বাংলাদেশের মূল সংকট
একটা খুব আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করলাম। এক হেফাজতী মুফতি বলেছেন যে প্রাণ-আরএফএল কোম্পানীর মালিক বা সিইও কাদিয়ানী হওয়ায় তাদের পন্য বর্জন করা উচিত। এখন এই কথার সত্যতা তো আমার পক্ষে যাচাই করা সম্ভব নয়। তবে যেটা আমাকে বিস্মিত করেছে তাহলো ঐ মুফতির বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কমেন্ট বক্সে তীব্র প্রতিক্রিয়া। এরকম প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছিলাম এক ছাত্রনেতা কর্তৃক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের পর। প্রতিক্রিয়ার এইরুপ তীব্রতার সাদৃশ্যে এই দুই পক্ষের মধ্যে একটা যোগসূত্র অনুমান করা যায়। যা এদেশে সামরিক-পূঁজিতন্ত্র ঘনীভূত হবার আশংকাকে প্রকট করে।
তার কিছু লক্ষণ আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি। যেমন খোদ রাজধানীতে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার মতো সহিংস অপরাধমূলক কাজের হার বেড়ে যাওয়া। কেননা সব অপরাধতো আর সহিংস নয়। এরুপ অপরাধ জিয়ার ছদ্মবেশী সমরতন্ত্র ও এরশাদের প্রকাশ্য ও সুদীর্ঘ সমরতন্ত্রের পর প্রকট আকার ধারন করেছিলো। আমার শৈশবের আবছা স্মৃতি মনে আছে। যখন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন উত্তর সংকটকালে জামায়াতে ইসলামীর নি:স্বার্থ সমর্থনে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণ করে। তার পরপরই ঢাকার কোন এক বস্তিতে প্রকাশ্যে এরুপ সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়েছিলো যার বিভৎস বর্ণনা প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে টেলিভিশনে রিপোর্ট করা হয়েছিলো।
কথা হলো বাংলাদেশে ক্ষমতার গলি-ঘুপচিতে সামরিক-পূঁজিতন্ত্র জায়গা করে নিতে পেরেছে মূলত নেতৃত্বের সংকটের কারনে। নেতৃত্বের এই সংকট দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনবলের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারকে ধারন করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে উৎসারিত। কিছুদিন আগেও দেখলাম সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন সদস্য যিনি নিজ বাহিনী ও সহকর্মীদের দ্বারাই গুম ও নির্যাতনের স্বীকার হয়েছিলেন তিনি অকপটে স্বীকার করছেন যে আহলে হাদীস, আহলে কোরান এইসব বিষয় তাদের নিকট ছিলো অজানা।
যদিও ওনার এই অকপট স্বীকারোক্তি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য কেননা ভুল শোধরানোর সুযোগ তখনই তৈরি হয় যখন ভুল সংঘটিত হবার আত্মোপলব্ধি ঘটে। এখন আমি বলতে চাই যে শুধুমাত্র এখানে থেমে না গিয়ে বরং এটাও উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ইসলামের মৌলিক শিক্ষার অভাবগ্রস্থ লোকদের দ্বারা ক্ষমতার চর্চা আরও বৃহত্তর সমস্যা। বরং এটাই মূল সমস্যা। আপনারা যারা সুলতান ফাতিহ এঁর ওপর নির্মিত তুর্কি সিরিজ দেখেন তারা ইতিমধ্যেই হুরুফী সম্প্রদায়ের ছদ্মবেশে খৃস্টান শাসকদের দ্বারা উসমানী সালতানাতের ক্ষমতা দখলের প্রয়াস লক্ষ্য করেছেন।
