রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ-দের পেছনের গল্প

সেনা সমর্থিত এক-এগারোর সরকারের একটা বেশিষ্ট্য ছিলো প্রধানত রাজনীতিবিদদেরই দুর্নীতিবাজ গন্য করে প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানো। তবে এদের পক্ষে বৈধতা উৎপাদনের কাজ শুরু হয়েছিলো জোট সরকারের আমল থেকেই। তখন থেকেই মূলত পঁচন আলো ও দিল্লী স্টার বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণের প্রকল্প হাতে নেয়। এখানে মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবের দুরদৃষ্টিতা লক্ষ্যণীয়। ওনার শেষ সাক্ষাৎকারে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামিস্ট অক্ষশক্তির মেলবন্ধনে বাংলাদেশ বিরোধী শক্তিসমূহের মধ্যে অবশ্যম্ভাবী পরিণতির আতংক থেকে উৎসারিত তীব্র প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি উঠে এসেছিলো।

জাতীয়তাবাদী ও ইসলামিস্ট শক্তিসমূহের সমণ্বিত সয়লাব প্রতিহত করবার উপায় ছিলো তিনটা:

এক. এই মৈত্রীর মধ্যে ভাঙ্গণ সৃষ্টি
দুই. মুক্তিযুদ্ধের সূত্রে আওমীলীগের হাত ধরে ভারতীয় আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা
তিন. বিরাজনীতিকরণ

এ কারনেই এক-এগারোর সরকারের প্রথম দিকে শহুরে লোক কিংবা বামবাদী তাত্ত্বিকদের ভাষায় শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যাপক জনসমর্থন ছিলো। এই তত্ত্বের অসারতার কথা আগেও বলেছি। আবারও বলি। এই তত্ত্বের অপনোদন এর ব্যাখ্যাতেই নিহিত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোন ধরণের এজেন্সি বা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং তারা দাবার ঘুঁটি হিসেবে পরিগণিত হয় মাত্র। এ কারনেই এক-এগারোর ও জুলাইয়ের পরিবর্তণে তাদের একটা ভূমিকা থাকলেও তার গতিবিধি নির্ধারণে তার কোন এজেন্সি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নাই। কারন আদপে সেটার অস্তিত্ব-ই ছিলোনা।

এক-এগারো সরকারের কুশীলবদের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো এই বয়ান প্রতিষ্ঠা করা যে দেশের এই দুরাবস্থা মূলত রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির জন্য। তাই বিশেষত শহুর মধ্যবিত্ত শ্রেণী কিংবা বলা চলে লেফাফা দুরস্ত গৃহপালিত শ্রেণীর নিকট এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো যে রাজনীতিবিদরাই দুর্নীতিবাজ। কিন্তু কেউ এই প্রশ্ন করলো না, যে তাহলে এর সমাধান কি? কারন এর সমাধানের আলাপ-টি ইচ্ছাকৃতভাবেই উহ্য রাখা হয়েছে কিংবা সুকৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। না হলে কেনো বিগত দেড় যুগে একজনও প্রশ্ন করলো না যে এই দুরাবস্থার সমাধান কি বিরাজনীতিকরণ কিনা? যদি না হয় তাহলে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিবাজ হয়ে ওঠা থেকে কি করে রক্ষা করা যায়?

তথাপি আমরা দেখেছি হুদা-সাখাওয়াতের নির্বাচন কমিশন এর মাধ্যমে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবার একটা প্রচ্ছন্ন প্রয়াস। যার পদ্ধতিগত প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতিবিদদের ও রাজনৈতিক দলসমূহের যোগ্যতার অব্যাখ্যাত, অনৈতিক, ও অযৌক্তিক সব মানদন্ড নির্ধারণের মাধ্যমে। আমি সেই সব দৃশ্য ভুলি নাই যখন এক-এগারোর কুশীলবদের এই দুই ঘেঁটুপুত্র বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিবিদদের ডেকে বিচিত্র সব মুখভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি ও আচরণ প্রকাশ করছিলো। মনে হচ্ছিলো যেনো কমিশন অফিসে বিএনপির আগমন একটা উৎকট ঝামেলা বিশেষ। আর জামাত? ছোঁ! ছোঁ! ব্রাহ্মণের ঘরে শূদ্রের অশুচি। এই ছিলো এদের "আবেগ-অনুভূতির উর্ধ্বে উঠিয়া" কাজ করবার বহি:প্রকাশ।

