হক কথা: জালিমের দাওয়াই

এই সূত্রে মনে পড়ে গেলো বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় গুন্ডা বাহিনী ও বালুর ট্রাক দিয়ে ঘিরে ফেলার প্রেক্ষিতে উনি বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে একটা ভাষণ দেন। এটা ছিলো মূলত পুরো জাতির গলায় ছুরি ধরার মতো ঘটনা। যা বাংলাদেশ পন্থী ও ইসলাম পন্থীদের একটা বিরাট পরাজয়। জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের এবং মরহুম সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো ত্যাছড়া লোকদের হত্যার ধারাবাহিকতা। যার দায়ভার জিয়াও এড়াতে পারেন না। কিন্তু কথা হলো সে সময় জিয়ার বক্তব্য চলাকালে আশেপাশের পুলিশলীগের প্ররোচনায় উনি বক্তব্যের খেই হারিয়ে ফেলেন। ক্ষিপ্ত হয়ে বলতে থাকেন: গোপালি পুলিশ! কথা সত্য কিন্তু মোক্ষম নয়। মোক্ষম কথা থেকে তাঁর দৃষ্টি ফেরাতেই এই কুকর্ম।
 
বক্তব্য কি ছিলো আমার সঠিক মনে নাই। কিন্তু এই বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন শিবিরের সূ্ত্রে পরিচিত পাড়ার এক বড়ো ভাই। যে বয়সের পোলাপান আমিশা প্যাটেলের দুই মনি পাছা নিয়ে পড়ে থাকে আমরা সে বয়সে অনেক উচ্চমার্গের বিষয় নিয়ে গ্যাজাতাম। এর মানে এই নয় যে নারীর ব্যাপারে আমরা নিস্পৃহ ছিলাম। বরং আমাদের জীবনে তা মুখ্য হয়ে উঠেনি। মূলত শিবিরের সূ্ত্রে যাদের সাথেই পরিচয় হয়েছে আমি এই বিষয়টা কম-বেশী লক্ষ্য করেছি। বুয়েট হোক, স্কুল-কলেজ হোক, অজ পাড়া গাঁ হোক, ইসলামের প্রতি তাদের আগ্রহ এবং জীবনের প্রতি সহজাত, সরল অনুসন্ধিৎসা তাদের সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে, তাদের ভেতরকার সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ভেদাভেদ মিটিয়ে তাদের জন্য পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করে দিয়েছিলো।
 
যাহোক সেটা অপ্রাসঙ্গিক। তো ওই ভাই বলছিলেন যে বেগম জিয়াকে খেপিয়ে দেবার আগে তিনি চমৎকার বক্তৃতা করে চলছিলেন। একেবারে যেই যেই পয়েন্টে কথা বললে মাফিয়া সরকারের গাত্রদাহ শুরু হয়, রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় সেইসব গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ই বাদ যাচ্ছিলো না। তিনি তাঁর ভাষণে মাফিয়া সরকারকে বিশ্ববাসীর কাছে দিগম্বর করে দিচ্ছিলেন। সেই সময়ই তাঁকে কটুকাটব্য করে তাঁর বক্তব্যের প্রবাহ নষ্ট করা হয়। তাঁর কথা হয়ে পড়ে অসংলগ্ন।
 
এটা কিন্তু অনেক ভাবনার বিষয়। এই যে এতোটুকু পিচ্চি তার এরকম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যেও সে তার চিন্তা-ভাবনাকে লক্ষ্যচুত হতে দেয়নি, কোন অপ্রাসঙ্গিক কথা সে বলেনি, ক্ষোভ সইতে না পেরে হতাশায় কটু-কাটব্য, গালিগালাজের আশ্রয় সে নেয়নি এটা একটা বিরাট ব্যাপার। সাধারন মানুষের জন্য তো বটেই বিশেষ করে নেতৃ-স্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য এটা রপ্ত করা অধিক কাম্য।
 
