ভাতৃসংঘ থেকে আল-শারা: কিভাবে?

বিপ্লবোত্তর সিরিয়ার রাজনৈতিক ময়দানে মুসলিম ভাতৃসংঘের মতো পুরনো, ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতির বিষয়টা অনেক দিন ধরেই ভাবাচ্ছিলো। ভাতৃসংঘ বর্তমান ক্রান্তিকালীন বিপ্লবী সরকারেরও অংশ এবং একথা চালু আছে যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আহমাদ আল-শারা সিরিয়ার ভাতৃসংঘের বৃহত্তর অংশের সমর্থন আদায়ে ব্যাপক ভাবে সচেষ্ট। প্রশ্ন হলো ভাতৃসংঘের মতো এতো বড়ো দল কি করে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়লো। অবশ্য এই প্রশ্নের যথার্থতা নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলতে পারেন যারা আহমাদ আল-শারাকে ভাতৃসংঘের বৃহত্তর প্রভাব বলয়ের ফসল হিসেবেই গণ্য করতে চান। কিন্তু এই সব প্রায়োগিক খুঁটিনাটি এড়িয়ে গিয়ে মোটা দাগে এই প্রশ্ন তো করাই যায় যে আহমাদ আল-শারার নেতৃত্বে এই বিজয় ভাতৃসংঘের দাওয়াত ও তরবিয়্যাতের রাজনৈতিক প্রকল্প থেকে বেরিয়ে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম-কে প্রাধান্য দেয়ার মরহুম আইমান আল-জাওয়াহিরির প্রস্তাবনাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। এর বিপরীতে এই পাল্টা যুুক্তিও দেয়া যায় যে আহমাদ আল-শারার সফলতার বীজ বাপিত হয়েছিলো যেদিন তিনি আল-কায়েদার সাথে সমস্ত রকমের সাংগঠনিক সম্পর্কের ইতি টেনেছিলেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে সংগ্রামের পথ কখনো এক রৈখিক নয়। বরং অধিকাংশ সময়-ই তারা বিচিত্র পথে ঘুরপাক খেয়ে, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে একটা পরিণতি লাভ করে। এ কারনে একাঙ্গিক চিন্তা-কাঠামো এ ধরনের সংগ্রামকে পূর্ণাঙ্গভাবে ধারন করতে ব্যর্থ হয়। এর সাথে যদি বিশ্বাসগত ফারাক বা বৈষম্য থাকে তাহলেতো আরও বিপদ। ঠিক এই প্রতিকুলতাই উম্মাহ প্রকল্পের আলাপ-কে করে তুলে আরও জটিল ও দুর্বোধ্য। ঠিক এ কারনেই আমি বহুবার উসমানীয় ও মোগল ইতিহাস চর্চা করতে যেয়েও ফিরে গিয়েছি। ঠিক এ কারনেই এমন কি আমাদের জীবদ্দশায় সংঘটিত যুদ্ধ সমূহের স্বরুপ সন্ধানে হতে হয় গলদঘর্ম। কারন এনরেজীতে যারা এর বর্ণন করেন, বয়ান নির্মাণ করেন, ইতিহাস রচনা করেন তারা সকলেই আক্রমণকারী বিজয়ী শক্তি পক্ষ। এ যেন কর্নওয়ালিস থেকে নবাব সিরাজের চারিত্রিক সনদ তালাশ করা। ব্যাপার-টা যে ভাষাগত এমনও নয়। কারন আরবী ভাষায় যে ব্যাপক ভাবে এইসব সাম্প্রতিক ইতিহাস নির্মিত ও চর্চিত হয়েছে তা-ও নয়। অবশ্য যেখানে জান বাঁচানো দুষ্কর সেখানে ইতিহাস চর্চা আবার কি? এই বাঙ্গলার ঔপনিবেশিক দু:শাসনের সুদীর্ঘ সময়টাতে বিজিত মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে ইতিহাস চর্চার, রচনার অনুপস্থিতি - তার কারনও এটিই। মোটে জান বাঁচে না, কিতাব লেখার ফুসরত কই? এই যে প্রাচ্যবিদদের উত্থান এটা হতে পেরেছে এই শূন্যস্থানকে কেন্দ্র করেই। সুপন্ডিত ড. উমর ফারুক আবদুল্লাহকে যখন কিছু ইতিহাসের বইয়ের নামোল্লেখ করতে বলা হয়েছিলো উনি উত্তরে এই পরামর্শ-ই দিয়েছিলেন যে মুসলমানদেরকে নিজেদের ইতিহাস রচনায় পূর্ণ উদ্যমে মনোনিবেশ করতে হবে। তা না হলে আফগানিস্থান, ইরাক, ও সিরিয়ার যুদ্ধ সমূহের মতো ইতিহাসের দখল চলে যাবে অমুসলিমদের হাতে। ইতিহাস নির্মিত হবে বিজয়ীর দৃষ্টিতে। তার অসঙ্গতিগুলোও কুৎসিতভাবে প্রকাশ ভাবে। তবে ইতিহাস যে সব সময় বিজয়ীর দৃষ্টিতে নির্মিত হয় ব্যাপারটা সত্য নয়। মুসলিম বিজয়ের স্বর্ণযুগেও মুসলিম ইতিহাসবিদেরা বিজিত জাতির বর্ণনায় যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছিলেন তা ইসলামের সর্বজনীন সৌন্দর্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে। সে যাক। সিরিয়ার ভাতৃসংঘের পরিণতি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে যেয়ে পাশ্চাত্যের এক কাবিলের একটা প্রবন্ধ পেলাম। যথারীতি বৈসাদৃশ্যে পরিপূর্ণ হলেও অনেক তথ্য আছে যা জানা ছিলো না। একথা উপলব্ধি করা কঠিন নয় যে আসাদ শাসকগোষ্ঠীর গণহত্যা ও নিপীড়নের ফলে সিরিয়ার ভাতৃসংঘের নেতারা দেশান্তরি হয়ে পড়লে ক্রমেই তাদের জায়গা নিয়ে নেয় অন্যান্য ধর্মীয়-রাজনৈতিক-সশস্ত্র গোষ্ঠী সমূহ। এ প্রবন্ধের ব্যাপারে অনেক কিছু বলবার ছিলো। কিন্তু ইচ্ছাটা হারিয়ে ফেলেছি। তথাপি সংক্ষেপে কিছু ব্যাপার উল্লেখ করছি:

