাদিত হয়।

বৈধতা উৎপদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় মানুষ কখনও শুধুমাত্র বাহুর জোরে বৈধতা উৎপাদন করতে গিয়ে ব্যাপক অনর্থ, অনাচার, ও ফাসাদ তৈরী করে। আবার বিপরীত পক্ষে মানুষ পারস্পরিক বোঝাপড়ার চক্রে পড়ে তার উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে বা হারিয়ে ফেলে।

পূর্বে বলেছিলাম বৈধতার ধারণা প্রতিষ্ঠা করা দুষ্কর। কেননা এটা একটি চক্রাকার বিষয়। যে মানদন্ডের ভিত্তিতে কোন বিষয়-কে বৈধ কিংবা অবৈধ বলে ধারণা করা হচ্ছে সেই মানদন্ড প্রতিষ্ঠিত হলো কিভাবে? অর্থাৎ মানদন্ড-ই যে বৈধ তার প্রমাণ কি? কে কাকে বৈধতা দেবে? বৈধতা দেবার সে কে? সে যে বৈধতা দিলো তার প্রমাণ-ই বা কি?

যখন কোন ব্যক্তি নিজেকে আল্লাহ প্রেরিত নবী-রাসুল বলে দাবী করেন তখন তার বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হয় একটি চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। সে-ই প্রক্রিয়ায় মানুষের বিশ্বাস একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। সে-ই বিশ্বাসের ভিত্তিতে কালক্রমে সে-ই ব্যক্তির নবী হবার বৈধতা প্রতিষ্ঠা বা অপনোদন হয়।

এক্ষেত্রে প্রথম বিশ্বাস এই যে আল্লাহ আছেন। দ্বিতীয় বিশ্বাস এই যে তিনি সময়ে সময়ে নবী-রাসূলগণ প্রেরণ করে থাকেন। এই দুটো বিশ্বাস সর্বজনীন বলে ধরে নেয়া হয়। কিংবা এভাবেও বলা যায় যে এই দুটো বিশ্বাস পূর্ব থেকে প্রতিষ্ঠিত থাকলেই তখন কোন ব্যক্তি আল্লাহ প্রেরিত নবী হবার দাবী করতে পারে।

সুতরাং বৈধতার বিষয়টি মানুষের বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। এবং বৈধতার মতো বিশ্বাসও একটি প্রক্রিয়াগত, প্রক্রিয়াজাত বিষয়। গাণিতিক কিংবা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমাণের বিষয় নয়।

কোন ব্যক্তিকে আপনি দীর্ঘকাল ধরে এমনভাবে জানেন যে তার পক্ষে খুন-খারাবি করা সম্ভব নয়। এটা ঐ ব্যক্তির প্রতি আপনার বিশ্বাস। এখন যদি কখনও কেউ এসে বলে যে ঐ ব্যক্তির দ্বারা খুন সংঘটিত হয়েছে আপনার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হবে অবিশ্বাস। কারন আপনি জানেন যে ঐ ব্যক্তি কিছুতেই খুন করবার মতো নয়। এরপর যখন আপনার নিকট ধীরে ধীরে অকাট্য প্রমাণসূমহ উপস্থাপিত হয়ে এক পর্যায়ে ঐ ব্যক্তির দ্বারা খুন হবার বিষয়টি-কে প্রতিষ্ঠিত করে তখনও কিন্তু আপনি মনে মনে ভাবতে থাকেন ঠিক কি কারনে সে খুন করলো? অর্থাৎ ঐ ব্যক্তির নিষ্কলুষতার ব্যাপারে তখনও আপনার বিশ্বাস বিদ্যমান রয়েছে। সে হত্যা করেছে আপনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আপনি এও জানেন যে ঐ ব্যক্তি হত্যাকান্ড সংঘটিত করবার মতো লোক নয়। তখন আপনি এ দুয়ের মধ্যে একটা মেলবন্ধন ঘটাতে চান। নিশ্চই হত্যাকান্ড সংঘটিত করবার মতো অপরাধ ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে করা হয়েছিলো। এভাবে আপনি ঐ ব্যক্তির হত্যাকান্ডের একটা যৌক্তিক ও নৈতিক ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন। এ সবই হয় প্রচ্ছন্ন মানসে। এটাই বিশ্বাস।