আমরা ইদানীং যেমন দেখছি ইসলাম বিরোধী মাফিয়া সরকারের পতনে উৎফুল্ল হয়ে এক শ্রেনীর পাতলা হুজুর দিশেহারা হয়ে পড়েছে। খুশির চোটে তাদের বক্তব্য গানজায়ে হিন্দ, এমারত, কলেমার পতেকা সব মিলিয়ে একটা ল্যাটকা খিচুড়িতে পরিণত হচ্ছে। উত্তেজনায় বক্তৃতার খেই হারিয়ে নিজেদের কল্পিত সাফল্যে মনে হয় শিৎকার দিতে দিতে লুঙ্গি ভিজিয়ে ফেলে এমন অবস্থা। এটা শুধু বিরক্তিকরই নয়, সমস্যাজনকও বটে।
 
আল-হামদুলিল্লাহ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ মোটের ওপর এই পরীক্ষায় পাস করেছেন। কি রাগে, কি বিরাগে তাঁদের নেতারা ফালতু বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকতে সক্ষম হয়েছেন। চরম হতাশায়ও তাঁরা প্রতিপক্ষকে কটু-কাটব্য করেননি। যার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আমাদের মাওলানা সাঈদী সাহেব মরহুম।
 
এই বিষয়টা নবিজী সা: এঁর সেই হাদীসে উঠে এসেছে যেখানে উনি জালিমের বিরুদ্ধে সত্য উচ্চারনের পরামর্শ দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে কথাটার গুরুত্ব হয়তো নাও উপলব্ধি করা যেতে পারে। হয়তো এর কার্যকারিতা নিয়ে তৈরী হতে পারে সংশয়। আফটার অল, যে জালিমের অস্ত্র-শস্ত্র গোলাবারুদ আছে কথা দিয়ে কিভাবে তার বিরুদ্ধে লড়াই করা যায়? তার বিরুদ্ধে কথা বলে হবেই বা টা কি?
 
কিন্তু এর ওপর তাফাক্কুর করলে পর আমরা উপলব্ধি করি যে জালিম মাত্রই ভীতু। এ কারনেই ভীতু যে মানুষের সহজাত প্রকৃতি হলো তার অন্যায়কে ঢেকে রাখা। এ জন্যই জালিমেরা সত্যবাদিদের মুখ চেপে ধরতে পাগলপারা হয়ে যায়। মানুষের মুখ বন্ধ করে দিতে চায়। কারন সত্যের অনুপস্থিতিতে সে মিথ্যার বেসাতি ছড়িয়ে দিতে পারে। তৈরী করতে পারে গোয়েবলসীয় প্রাসাদ। এ কারনেই সত্যবাদীদের ব্যাপারে জালিমের ভয়টা সবচেয়ে বেশী কাজ করে। সত্যের উচ্চারণ তাকে উন্মত্ত করে দেয়।
 
বিপরীতপক্ষে এমনও ঘটে যে চোগলখোর, মিথ্যুক, ফাসাদ-সৃষ্টিকারীরা বাক স্বাধীনতার সুযোগের অপব্যাবহার করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করতে তৎপর হয়। তখন হকপন্থীদের জন্য এদের জিব টেনে ছিঁড়ে ফেলা, হাত ভেঙ্গে দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়ে। কারন যেই ধরনের লোকদের জিব বাকস্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে ফেৎনা ছড়িয়ে বেড়ায়, সেই ধরনের লোকদের হাতই ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে বাকস্বাধীনতা হরণ করতে তৎপর হয়ে ওঠে।
 
তবে একটা প্রশ্ন আমার মধ্যে সব সময় কাজ করে তাহলো মানুষকে ঠিক কতোটুকু শেখানো যায়? এই রাগ-বিরাগে, উৎফুল্ল-বিমর্ষে, চিন্তার খেই না হারানো এবং তাকে সঠিক, সংক্ষিপ্ত ও আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করা, এটা কি শেখানো যায় বা মানুষ আদৌ কি তা শিখতে পারে? পারলে তার সীমা কতোটুকু?

Popular posts from this blog

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

ইসলাম ও গণতন্ত্র

জামাতের ভোট: একবারে না পারিলে দাও শতবার