ক্ষমতা ও সম্পদ
ক্ষমতার সাথে সম্পদের একটা সম্পর্ক আছে। ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের যেমন সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তদ্রুপ সম্পদাশালী ব্যক্তিদের একটা ক্ষমতা তৈরী হয়। এটা ঐতিহাসিক সত্য।
ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়া মৌলিক ভাবে সমস্যা জনক নয়। সমস্যা জনক যখন তা অন্যায্য ভাবে বৃদ্ধি পায়। কিংবা বৃদ্ধি পাওয়া সম্পদের অন্যায্য ব্যবহার হয়।
ক্ষমতার চর্চা একটি বিশেষ কর্ম। এর জন্য বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। তা আহরণ একটি জটিল প্রক্রিয়া। ক্ষমতা লব্ধ করবার বিষয়টি-ও সরলরৈখিক নয়। এ কারনে ক্ষমতাসীন শাসকের উপার্জনের বিষয়টিও জটিল। ঠিক কতোটুকু সম্পদ আহরণ তার জন্য নৈতিক এই বিষয়টি এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত।
ইসলাম এর সমাধান করেছে শাসকদের ধর্মানুরাগী করবার মধ্য দিয়ে। এ কারনেই আব্দুল কাদির আস-সুফী ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত আসাবিয়্যাদের দ্বারা ক্ষমতা গ্রহণের প্রকল্প তুলে ধরেছেন। যা জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম ভাতৃসংঘ সহ মোটামুটি সকল ইসলামপন্থীদেরও প্রকল্প বটে।
এই প্রকল্পে শাসক মূলত একজন কৃচ্ছসাধক। যে কারনে পার্থিব সম্পদ তাঁকে কলুষিত করতে পারেনা। কিন্তু এই ব্যাপারটি সরলভাবে দেখবার সুযোগ নেই। কেননা সম্পদের সাথে ক্ষমতার একটি সহযোগ আছে। যা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। সুতরাং সম্পদ ব্যতিরেকে শুধুমাত্র কৃচ্ছসাধণার মাধ্যমে শাসন ক্ষমতার সফল পরিচালনা সম্ভব নয়।
এ কারনেই ইসলামের ইতিসহাসে দেখা যায় সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম শাসকেরা কৃচ্চতা অবলম্বনকারী হলেও সম্পদের ওপর তাদের ছিলো প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য। এই বিষয়টা উপলব্ধি করা প্রয়োজন।
এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ ওমর ইবনে খাত্তাব রা:। যিনি অর্ধ পৃথিবী শাসন করেছিলেন। তথাপি তাঁর পরনে থাকতো জোড়াতালি দেয়া পোশাক। যে সালাহ উদ্দিন আইয়ূবী রহ: মধ্য প্রচ্য ও আফ্রিকায় বিরাট অংশ শাসন করে গিয়েছিলেন তাঁর জানাযায় অর্থ লগ্নি করতে হয়েছিলো। যে ওমর ইবনে আব্দুল আযিয রহ: যিনি দ্বিতীয় ওমর হিসেবে সুপরিচিত মৃত্যুর পর তাঁকে তাঁর পরনের জীর্ণ শীর্ণ পোশাকেই দাফন দেয়া হয়। যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমান গাজী তাঁর মৃত্যুর পর তৎপুত্র ওরহান গাজী দেখতে পান যে রাষ্ট্রীয় টাকাশাল পরিপূর্ণ হলেও পারিবারিক টাকশাল শূন্য।
কিন্তু জোড়াতালি পোশাকই এর একমাত্র বহি:প্রকাশ নয়। বরং এ বহি:প্রকাশ উসমানীয় কিংবা মুঘলদের মতো জাঁকজমকপূর্ণও হতে পারে। আওরঙ্গজেব আলমগীরের রাষ্ট্রীয় শান-শওকত, শৌর্যের বিপরীতে ব্যক্তি জীবনে তাঁর কৃচ্ছতা, টুপি সেলাই ও কুরআন লিখনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের রীতি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ওসমান গাজী পরবর্তী ওরহান গাজীর পারিবারিক সম্পত্তি বৃদ্ধির দিকে উদ্যোগ নেয়াও তার প্রমাণ।
বর্তমান জাতি রাষ্ট্র্যের ধারনায় একজন শাসক-কে অন্যান্য চাকুরের মতো নিছক একজন চাকুরিজীবি হিসেবে গণ্য করে তার চাকুরী সুযোগ-সুবিধা ও বেতন ধরা এবং ঐসব সুযোগ সুবিধার মধ্যেই তার সীমিত থাকার বিচারে তাঁর সততা গণ্য করা হয়। এটা একটা ভয়াবহ ভ্রান্তি।
কেননা এর মধ্য দিয়ে মূলত তার শাসন করার ক্ষমতা-কে খর্ব করা হয়। এ কারনেই আমরা দেখতে পাই জাতিরাষ্ট্র্যে গণতান্ত্রিক কিংবা অন্যান্য পদ্ধতি-তে উত্তম মানুষ বলে বিবেচিত লোকেরাও ক্ষমতায় গিয়ে অকার্যকর নপুংশক হিসেবে গণ্য হন। কারন পদায়ন ক্ষমতার একটা আনুষ্ঠানিক প্রকাশ মাত্র। পদায়নই ক্ষমতায়ন নয়।