বিশ্বাস হঠাৎ করে পয়দা হয় না। বরং ক্রমাণ্বয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও একবার প্রতিষ্ঠিত হবার পর সবসময়ই তা এক অবস্থায় থাকে ব্যাপারটা সেরকম নয়। এর বৃদ্ধি কিংবা ঘাটতি হয়। এবং সেটা ঘটে এই বিশ্বাসের স্বপক্ষে কিংবা বিপক্ষে সংঘটিত ঘটনাবলীর দ্বারা।

আল্লাহর রাসূল সা: এর আগমনের পর তাঁর প্রতি বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত হবার অনেকগুলি কারনের একটি হলো তাঁর নির্দেশের সুফল ভোগ করা। অর্থাৎ উনি যেভাবে যেভাবে আল্লাহর নিকট দোয়া করতে এবং কর্ম প্রচেষ্টা জারি রাখতে শিখিয়েছিলেন তা রপ্ত করার পর যখন মানুষ তার ফল হাতেনাতে পাওয়া শুরু করলো তখন তাদের বিশ্বাস-ও গেলো বেড়ে। কিন্তু কালক্রমে বিধির অমোঘ রীতিতে মুসলমানদের নানা কারনে পতন ঘটা শুরু করলো। এক পর্যায়ে মনে হলো যেনো কোন ধর্মীয় উপদেশই কাজ করছে না। যখন দেখা গেলো তাহাজ্জুদে দোয়া চেয়ে রোগ সারছে না কিন্তু বিজ্ঞানের আবির্ভাবের সূত্রে সুনির্দিষ্ট পথ্যে কিংবা চিকিৎসায় রোগ ভালো হয়ে যাচ্ছে তখন দোয়ার চেয়ে বিজ্ঞানের বৈধতা মানুষের নিকট প্রাধান্য পেলো।

এভাবে যখন বিজ্ঞানের বৈধতা তার প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো তখন মুসলমান বিজ্ঞানের সূত্রে তার ধর্মকে বোঝার চেষ্টা শুরু করলো। কিন্তু সে ভুলে গেলো যে বিজ্ঞান তার প্রায়োগিক বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলেও তার নৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠা তো করতে পারে-ই নি বরং তা প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। কেননা তা কেবল ঐশী বানীর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

এভাবে প্রতিষ্ঠিত বৈধ কাঠামোর সূত্রেও নতুন নতুন বৈধতা উৎপদান করা যায়। যদিও প্রতিষ্ঠিত সেই কাঠামোর বৈধতা নৈতিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। যেমন ধরুন জেঙ্গিস খান বাহুর জোরে নিজের শাসনক্ষমতার বৈধতা উৎপাদন করেছিলেন। যার প্রভাবে তার শাসন সূদুর আনাতোলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলো। কালক্রমে উসমানীয় শাসকদের উত্থানে সেই প্রায়োগিক বৈধতা হ্রাস পেলেও মানব মনে প্রতিষ্ঠিত তাদের বৈধতার ধারণা-টা দীর্ঘদিন থেকে যায়।

যে জেঙ্গিস খান মুসলমানদের অকাতরে খুন করে তাদের দেশে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে-ই জেঙ্গিস খানের পরবর্তী ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত বংশধরেরাই নিজেদের ইসলামের রক্ষাকর্তা শুধু যে দাবী-ই করতেন তা-ই নয় বরং তাদের সেই দাবী অন্য মুসলিম এমনকি ইউরোপীয় শক্তিবর্গের দ্বারাও স্বীকৃত ছিলো। এ কারনেই এমনকি উসমানীয় শাসনকার্যের রীতি (protocol) অনুযায়ী গিরাই রাজবংশের উত্তরসূরী শাসকগন বিবাহ সূত্রে উসমানীয় শাসকদেরও উত্তরাধিকারি হিসেবে গন্য হতেন। এ কারনে গিরাই খান এর পদমর্যাদা উসমানীয় সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর পদ উজিরে আযম অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এরও উপরে ছিলো।