১। প্রাবন্ধিকের মতে সিরিয়ান ভাতৃসংঘ উম্মাহ কেন্দ্রিক ইসলামী জাতিয়তাবাদের বদলে আরব জাতিয়তাবাদের পক্ষপাতদুষ্ট ছিলো। এটাই তার প্রবন্ধের মূল প্রস্তাবনা। বলা বাহুল্য এই প্রস্তাবনা অত্যন্ত ঠুনকো ও অসঙ্গত।
২। হিজবুত তাহেরীদের লিফলেট চালাচালির জিহাদ সিরিয়াতেও চালু ছিলো। অন্যান্য জায়গার মতো সেখানে তাদের এই প্রকল্প মারা খেয়েছে।
৩। ভাতৃসংঘের ওপর আসাদ শাসকগোষ্ঠীর দমন ও নিপীড়নের সুযোগে ভারতীয় উপমহাদেশের আলেমদের বিশেষত আবুল হাসান আলি নাদভি ও সাইয়্যের আবুল আ’লা মওদূদী রহ: এঁর কিতাব সমূহ সেখানকার আলিমগণের মধ্যে প্রসার ও প্রসিদ্ধি লাভ করে।
৪। আরব জাতীয়তাবাদ বহুরুপে চর্চিত হয়েছে। হাশেমী রাজবংশ কর্তৃক বৃহত্তর সিরিয়া বা আশ-শাম প্রকল্পে সিরিয়া কেন্দ্রিক আরব জাতিয়তাবাদের প্রচারণা চালানো হতো। যাকে ভাতৃসংঘ বিলাতীদের প্রকল্প বলে সন্দেহ করতো। এর বিপরীতে সমগ্র আরব কেন্দ্রিক প্যান এরাবিজম যা UAR United Arab Republic এর প্রকল্পকে ভাতৃসংঘ সমর্থন দিতো। তার বিপরীতে সিরিয়া ও ইরাক কেন্দ্রিক বাথ পার্টির আরব জাতিয়তাবাদ ও তার বিপরীতে মিশরের নাসিরীয় আরব জাতিয়তাবাদ – সব মিলে একটা ল্যাটকা খিঁচুড়ীর মতো অবস্থা।
৫। ভাতৃসংঘের বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক সংগ্রাম প্রকল্প ও আল-কায়েদার বিশুদ্ধবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রকল্পের মাঝে একটা বিরাট জায়গা ছিলো যা সালাফিসহ ও বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর দখলে ছিলো। মজার বিষয় হলো এই বিরোধ পতাকার ব্যবহারেও উঠে এসেছিলো। অর্থাৎ আল-কায়েদার যোদ্ধারা বিপ্লবীদের পতাকার বদলে কলেমার পতাকার ব্যবহার করতেন। মজার ব্যাপার হলো দীর্ঘকালের কামড়াকামড়ি শেষে সবাই মিলে ঐ UAR এর পতাকায়ই এখন ব্যবহার করছে। তার চাইতে মজার বিষয় হলো পতাকা নিয়ে এই কামড়া-কামড়িতে জিহাদী ঘরানার বলে পরিচিত বহু আলেম কলেমার পতাকা ব্যবহারের শুধু বিরোধীতাই করেন নাই বরং উপহাসও করেছেন। এই কামড়াকামড়ির মাঝখানে আহরার আশ-শামের পতাকা নিয়ে তেমন কোন বাতিক ছিলোনা। কারন পতাকার ব্যবহার দ্বীন চর্চার অংশ নয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