ক্ষমতা চর্চার একটা বড়ো অংশ নির্ভর করে সম্পদে আধিপত্যের ওপর। এমনকি বাহুবল কিংবা সশস্ত্র বাহিনী তৈরীর বিষয়টি-ও সম্পদের ওপর আধিপত্য ও তার বন্টনের ওপর নির্ভরশীল। এ কারনেই জামায়াতে ইসলামীর আমির তাঁদের মহাসমাবেশে যখন বললেন যে ক্ষমতায় গেলে তাঁদের দলের এমপি-রা সরকার থেকে কোন জমি প্রভৃতি সুযোগ সুবিধাদি নেবে না - তখন বিষয়টি ভাবনায় ফেলে দেয়। দেশের বাস্তবতায় সরকারী চাকুরীর সূত্রে দেশ ভক্ষণের যে প্রবণতা তাতে তাকে সমর্থন দিতে মন চায়। একই সাথে সম্পদ পরীক্ষিত ঈমানদার শ্রেণীর হাতে না গেলে যে অনর্থ সংঘটিত হতে পারে গত তিপ্পান্ন বছরে বাঁদীর বাচ্চাদের অভিজাত হয়ে ওঠার সেই দু:সহ অভিজ্ঞতা আমীর মহোদয়ের এই প্রস্তাবনায় বাধ সাধে।
আমরা যদি চীনের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই এর বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর বেতন বাইশ হাজার মার্কিন ডলারের মতো। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রে তার করায়ত্ব সম্পদ সাতশো মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত শোনা যায়। সত্য হোক মিথ্যা হোক চীনের সম্পদের ওপর সিসিপি ও তার পার্টি প্রধানের আধিপত্য স্বীকৃত।
এ কারনেই মাও যে দং এর মৃত্যুর পর সম্পদের নুতন বন্টনের নীতিমালা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিলো। দং শাও পিং যখন চীনের অর্থনীতিকে পুঁজিবাদী কায়দায় উন্মুক্ত করে দেন তখন তার একটা পরামর্শ ছিলো এই যে যদি দেখা যায় এই উদার অর্থনীতি ধনী ও দরিদ্রের মাঝে বৈষম্য কেবল বৃদ্ধি করেছে, সম্পদ মুষ্টিমেয় শ্রেনীর নিকট কুক্ষিগত করেছে তাহলে বুঝতে হবে যে চীনা পদ্ধতিতে মার্কসবাদ এর বাস্তবায়নের প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে।
ঠিক এই বিষয়টি-ই শি জিনপিং তাঁর ক্ষমতায়নের পর উপলব্ধি করে এই অর্থনৈতিক উদারতার লাগাম টেনে ধরেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আলিবাবার মতো বৃহৎ চীনা কোম্পানী গুলো-কে পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিলো। জ্যাক মা পাশ্চাত্যীয় ধাঁচে চীনা অর্থনীতিকে যেদিকে নিয়ে যাবার কূটপরিকল্পনা করেছিলেন শি জিনপিং তার থেকে সেই ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার মাধ্যমে চীনা অর্থনীতির গতিপথ পরিবর্তন করে দেন।
লক্ষ্য করুন এটা সম্ভব হয়েছে কেবল বাহু জোরে নয়। বরং চীনা সম্পত্তির ওপর সিসিপির একচ্ছত্র আধিপত্যের বরাতে। এখন জামায়াতে ইসলাম যদি তাঁদের পরীক্ষিত কর্মী বাহিনীর সম্পদায়ন এবং সশস্ত্রায়নের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা কেবল ডিপ স্টেটের ঘুঁটি হিসেবেই ব্যবহৃত হতে পারে। সেক্ষেত্রে জাতির প্রয়োজনে ডিপ স্টেটের টুঁটি চিপে ধরবার সামর্থ্য সে কোন কালেই অর্জন করবে না।
তবে সম্পদের ওপর, বাহুবলের ওপর তাদের অধিকার, আধিপত্য, ঘুরেফিরে তাদেরই জালিম বানিয়ে দেবে কিনা তার নিশ্চয়তা তো দেয়া সম্ভব নয়। আর সেই চিন্তার প্রয়োজন-ও নাই। আমাদের শুধু দেখতে হবে একজন মানুষ, একটি গোষ্ঠী তাদের এ যাবৎ কর্মকান্ডের বিচারে শাসন ক্ষমতা পাবার উপযুক্ত কিনা। যদি উপযুক্ত মনে করা হয় তবে তাদের ক্ষমতায়নের জন্য সর্ববিধ প্রচেষ্টা চালানো-ই বাঞ্চনীয়।
সবশেষে এই কথাও বলা প্রয়োজন যে গরীবের, মেহনতি মানুষের যে সম্পদায়ন, ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়, এটাও কিন্তু কালক্রমে বিগড়ে যেতে পরে। যার একটা লক্ষণ আমরা বিগত মাফিয়া সরকারের আমলে দেখেছি। দরিদ্র, মেহনতি শ্রেণীর মানুষ তাদের উপার্জিত সামষ্টিক বিপুল অর্থ জুয়া সহ নানা আকাজ-কুকাজে নষ্ট করেছে। এবং এটা যে শাসক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ মদদে হয়েছিলো তার লক্ষণ আমরা দেখতে পেয়েছিলাম সামাজিক ডিজিটাল মাধ্যম গুলোতে জুয়ার বিজ্ঞাপনের আধিক্যে। যে ব্যাপারে সরকারের নীরবতাই তার যোগসাজশের প্রমাণ। সুতরাং গরীবদের উন্নয়ন হলেই যে তা কল্যাণ বলে আনবে তারও নিশ্চয়তা নাই। শাসক শ্রেণী সম্পদের লোভে পড়ে যেমন অনিষ্ট সাধন করতে পারে, তা দরিদ্র শ্রেণীর আর্থিক উত্তোরণের মাধ্যমেও হতে পারে।