মধ্যমপন্থা সমাচার
বাংলাদেশে ইসলামপন্থাকে ডানপন্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বিষয়টি আমাদের চিন্তাজগতকে এতোটাই গ্রাস করেছে যে ইসলামপন্থীরাও নিজেদের ডানপন্থী ভাবেন। আমরাও লেখার সময় অবচেতন ভাবে ইসলামপন্থীদের ডানপন্থী ধরে নিয়েই বাতচিত করি।
অথচ ইসলামপন্থীদের ডানপন্থী ধরে নিলে এটাও স্বীকার করে নিতে হয় যে ইসলাম বা ইসলামপন্থীরা কোন একটা কিছুর ডানে অবস্থিত। যেটা ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা ইসলামতো ইসলামের জায়গায়ই আছে। এবং সেই জায়গায়-ই তার থাকা-কে আমরা মেনে নিয়েছি বলেই আমরা নিজেদের মুসলিম দাবী করি। কিন্তু যখন ইসলামপন্থীদের ডানপন্থী হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয় তখন পরোক্ষভাবে ইসলামকে গায়রে ইসলামের ভিত্তিতে বিচার করবার অবিচারটাও মেনে নেয়া হয়।
কেননা তখন আমাদের মনোজগতে গায়রে ইসলাম হয়ে ওঠে মধ্যমণি। তার ভিত্তিতে কাউকে তার ডানে আবার কাউকে তার বামে বিবেচনা করা হয়। অথচ কথা ছিলো ইসলাম-ই হবে মুসলমানদের মনোজগতের মধ্যমণি। ইসলামের ভিত্তিতে গায়রে ইসলামের কাউকে ডানে কাউকে বামে বিবেচনা করা হবে। আর বিবেচনার মাপকাঠিতে ইসলাম-ই থাকবে একমাত্র পরিপূর্ণরুপে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে। দাঁড়িপাল্লার একবারে কেন্দ্রে। মধ্যমণি। আর শরীয়ত দাঁড়িপাল্লার কাঁটার মতো আর সবার সেই মধ্যমণির সাপেক্ষে ডান বা বাম দিকে ঝুঁকে পড়াকে সাব্যস্থ করবে।
এ কারনে আমি মনে করি উপমাহদেশে জামায়াতে ইসলামী ও মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ভাতৃসংঘ-ই আদর্শরুপে একমাত্র মধ্যমপন্থী রাজনৈতিক দল। কারন তারা জিহাদ করছে কিন্তু কথায় কথায় কিতালের ডাক দিচ্ছে না। তারা মুসলমানদের ঐতিহাসিক সুফী চর্চার বা আত্মশুদ্ধির ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে তথাপি সুফীবাদের বিকৃতিতে জড়িয়ে পড়ছে না। তারা শুদ্ধিবাদী সালাফী কিংবা ওহাবী চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে মুসলামনদের মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কার ও অপবিশ্বাস সমূহের অপনোদনে প্রচেষ্ট হচ্ছে। তথাপি ইসলাম চর্চার ইতিহ্যবাহী চিন্তাধারা তথা মযহাব বিরোধী হয়ে ওঠেনি। তারা শিয়াদের ঐতিহাসিক বিকৃতি ও বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপারে সজাগ থেকেই শিয়া, সুন্নী সহ মুসলানদের সকল গ্রহণযোগ্য ধর্মীয় উপদল সমূহকে এক রাজনৈতিক অক্ষশক্তিতে রুপান্তর করতে চাচ্ছে। মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করবার এই প্রয়াসে তারা কাদিয়ানীদের মতো ধর্মছুট সম্প্রদায়গুলোকে গুলিয়ে ফেলবার বিভ্রান্তেও জড়িয়ে পড়ছে না।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর মধ্যমপন্থার রাজনীতির একটা খুব ভালো উদাহরণ দেয়া যায়। আর তা হলো মাওলানা
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রহ: এঁর এই ঐতিহাসিক ফতোয়া যে, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীরা কাফের। লক্ষ্য করুন তারা কিন্তু বলছে না যে আওমীলীগের লোকেরা কাফের। মূর্খ ও কপটেরা হয়তো এটাকে জামাতের ধর্ম নিয়ে রাজনীতির অংশ হিসেবে দেখতে ও সমালোচনা করতে পারে। তা করুক। কেবল মূর্খ-ই মূর্খের কথায় কর্ণপাত করে। এক কপটের সাথে কেবল আরেক কপটের-ই বনিবনা হতে পারে। চোরে চোরে মাস্তুতো ভাই।
কিন্তু প্রজ্ঞাবান মুসলমান মাত্রই এই ফতোয়ার গভীরতা ও তাৎপর্য স্বীকার করবেন। কাফেরদের দ্বারা দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষনের একটা ফল হলো এই যে মুসলমান আর মুসলমান নাই। নামে আছে, চিন্তায় বা কর্মে নাই। যে কারনে একজন মুসলমান নামধারীর পক্ষেও সেকুলারিজম বা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার বয়ান হাজির করা সম্ভব হয়। যা কিনা সুস্পষ্ট কুফরী।
