প্রসঙ্গ: প্রস্তর নিক্ষেপ
এটা সত্য যে রাজনৈতিক ভাষণ প্রদানের উত্তেজনতায় ও প্রগলভতায় প্রতিটি শব্দ সুচিন্তিতভাবে উচ্চারিত হয় না। তথাপি ভাষণের মূলভাবে জীবন ও বাস্তবতার একটা গভীর বোঝাপড়ার প্রতিফলন হওয়া চাই। আওয়ামী জাহেলিয়াতের পর জাতিয়তাবাদী প্রস্তর যুগের আগমনের শংকায় ভীত হয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু নেতৃস্থানীয় পর্যায় থেকে এমন কোন বক্তব্য দেয়া উচিত নয় যাতে নেতার দুরদৃষ্টি ও জ্ঞানের গভীরতা প্রশ্নের সম্মুখিন হয়।
যেমন পাথর মেরে হত্যার ঘটনায় অনিসলামী শিক্ষা ও শাসন ব্যবস্থার দায়ের বিষয়টি সামনে আসেনি। না আলোচিত হয়েছে বিচারিক অব্যবস্থার প্রসঙ্গ। কিন্তু এমন অনেক কথা হয়েছে যা ভ্রান্তিপূর্ণ। তার মধ্যে একটি হলো খোদ পাথর মেরে হত্যার বিষয়টি-কে নিন্দনীয় করে তোলা। মোটা দাগে এটা দুই কারনে সমস্যা জনক। একটা ধর্মীয়। আরেকটা প্রায়োগিক।
ধর্মীয় কারন-টা সকলের জ্ঞাত। ইসলাম ধর্ম মতে বিবাহিত ব্যভিচারি ও ব্যভিচারিনী উভয়ের শাস্তি প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যা। অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে এ শাস্তি ৮০ বার বেত্রাঘাত। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের একটি হলো হজ্জব্রত পালন করা। যাতে শয়তানের প্রতি প্রস্তর নিক্ষেপে মুসলমানদের উৎসাহিত করা হয়। যদি তা-ই হয় তাহলে কোন মুসলমানের পক্ষে প্রস্তর নিক্ষেপে হত্যার বিষয়টি-কে নিন্দনীয় করে তুলবার সুযোগ থাকে?
প্রায়োগিক বিষয়টার দুটি দিক। একটা হলো ফৌজদারি অপরাধের শাস্তির বিধান সংক্রান্ত। আরেকটি হলো সেই শাস্তি কার্যকর করবার চারিত্রিক ও মানসিক দৃঢ়তা সংক্রান্ত। Criminal Jurisprudence এ আলোচিত সমস্ত শাস্তি-ই কোন না কোন বিচারে নৃশংস। সেক্ষেত্রে অহিংস পদ্ধতি-তে অর্থাৎ এক গালে চড় খেয়ে আরেক গাল পেতে দেবার রীতির ওপর যদি কখনও কোন রাষ্ট্র্য প্রতিষ্ঠিত হয় কেবল মাত্র তখনই নৃশংসতা উপযোগীতা কিংবা নৈতিক ভিত্তিক হারাতে পারে। তা না হলে কেবল মাত্র বিগত অর্ধশতক বৎসর যাবৎ পাশ্চাত্যের চিন্তাধারা কেন্দ্রিক মানবিক শাস্তি কিংবা মানবিক নৃশংসতার বাতুলতা কেবল বানলা বুদ্ধিজীবিদের পক্ষেই করা সম্ভব।
প্রাণহানি ও অঙ্গ কর্তন সংক্রান্ত শাস্তিসমূহ-কে নৃশংস ও অমানবিক সাব্যস্ত করে গঠিত পাশ্চাত্যের (অ-) সভ্যতা সমূহে আজ তাই প্রতি চার জন নাগরিকের একজন কয়েদীর জীবন যাপন করছেন। বাকি তিন জন মুক্ত বাতাসে বসে হা-পিত্যেস করছেন এই বলে যে সরকার বাহাদুর কয়েদিদের কয়েক বেলা খানা নিশ্চিত করতে পারে বটে কিন্তু সভ্য নাগরিকের কর্মের তথা খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর তাই অপরাধ সংঘটন পূর্বক জেলখানায় গমনের মাধ্যমে অন্নের সংস্থান করা ছাড়া উপায় কি?
সুতরাং পাথর মেরে হত্যার বিষয়টি মূল সমস্যা নয়। মূল সমস্যা হলো লোক ক্ষেপানোর অপরাজনীতি। যে রাজনীতি শেখ মুজিব ও তার বামবাদী কমরেডদের দ্বারা এই বঙ্গে বিস্তার লাভ করেছে। যে রাজনীতির সূত্রে তৎকালীন ছাত্র সংঘের আব্দুল মালেকের মতো নিরীহ ছাত্রতো বটে বিরোধী মতের স্পিকারকে পর্যন্ত খোদ সংসদে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। যে রাজনীতির সূত্রে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত অবাঙ্গালীদের হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে একাত্তরের পটভূমি তৈরী করা হয়।
মূল সমস্যা হলো একটি মুসলিম প্রধান জনগোষ্ঠীর ওপর গায়রে ইসলামের হুকুমত চাপিয়ে দেয়া। সুপরিকল্পিত ভাবে মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে, মুসলিম উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। মুসলমানের সন্তানদেরকে ধর্মহীন করে তোলার শিক্ষা অব্যবস্থা। মুসলমানের দানে প্রতিষ্ঠিত, মুসলিমদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে, যেখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থী মুসলিম, সেই সকল স্থানে ইসলামী তাহযীব-তমদ্দুন বিরোধী পরিবেশ গড়ে তোলা। মুসলিম শিক্ষার্থীদের ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা না দিয়ে তাদের মধ্যে ন্যায়-অন্যায় বোধের বিকাশকে রহিত করে দেয়া। এক কথায় মুসলিম মানস-কে ধর্মহীন করে তোলা-টাই মূল সমস্যা।
মনে রাখবেন, জালিমদের প্রতি রহমত করা, মজলুমদের প্রতি জুলুমের নামান্তর। সুতরাং পাথর অবশ্যই মারতে হবে। জালিমদের ওপর অবশ্যই চড়াও হতে হবে। তবে তার আগে জুলুম ও জালিম উভয়কেই চিহ্নিত করতে হবে। এরপর তার অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারন পূর্বক জনসমক্ষে তার শাস্তি কার্যকর করতে হবে। তা চাই বেত্রাঘাত হোক, প্রস্তর নিক্ষেপ হোক। এটা এজন্য যেনো এ দৃশ্য অবলোকনে সবার অন্তরে যেনো জুলুম ও খোদাদ্রোহীতার পরিণতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জিত হয়। মানুষের অন্তরে তার প্রতি ঘৃণা তৈরী হয়। মানুষ তার সংঘটনে ভীত হয়ে ওঠে।