সমস্যা হলো বাংলাদেশে আলেম সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই বিষয়ক সচেতনতা ও বোঝাপড়া কম। সেকুলার শিক্ষিতরা যদি ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ হন তবে ধর্ম শিক্ষিতরা খন্ডিত ধর্মজ্ঞানের দোষে কিংবা অন্ত:ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট। যার নিকৃষ্ট প্রমাণ দেশের জাতীয় মসজিদেের খতিব, যিনি একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের পক্ষপাতদুষ্ট, দ্বারা অন্ত:ধর্মীয় বিভাজনকে উস্কে দেবার হীন প্রবণতা। কারন ব্যাপারটা এমন নয় যে আমরা সাদিয়ানী-কাদিয়ানী জাতীয় শব্দ আগে শুনি নাই। বরং এই গোষ্ঠীটাই এক সময় বলেছিলো মওদূদীবাদ ইহুদী-কাদিয়ানীদের চাইতে নিকৃষ্ট।
এরপর এও সত্য যে তথাকথিত জুলাই বিপ্লবের পরপরই সংবিধান লিখে সব সমস্যা ঠিক করে ফেলবার যে বাতুলতা আমরা তুলে ধরেছিলাম তা-ই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এবং তা সে কারনেই যে কারনের কথা আমরা উল্লেখ করেছিলাম। আর তা হলো বাংলাদেশীদের যতোই ভৌগলিক সীমার সূত্রে এক জাতীয় বলে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করা হোক না কেন তারা এক জাতীয় নয়। বরং এর সংখ্যাগরিষ্ঠ নিদেন পক্ষে মুসলিম জাতীয়।
আর বাদ বাকী নানা ধরনের বিচিত্র রকমের বিভ্রান্তির কবলে পতিত। এ কারনেই ঐ মুষ্টিমেয় গোষ্ঠিকেই '৪৭ এর বিপরীতে '৭১ সংঘটিত করতে হয়েছে। তাদের অসংলগ্ন আলাপের বড়ো প্রমাণ এর চাইতে আর কি হতে পারে যে '২৪ এর গণ-বিস্ফোরণ পরবর্তী তথাকথিত সাংবিধানিক সংকটের বৈধতা সহ নানা প্রশ্নে যারা নির্বাচনে গিয়ে আটকে যায়, তারাই '৭১ এর প্রশ্নে গর্ব করে বলে যে তা গণতান্ত্রিক পথে অর্জিত নয় বরং তা সশস্ত্র যুদ্ধের ফসল।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে '৪৭ এ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে রায়ের পক্ষে মত দিয়েছিলো সে রায়ের কিছু বিরুদ্ধবাদীও ছিলো। মূলত তারাই '৭১ সংঘটিত করার নেতৃত্ব দিয়েছে। একারনে '৭১ এ সংঘটিত অপরাধসমূহের ভিত্তিতে যতোই মানুষের মানবিকতা ও বিবেক-কে ছিনতাই করার ও '৭১ বিরোধী ইসলামপন্থী শক্তিসমূহকে আত্ম-গ্লানিতে ঘায়েল করবার প্রচেষ্টা করা হোক না কেন, '৭১ পরবর্তীতে ইসলাম ও ইসলাম পন্থীদের নির্মূল করবার ইতিহাস কিন্তু ঘুরে ফিরে বারে বারে উঠে আসছেই। তাতে এটাও স্পষ্ট হচ্ছে যে '৭১ ছিলো '৪৭ এর খন্ডায়ন। বরং '৭১ এর যে বিভাজনের রাজনীতি, সেই একই রাজনীতি আমরা দেখেছি ২০১৪-১৫ সালে, জামায়াতে ইসলামের নেতাদের ফাঁসির মঞ্চায়নের মধ্যে এবং আল্লাহ-আল্লাহর রাসূল সা: সহ ইসলাম ও আলেম-ওলামা বিরোধীতার প্রাবল্যে।
কিন্তু ঘুরেফিরে কথা গিয়ে ঠেকে জাতির ও জাতীয় নেতৃত্বের চিন্তাগত বিশৃঙ্খলায়। অর্থাৎ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিকে নেতৃত্ব দেবার জন্য যে বুনিয়াদী ইসলামী শিক্ষার দরকার তার অভাবে। এটাই মূল সংকট।