কি? হিংসে হয়?
২০১১-১২ সালের দিকে ফেসবুকে প্রায়শ একটা ডায়ালগ দেখতাম, 'কি? হিংসে হয়'? তখন ভেবেছিলাম এটা সোশাল মিডিয়ায় চাউর হওয়া একটা সাময়িক ডায়ালগ। কিন্তু এর মনস্তাত্তিক গভীরতা বুঝতে আমার পাক্কা পাঁচ থেকে সাত বছর লেগেছে। কারন বাংলাদের মতো এরকম জটিল ও কুটিল মনস্তত্তের অধিকারী আমি নই।
যেদিন এই ডায়ালগের মর্মার্থ উপলব্ধি করলাম, আতঙ্কিত হলাম। একটা বাংলা ভালো আছে। সুখে আছে। কিন্তু সে জানে তার এই ভালো থাকা, সুখে থাকার কথা বাংলাস্থানের জংলীগুলো জানতে পারলে তাদের গাত্র দাহ হবে। হোগা জ্বলবে। তাকে খোঁটা দিবে। টিকা টিপ্পনী কাটবে। চোগলখুরী করে তার মনটা বিষিয়ে দিবে।
এখন এটা উপলব্ধি করার পর একজন সাধারন মানুষ কি করবে? সে তার সুখের খবর, ভালো থাকার খরব চেপে যাবে। আড়াল করবে। উপরন্তু তার মতো অন্যেরাও যেনো ভালো থাকতে পারে, সুখী জীবন যাপন করতে পারে সে জন্য সচেষ্ট হবে। তাদের জন্য দোয়া করবে। নিজের সাধ্য অনুযায়ী তাদের উপকার করার চেষ্টা করবে।
কিন্তু এরা তো জয় বাংলা! হাজার বছরের নিম্ন বর্ণের হিন্দু়। শূদ্রের পয়দা থেকে তারা এই সেদিন সুযোগ বুঝে ম্লেচ্ছো সেজেছে। ক্রিস্টোফার ল্যাশ এর ভাষায় "আপওয়ার্ড মোবিলিটি" আরকি! তো সে করবে কি, তার ভালো থাকার খবর রস লাগিয়ে, অতিরঞ্জিত করে প্রচার করবে। সে তার সুখী জীবনের সেল্ফি দিবে, ভিডিও দিবে। তার ওপর ক্যাপশন দিবে, 'কি? হিংসে হয়'? এরপর তার সুখে অন্য বাংলাগুলোর হিংসায় জ্বলে যাওয়া কল্পনা করে সে একটা পৈশাচিক আনন্দ পাবে। এটাই হয়ে উঠবে তার জীবনে বেঁচে থাকবার প্রেরণা।
এখন কথা হলো একটা বিষয় আছে যাকে বলে প্রতিশোধ স্পৃহা। সাধারনভাবে এটা ভালো জিনিস নয়। তবে এটা বাস্তব। যখন আপনাকে কেউ অপদস্থ করবে, আপনার ক্ষতি করবে, আপনার চলার পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করবে, তখন আপনার মনে একটা ক্ষোভের সঞ্চার হবে। এরপর যদি ঐ বক্তিকে মহান আল্লাহ জায়গা মতো খেয়ে দেন তখন তা আপনার মনে প্রশান্তি এনে দিতেই পারে।
কিংবা মনে করেন আপনার বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজন আপনাকে বললো যে আপনি কখনোই ডেরাইবার হতে পারবেন না। এখন আপনি ডেরাইবার হিসেবে জীবনে সফলতা অর্জনের পর সব সময় আপনার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজনের বাসার সামনে ডেরাইবিং করে গাড়ী ঘোরাতেই পারেন।
কিংবা ধরেন জীবন যুদ্ধে আপনি পরাজিত। হতভগ্ন। হতাশাগ্রস্থ। এখন আপনার সফল বন্ধুটি যখন রসিয়ে আপনাকে তার সফলতার গল্প শোনায়, বলে যে সে যেখানেই হাত দেয় সোনা ফলে। কিংবা ভাগ্য সব সময়ই তার ওপর সুপ্রসন্ন হয়। তখণ আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগতেই পারে যে ভাগ্য আপনার ওপ সুপ্রসন্ন হচ্ছেনা কেনো?
কিংবা মনে করেন আপনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। কারও কোন ক্ষতি করা দুরে থাক, তার চিন্তাও আপনার মাথায় আসেনি। কিন্তু আপনারই আশেপাশের ইবলিশ গুলো সফলতার শীর্ষে উঠে রাতারাতি একবারে বোজর্গ সেজে গেলো। তখন আপনি তা মেনে নিতে না-ই পারেন।
কিন্তু একজন মানুষ যার সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নাই, যাকে আপনি চেনেন না, বা চেনাজানা হলেও যে কখনও আপনার কোন ক্ষতি করেনি তার শনৈ উন্নতিতে আপনার হোগা জ্বলবে কেনো? এই যে বিশিষ্ট আওমী মুহাদ্দিস মাননীয় এমপি মমতাজ ভুটকি গান গাইলো,
বন্ধু যখন বউ লইয়া, আমার বাড়ীর সামনে দিয়া, রঙ্গ কইরা হাঁইটা যায়, ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়।
কথা হলো আপনার বন্ধু কেনো স্বাভাবিক ভাবে না হেঁটে, "রঙ্গ কইরা" হাঁইটা গেলো। সেও কি আপনার মতোই একটা খাঁটি বাংলা? দ্বিতীয়ত তার বউ নিয়ে হেঁটে যাওয়া দেখে কেনো আপনার বুক ফেটে যাচ্ছে? আপনিও বিয়ে করে ফেললেই পারেন?
আসলে আমারই বুঝের ঘাটতি! কারন বাংলার হিসাব আলাদা। অন্যের সফলতা দেখে, উন্নতি দেখে, বাঙ্গালী হা-হুতাশ করবে এটাই নিয়ম। তার কথা হলো মানুষ সফল হবে কেনো? মানুষ ব্যর্থ হবে। তা না- হলে সে কিভাবে ঐ ব্যর্থ মানুষটার প্রতি করুনা প্রদর্শন করবে? তার দু:খে ফিচফিচ করে কাঁদবে। বলবে, "আহারে! তুক, তুক। কত্তো বালো মানুষ"। তখন অনেক বাঙ্গলামী হবে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সম্ভ্রান্ত, মানবতা, সমাজ এগুলো হবে।
এদেশে সফল মানুষ কখনোই ভালো মানুষ হতে পারেনা। ভালো মানুষ হতে হলে ব্যর্থ হতে হয়। এর একটা কারন বোধ করি এদেশে সাধারনত সফল তারাই হয় যারা অন্যকে ল্যাঙ মারায় পারদর্শী। যারা পরের ধনে পোদ্দারীতে পারদর্শী। যারা প্রতারক ও কৃতঘ্ন বিশেষ। বাংলা তাদেরই। যেহেতু তারা সবাইকে ল্যাঙ্গ মেরে উপরে উঠেছে, সেহেতু তারা ধরেই নেয় সবাই তাদের খেয়ে দেবার জন্য প্রস্তুত। তাই সেও চায় তার উন্নতিতে, তার সুখে বাকীরা জ্বলতে থাকুক। এজন্যই সে তার সুখের, সফলতার গাল-গপ্পো ছড়ায়। ফেসবুকে সেল্ফি দিয়ে জিজ্ঞেস করে:
কি? হিংসে হয়?