৬। প্রবন্ধকারের মতে ইসলামী বিপ্লবের পর খোমেনীর সরকার যদি আসাদ শাসকগোষ্ঠীর দিকে না ঝুঁকে সিরিয়ান ভাতৃসংঘের প্রতি তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা বিস্তার করতো তাহলে সিরিয়ান ভাতৃসংঘ সিরিয়া কেন্দ্রিক আরব জাতিয়তাবাদ বাদ দিয়ে উম্মাহ কেন্দ্রিক ইসলামী জাতিয়তাকে গ্রহণ করতো। এটাও কাঁচা আলাপ।
৭। কামাল পাশার প্রভাবাধীন তৎকালীন তুর্কি রাষ্ট্র্যের সাথে সীমান্তসহ অন্যান্য বিরোধের জের ধরে আসাদ শাসকগোষ্ঠী উসমানীয় খেলাফতের বিশেষ করে সুলতান আব্দুল হামিদ রহ: এঁর উম্মাহ কেন্দ্রিক ইসলামী জাতিয়তাকে প্রচার করতো। এরই অংশ হিসেবে কুর্দি বংশোদ্ভুত ও পরবর্তীতে সিরিয়ান নাগরিকত্ব অজর্নকারী বিখ্যাত আলিম আল-বূতির মাধ্যমে জাতি রাষ্ট্র্যের জাতিয়াবাদের ধারণাকে খন্ডন করে ও ইসলামী চেতনা বিরোধী প্রতিষ্ঠা করে উম্মাহ কেন্দ্রিক ইসলামী জাতিয়তাবাদের প্রচারণা চালানো হয়। অর্থাৎ আসাদ শাসকগোষ্ঠীর এই প্রচারনার মূলে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস বা দায়বদ্ধতা ছিলোনা, ছিলো নিজেদের রাজনৈতিক কূটকৌশল বাস্তবায়নের দুরভিসন্ধি। যা হিতে বিপরীত হয়ে পরবর্তীতে আল-কায়েদার মতো প্যান-ইসলামিস্ট গোষ্ঠীর উত্থানে সহায়তা করে।
৮। যদিও এটা অত্র প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়, তথাপি আল-শারার উত্থানকে অনেকে এরদোগানের রাজনীতির প্রভাব হিসেবে বুঝতে চেষ্টা করেন। অর্থাৎ নিজস্ব বোঝাপড়ার মূলনীতিতে অটল থেকেও কোন একটি নির্দিষ্ট মতবাদের গন্ডীতে আটকে না যেয়ে বাস্তবতার নিরীখে পদক্ষেপ গ্রহণ করবার যে কৌশল। লক্ষ্য করলে দেখবেন আল-শারা সশস্ত্র সংগ্রামকে কখনোই পরিত্যাগ করা কিংবা খাটো করে দেখবার পক্ষপাতি নন। একই সাথে ভাতৃসংঘের রাজনৈতিক সংগঠন ও কলাকৌশলও তিনি রপ্ত করতে চান। অর্থাৎ তিনি গণতন্ত্র হারাম বলে গোঁ ধরে বসে নেই, আবার শরীয়তকে সংবিধানের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার ব্যাপারেও তিনি অনড়।

যাহোক, অনেক ঘ্যান চর্চাতো হলো। এবার টুপি পিন্দা ঘুমান।

Popular posts from this blog

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

ইসলাম ও গণতন্ত্র

জামাতের ভোট: একবারে না পারিলে দাও শতবার