উপমহাদেশেও মোঘলদের আগমণ জেঙ্গিস খানের বংশজাত বাবুরের সূত্রে। এক্ষেত্রে যে বিষয়টা লক্ষ্যণীয় তা হলো জেঙ্গিসের সূত্রে মোঘল শাসকগণ তাদের শাসনের পক্ষে যেই বৈধতা উৎপাদন করতে চেয়েছেন তা ছিলো প্রায়োগিক। অর্থাৎ তারা প্রচ্ছন্ন ভাবে এই দাবী-ই করেছিলেন যে জেঙ্গিসের মতোই তারাও যুদ্ধজয়ে পারঙ্গম। কিন্তু তাদের শাসনের ভিত্তিমূল সেটা ছিলো না। বরং তা ছিলো ইসলামের সূত্রে নৈতিক বৈধতা। তা না হলে জেঙ্গিস যেভাবে খুলির পাহার তৈরী করে রাজ্যজয় ও শাসন করেছিলেন মুঘলদেরও তা-ই করতে হতো এই উপমহাদেশে। যা ঐতিহাসিকভাবেই ঘটেনি।

এই পার্থক্য-টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মোঘলদের শাসন যেভাবে উম্মতের মধ্যে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে জেঙ্গিস খানের বংশধরের দাবীদার তৈমুর লং এর শাসন সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কারন তৈমুরের শাসনের বলতে গেলে পুরোটাই ছিলো বাহুর জোরের ওপর প্রতিষ্ঠিত। মানবহত্যায় সে জেঙ্গিস খান-কেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। যার অধিকাংশই ছিলো মুসলিম। তথাপি সে একই সাথে নিজেকে জেঙ্গিসের বৈধ উত্তরাধিকারী এবং ইসলামের তরবারী বলে ঘোষণা করতো। প্রথমটা তার নৃশংসতার কারনে মানুষ মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয়টা তথাকথিত তিমুরী সভ্যতা, তাদের শিল্প, নির্মাণকৌশল ইত্যাদি, দিয়েও জনপ্রিয় করা যায় নাই।

এভাবে দেখা যাচ্ছে বাহুর জোরে কিংবা প্রয়োগের সফলতায় বৈধতা প্রতিষ্ঠা পেলেও তাকে কেবলমাত্র নৈতিক বৈধতা-ই টিকিয়ে রাখতে পারে। কিংবা সর্বজনীনতা দিতে পারে। এ কারনেই এই একবিংশ শতকে এসে বিজ্ঞানের অনৈতিক অপব্যবহারের সূত্রে সে-ও তার বৈধতা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে। এবং তার বিপরীতে আবার ঐশী বাণীর ভিত্তিতে, ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে নৈতিক বৈধতার প্রাধান্য স্বীকৃতি পাচ্ছে।

সেক্ষেত্রে যুগের চ্যালেঞ্জ হলো নৈতিক বৈধতা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অনন্যতা মানুষের নিকট তুলে ধরা। কেননা বিগত কয়েক শতক খোদাদ্রোহীতা, ধর্মদ্রোহীতায় কাটিয়ে মানুষ এখন ধর্মমুখি হচ্ছে বটে কিন্তু ধর্মের নৈতিক বৈধতা যে ঐশী সূত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন এটা তারা, বিশেষত অমুলিমেরা কিংবা ধর্মহীন নাম মাত্র মুসলমানেরা, উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটা বিপদজনক। বিজ্ঞানের মতোই, এটাও এক পর্যায়ে তাদের সর্বনাশ করবে, হতাশ করবে।

Popular posts from this blog

অত্রাঞ্চলে আমি-ই রাষ্ট্র্য, আমি-ই তার পতি

জুলাই কাহা-নি

The Case for Rohingyas