এখানেই আর দশটা ধর্মীয় সংস্কারবাদী দলের সাথে জামাতের পার্থক্য। ওহাবীরা মুসলমানের বিকৃত তওহীদের ধারণাকে সংস্কার করতে যেয়ে তাদের নিজেদের তওহীদের ধারণাকেই সংকুচিত করে ফেলেছে। শুধু তাই নয় বরং তাদের এই সংকুচিত ধারণার ভিত্তিতে তাবৎ মুসলিম উম্মাহ-কে ইসলাম ধর্ম থেকে খারিজ করে দিয়েছে। ফলে ওহাবীদের জন্য অন্য মুসলিমের রক্ত আর কাফিরদের রক্তের মধ্যে কোন ফারাক থাকেনি। যা অসংখ্য সাম্প্রদায়িক বিভাজন, বিদ্বেষ, ও রক্তপাত সংঘটিত করেছে। অনেক অনাচারের জন্ম দিয়েছে।
কিন্তু জামাত ও ভাতৃসংঘ এর মতো সংস্কারবাদী দলগুলোর একটা মৌলিক বোঝাপড়া ছিলো এই যে যদিও মুসলমান নামধারীদের একটা বড়ো অংশ আদপে আর মুসলমান নাই তথাপি তাদের মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করেই দরদের সাথে, উত্তম পন্থায় তাদের সংস্কার ও সংশোধন করতে হবে। এর পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ হলো সেই হাদিস যেখানে মুসলমানেরা যুদ্ধের ময়দানের কঠোর পরিস্থিতিতে কাফেরদের আক্রমণ করতে উদ্যত হলেই তাদের কেউ কেউ কালিমা উচ্চারণ করে বসতো। মনে হতো যেনো সে মুসলিম হয়ে গিয়েছে। ফলে তার রক্ত ঝরানো আর বৈধ থাকতোনা। কিন্তু তাকে ছেড়ে দেয়া হলেই সে আবার কাফেরদের পক্ষে গিয়ে যুদ্ধে শামিল হয়ে যেতো। এভাবে এক পর্যায়ে কোন এক কাফেরকে কালিমা উচ্চারণের পরও আর ছাড় না দিয়ে তার কল্লা উঠিয়ে দেয়া হলো।
এই ঘটনার বিবরণ শুনে আঁ হযরত তাঁর ঐ প্রিয় সাহাবী রা: কে তাঁর এই কর্মের জন্য জেরা করলে উনি বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে সেই লোক আসলে ইসলাম গ্রহণ করেনি। নিজের জান বাঁচাবার জন্যই সে এ কাজ করেছিলো। তখন নবীজি সা: বারবার তাকে এই প্রশ্ন শুধোতে থাকলেন যে, তুমি কি তার কলব চিড়ে এই সত্য উদ্ঘাটন করেছিলে? পরবর্তীতে ঐ সাহাবী মন্তব্য করেন যে, ঐদিন যদি তিনি ইসলাম গ্রহণ করতেন তাহলে তা তাঁর জন্য কল্যাণকর হতো। অর্থাৎ তাঁর দ্বারা সংঘটিত ঐ কর্মে তিনি এতোটাই লজ্জিত ও অনুতপ্ত ছিলেন যে তাঁর মনে হয়েছিলো কাফের জীবন থেকে ইসলামে প্রবেশ করলে যেমন অতীতের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায় উনি যদি সেই সুযোগ আবার পেতেন তাহলে তা তাঁর জন্য ভালো হতো।
তাহলে দেখা যাচ্ছে একজন বিশ্বাসীর মর্যাদা মহান আল্লাহর কাছে কতোটুকু! যে কারও মধ্যে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান অবশিষ্ট থাকলেও মহান আল্লাহ কোন না কোন সময় তাকে জাহান্নামের অগ্নিকুন্ড থেকে বের করে নিয়ে আসবেন। কাজেই কারও মধ্যে ঈমান অবশিষ্ট থাকবার নূন্যতম সম্ভাবনা থাকলেও তাকে মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষত তার রক্ত ঝরানোর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করাই বাঞ্ছনীয়।
ঠিক এ কারনেই হাসিনা ও আওয়ামীলীগ জামায়াতে ইসলামের সর্বস্তরের নেতা কর্মীদের ব্যাপক হারে গুম-খুন ও নির্যাতন করার পরও আজ পর্যন্ত জামাতের পক্ষ থেকে কখনও হাসিনা কাফের ফতোয়া দেয়া হয় নাই। আওয়ামী লীগের ওপর ঢালাও ভবে তকফির আরোপ করা হয় নাই। তথাপি তাদের যে ফতোয়া, যে ব্যাপারে ইসলামের জায়গীর নেয়া কওমীদের তেমন একটা উচ্চবাচ্চ দেখা যায় না, যে ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীরা কাফের, এটা কিন্তু জারী থাকছেই। কারন এটাই ধর্মত সংগত। এটাই ধর্মের মত। এই ফতোয়ার মধ্য দিয়ে তারা মুসলিমদের মধ্যে এ সংক্রান্ত বিভ্রান্তি দুর করতে চাচ্ছে। সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে চাচ্ছে। যেনো মুসলমানরা একই সাথে ধর্মের অনুসারী ও ধর্ম নিরপেক্ষ হবার অসারতা ও এই ধরনের সাংঘর্ষিক চিন্তাধারার ব্যাপারে সজাগ হয়ে উঠতে পারে।
পাঠক মধ্যমপন্থার আলাপ দেয়া সহজ। কিন্তু সেই পথে চলা কঠিন। জামাত তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সেই কঠিন পথে চলে এসেছে। এখন একজন মুসলিম হিসেবে জামাত বাদ দিয়ে অন্যদের মধ্যে মধ্যমপন্থা তালাশ করার যৌক্তিকতা কতোটুকু?