জামায়াতে ইসলামীর মহাসমাবেশ এবং একটি নীরব বিপ্লব
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সাহেব গতকাল বললেন যে তিনি অভিজাত শ্রেনীর প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত হন নাই বরং আপামর সংগ্রামী মানুষের অধিকার আদায়ে একজন লড়াকু যোদ্ধা হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি বিশেষ করে খেটে খাওয়া দিন-মজুর শ্রেনীর মানুষদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। যারা তা লক্ষ্য করেছেন, আমি মোটামুটি নিশ্চিত, তাদের প্রায় কেউই এর গভীরতা টের পান নাই।
আমার জানামতে জামায়াতের ইসলামীর বর্তমান আমির ডা. শফিক সাহেব একজন অভিজাত শ্রেনীর মানুষ। অর্থাৎ অর্থ-বিত্ত সহায় সম্পত্তির হিসেবে তিনি বিত্তবানদের কাতারে পড়েন। তথাপি তিনি খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এমনকি নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলতেও তিনি প্রস্তুত সে-ই ঘোষণা উচ্চকিত করেছেন। বিপ্লবের সূচনা-টা এখানেই।
আর এ কারনেই যখন গত বছর জুলাইয়ের দৈব-দুর্বিপাকে সাধিত পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেয়াল লিখন করা হয়েছিলো এই বলে যে, এমন একটি বাংলাদেশ চাই যেখানে একজন রিকশা অলার সন্তানও দেশের ফদাংমনতি হবার স্বপ্ন দেখতে পারবে, তখন আমরা সে-ই বিপ্লবের অন্তর্সারশূ্ণ্যতা অনুধাবন করেছি। আরে মিয়া! ধর্মহীন-হীনজাত থেকে অকস্মাৎ অভিজাত হয়ে ওঠাদের বাংলাদেশ-ই তো তোমাদের গিলে খেতে চেয়েছিলো। গত তিপ্পান্ন বছরে যে বান্দীর পোলাদের "আপওয়ার্ড মোবিলিটি" হয়েছে সেই সব ডাবল ইসটান করা, বিসিএস-আইএসএসবি দেয়া ইসমাট কুলাঙ্গারেরাই তো তোমাদের গুম-খুন করেছে। জুলাইয়ের দৈব-দুর্বিপাকের সূত্রে তাদের-ই পোঁদে লাথি মেরে যখন তোমরা আবার তাদেরই জায়গা দখল করবার ইরাদা প্রদর্শন করো তখন তো সেটা আর বিপ্লব থাকেনা। হয়ে যায় নতুন বোতলে পুরনো মদ।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানে একজন "চাষার পোলার" গভর্নর হয়ে ওঠার সময়-ই কি আমরা দেশের ইতিহাসের সর্ব নিকৃষ্ট অব্যস্থাপনা, লুটতরাজ দেখতে পাইনি? সুতরাং তোমাদের এই শ্রমজীবি শ্রেনী-কে কেন্দ্র করে বামবাদী আষাঢ়ে, অসৎ উদ্দেশ্য তাড়িত আলাপে আমাদের আগ্রহ নাই। বরং এই যে নিম্ন আয়ের শ্রেনীর মানুষদের মধ্যে একটা সর্বনাশা ধারণার প্রচলন করা হয়েছে যে গরিবের কোন দোষ নাই। থাক। গরিব মানুষ! মাফ কইরা দেন। এই কুফরী আলাপের ভয়াবহতা আমরা জানি। এইটা একটা ইবলিশি বন্দোবস্ত। এইটা মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে অপরাজনীতির চর্চার আরেকটা বহি:প্রকাশ মাত্র।
যখন সাহাবা রা: আজমাঈন ক্ষুধার তাড়নায় অতিষ্ট হয়ে পেটে পাথর বেঁধে নবীজি সা: এর নিকট গিয়ে তাদের দুরাবস্থার কথা জানালেন তখন নবীজি সা: তাঁর পেটের দুইপাশে বাধা দুইটা পাথর তাঁর সাহাবা গণকে দেখালেন। অর্থাৎ সত্যের সংগ্রামে নবীজির ত্যাগ আর সকলের থেকে বেশী বই কম ছিলো না। এটাই মুসলিম শাসকদের রীতি।