আজকের আমার কলম ধরবার উদ্দেশ্য মূলত দুইটা। দুইটা ক্ষেত্রেই আমি এক ধরনের থট এক্সপেরিমেন্ট এর মধ্য দিয়ে যাবো। বাস্তবতা বোঝার সুবিধার্তে এর একটা কল্পিত-সরলীকৃত মানসিক কাঠামো তৈরী করে তার ভিত্তিতে কিছু বিষয় তুলে ধরবো।

কিন্তু তার আগে একটা বিষয়ে বোঝাপড়া চাই। আর তা হলো এই বুঝ যে মানুষকে সাধারণত যেমন প্রশিক্ষিত করে তোলা যায় তেমনি মানুষ প্রায়শ কিছু প্রকৃতিগত বিষয় নিয়ে জন্মায়। এ কারনেই দেখা যায় রাজনীতিবিদদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বেশ উদ্যোগী এবং প্রচন্ড রকমের প্রতিবাদী প্রকৃতির। এটাই তাদের চরিত্র বিশেষ। যে বিষয়টাকে তিনি অন্যায়, অবিচার বলে গণ্য করছেন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া তার স্বভাবজাত। রাজনীতিবিদদের গুণাবলির আরেকটা হলো পরোপোকারী মানসিকতা। যেচে পড়ে অন্যের পক্ষে কথা বলা, অন্যের সমস্যা সমাধান করা, কারও বিপদে দৌড়ে যাওয়া। বাংলা-তে একে বলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো।

এটা এমন বিষয় যে তার ব্যাপারে ঐ ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা দুরুহ। কেননা এটাই তার খাসালত। এ কারনে দেখা যায় তাকে, তার পরিবারকে বিড়ম্মনা থেকে নিপীড়নের শিকার পর্যন্ত হতে হয়। এবং এই প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে তিনি নিজেও হয়তো নিজের ওপর হতাশ হয়ে পড়েন, আত্ম-বিতৃষ্ণায় ভোগেন। কারন তিনি চাইলেও তার এই স্বভাবকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এটা স্বতস্ফূর্তভাবে তার নিকট থেকে প্রকাশ পায়। কিন্তু এর ফল তাকে সহ তার পরিবারকেও ভোগ করতে হয়। বিতৃষ্ণার জায়গাটা এখানেই।

আর এখান থেকে তৈরী হতে থাকে তার মানসিক অধ:পতন। কারন তার এই উন্নত গুণাবলী ধারণ করা কিংবা এর উৎকর্ষসাধনের কোন প্রক্রিয়া সমাজে কিংবা রাষ্ট্র্যে অনুপস্থিত। ফলশ্রুতিতে সবাই তার মহৎ গুণাবলীর সুবিধাভোগী হলেও তার স্বীকৃতি কেউ দেয়া না। বরং তার বিপদেও কেউ এগিয়ে আসে না। যে ছেলেটি তারুণ্যের উচ্ছাসে পাড়ার মাস্তানদের থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে আসে তার নিরাপত্তাবিধানের চিন্তা-টা কিন্তু সাধারণ মানুষ ভাবে না। আবার না বুঝে সে যদি কখনো একজন নিপীড়ককে নিপীড়িত ভেবে তার পক্ষে ওকালতি করে বসে তখন পদ্ধতিগত ব্যর্থতার চিন্তা কারও মাথায় আসেনা বরং আসে তাকে এক তরফা দোষারোপের প্রবণতা।

তেমনি ভাবে মনে করুন একজন তরুন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট। যিনি সদ্য একটি চাকুরীতে অংশ নিয়েছেন। তার কাজ হলো প্রতিষ্ঠানে আগত ক্লায়েন্টদের:

১। ফর্ম প্রদান
২। ক্লায়েন্ট কর্তৃক পূরণকৃত ফর্ম যাচাই পূর্বক জমাকরন।

লক্ষ্য করুন। ফর্ম পুরণ করা তার কর্তব্য নয়। এখন দেখা গেলো তার নিকট আগত ক্লায়েন্টদের অধিকাংশই অশিক্ষিত মূর্খ। আর তাই সে এটাকে খেদমতে খালক বিবেচনা করে সেই সব মূর্খদের ফর্ম পূরন করে জমা দিতে থাকলো। কিন্তু তার পার্শ্ববর্তী কাবিলটা তাকে নিয়ে টিকাটিপ্পনী কাটে। তাকে বেকুব ঠাওরায়। কেননা এই সুযোগে সে নিজস্ব কামাইয়ের একটা ধান্ধা তৈরী করেছে। এভাবে এক পর্যায়ে দেখা গেলো যে লোকটি নিবেদিত প্রাণ হয়ে মাগনা কাজ করেন অশিক্ষিত লোকেরা তার নিকটই আসে বেশী। কিন্তু বাড়তি কাজের চাপে সে নিজের কাজটাই ঠিকমতো শেষ করতে পারেনা। ফলত: একদিকে তার অশিক্ষিত ক্লায়েন্টরা তার বিরুদ্ধে ঠিকমতো কাজ না করার অভিযোগ করে, যে কাজটা তার করার কথা ছিলোনা, অপরদিকে তার উর্ধ্বতনরা তার কাজের সক্ষমতায় অসন্তুষ্ট। এই অবস্থায় এক পর্যায়ে সে তার পাশে বসা কাবিলটার আবিষ্কৃত অনৈতিক ব্যবস্থার নিকট পরাজয় বরন করতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশে দুর্বৃত্তায়নের এটাই মূল সূত্র। কেনন এই ব্যর্থতা পদ্ধতিগত ব্যর্থতা। পদ্ধতিগত এই ব্যর্থতাও অনেক ক্ষেত্রে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের সীমাহীন লোভ থেকে উৎসারিত। উপনিবেশোত্তর এই দেশে আইন করা হয় যেনো এক শ্রেনীর আমলারা জনগনকে আইনের ফাঁদে ফেলে, হাইকোর্ট দেখিয়ে তাদের অবৈধ সুযোগ সুবিধা, অর্থ উপার্জনের রাস্তা চালু রাখতে পারে।

তবে সামরিক বাহিনীর দুর্নীতির রুপ আরও প্রচ্ছন্ন। এর প্রকাশ বাহিনীর কর্তাদের বিশ্ববিদ্যালয়, বড়ো বড়ো রেষ্টুরেন্ট সহ নানা প্রকার রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যে ভাগ বসানোর মধ্যে। যা আইনগত ভাবে হয়তো অবৈধ নয় বরং এই গোটা বন্দোবস্তের নৈতিক ভিত্তি-ই প্রশ্নবিদ্ধ।

লক্ষ্য করুন পাকিস্তানের যে ভুট্টো না খেয়ে পারমানবিক বোমা বানাবার লোকভোলানো অপরাজীনতি করেছে তার পরিবারের কাউকে কিন্তু না খেয়ে থাকাতে হয়নি। বরং এদের বেড়ে ওঠা উপনিবেশবাদীদের দেশেই। লড়াই-টা তাহলে কাদের বিরুদ্ধে? এরপর আরও এই যে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর উর্ধতনকর্তারা ভারতের সমূহ আগ্রাসনের বিপরীতে অস্তিত্বের হুমকির বয়ানের ফাঁক ফোকরে নিজেরা মেলা সম্পদ কুক্ষিগত করেছেন বলে প্রতিষ্ঠিত। কিংবা তা না হলেও সমাজও রাষ্ট্র্য থেকে তাদের সুবিধা গ্রহণের পর্যায়টি দৃষ্টিকটু বলেই বহুজনে প্রতিষ্ঠিত। তথাপি আজও সেই একই পারমানবিক শক্তিধর দেশ পাকিস্তানে বৈদ্যুতের সংকট বিদ্যমান।

এ অবস্থায় বিশেষ করে যখন ধনী-দরিদ্রদের বৈষম্য দিন দিন আশংকাজনক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। এবং তার বিপরীতে সম্পদ কুক্ষীগত হয়ে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে, যাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারী চাকুরীর সূত্রে প্রতিষ্ঠিত, সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র রাজনীতিবিদদের দোষারোপের খেলাটা মূলত কাদের তা বুঝতে কি কাবিল হওয়া লাগে?

Popular posts from this blog

অত্রাঞ্চলে আমি-ই রাষ্ট্র্য, আমি-ই তার পতি

জুলাই কাহা-নি

The Case for Rohingyas