এর মধ্য দিয়ে মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করার অপ-রাজনীতির অসারতা প্রমাণ হলো। কারন রোজ হাশরে শুধু ধনীদের বিচার হবে তা নয়। বিচার দরিদ্রদেরও হবে। সবার-ই হবে। সুতরাং ভিকটিম সেজে অপরাজনীতি করার সুযোগ কোন মুসলমানের নাই। আর না থাকার কারনেই সে ধনী হোক দরিদ্র হোক তাকে আল্লাহর বন্দেগির ফিকির করতে হয় সর্বাবস্থায়। তখন সে উপলব্ধি করে যে দিনে দিনে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের যে বিশাল ফারাক তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তার মূলে রয়েছে এই খোদাদ্রোহীতা। ধনীরা জাকাত দিচ্ছে না। হালাল উপার্জনে ব্রত হচ্ছে না। বিভিন্ন কায়দায় সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিষ্ঠিত ও চর্চিত মাফিয়াতন্ত্রের কারনে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বৃদ্ধি হচ্ছে না। ফলত: এক শ্রেনীর মানুষ দারিদ্রের গ্যাড়াকলে নিষ্পেষিত হয়ে ধর্ম-চরিত্র সব হারিয়ে হারাম উপার্জনের সে-ই দুষ্টচক্রে ঢুকে পড়ছে। চুরি-চামারি করে বেড়াচ্ছে। সম্পদশালীরাও তাদের তষ্কর স্বভাবের অজুহাতে তাদের প্রাপ্য ঠিকমতো পরিশোধ করছে না। এভাবে কুফর কিংবা অবিশ্বাসের বিষ ছড়িয়ে পড়ার ফলে দেশ ও সমাজ ক্রমাগত খোদার গজবের পানে ধেয়ে যাচ্ছে।
সমাজে ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত এরকম নানবিধ দুষ্টচক্র ভাঙ্গবার একমাত্র উপায় হলো দ্বীন ইসলামের জ্ঞান ও চর্চার প্রসার। তখন প্রত্যেক ব্যক্তি আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার সূত্রে শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে চলতে উদ্যত হবেন। দেশের উচ্চশিক্ষিতরা তাদের মূর্খতা, ধর্মে অজ্ঞানতা নিয়ে সচেতন হবেন। আলাপ তুলবেন। ধনীরা সম্পদ আহরণের প্রতি তাদের সীমাহীন লালসার বিরুদ্ধাচারণ করবেন। দরিদ্ররা এমন সব বন্দোবস্তের অংশীদার হতে অস্বীকার করবে যা তাদের চরিত্রকে, ঈমানকে ধ্বংস করে দেয়। শাসকেরা শাসনের নামে শোষণে প্রবৃত্ত হবার বিরোধিতা করবেন। বিচারকেরা বিচারকার্যের অনৈতিক ভিত্তি সমূহের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হবেন। এটাই প্রকৃত বিপ্লব।
এই বিপ্লবের সূচনা হয়েছে ঈমানের খাতিরে ডা শফিক সাহেবের জাত্যাভিমান থেকে বের হয়ে আসবার ঘোষণা থেকে। লক্ষ্য করুন তিনি নিজেও একজন "কৃষকের" সন্তান। অর্থাৎ তাঁরও "আপওয়ার্ড মোবলিটি" হয়েছে। কিন্তু সেটা সার্থকতা পেয়েছে ঈমানের সূত্রে। ইসলামের শিক্ষায়। এভাবে তিনি ইসলামী কায়দার, ইসলামের ঐতিহ্যবাহী অভিজাত হয়ে উঠেছেন। যতোদিন তিনি ঈমানের বলে বলীয়ান থাকবেন ততোদিন তাঁর এই "কৃষক"-এর সন্তান হিসেবে পরিচিতি এই অঞ্চলে তাঁর শক্ত শেকড়ের স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু যারাই ঈমান হারা হবে তারাই "চাষার পোলা" হিসেবে ভর্ৎসনার স্বীকার হবে। তাদের "আপওয়ার্ড মোবিলিটি" তাদের ও তাদের দেশের জন্য অভিশাপ বয়ে আনবে।
পার্থক্য-টা এখানেই। হিসাব-টা এখানেই। বিপ্লব-টা এখানেই।