নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি এবং একটি প্রশ্ন
তারেক রহমান সাহেব ওনার পিতার কিছু গুন পেয়েছেন। দেশকে নিয়ে গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনা করার প্রবণতা তার একটি। গঠনমূলক সব চিন্তাই কার্যকরী তা নয়। তার প্রয়োজনও নাই। প্রবণতা-টাই গুরত্বপূর্ণ। নিয়ত ভালো হওয়া চাই। সুতরাং বাংলাদেশ শান্টুমরালীগ এধরনের নির্বাচনী প্রতিশ্রতিকে দশ টাকায় চাল খাওয়ানোর সাথে তুলনা করতে পারে। করুক। তাতে যদি তাদের কিছু স্বান্তনা মিলে। খাউজানি যদি একটু কমে। দেশের মানুষের কিছু শান্তি হয়। পাঠক আমরা তো লগি-বৈঠা দিয়ে মানুষ পিটায় মারায় অভ্যস্ত নই। তাই সুযোগ পেয়ে একটু খোঁচা দিলাম। গেলো এক যুগেরও বেশী সময় ধরে চলা নিপীড়ন প্রসূত ক্ষোভ কিছুও যদি লাঘব হয়।
তারেক রহমান সাহেবের এই গঠনমূলক চিন্তার প্রবণতা আগেও ছিলো। যেটা বিশেষত চার দলীয় জোট1 সরকারের সময়ে সামনে এসেছে সবচেয়ে বেশী। তাকে নিয়ে সে সময়ে যে ব্যাপক সমালোচনা ও তার বিপরীতে আওয়ামী মাফিয়া আমলে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের কোনটিই বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আমার মতে এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে তারেক রহমানের নেতৃত্বের ব্যাপারে বাংলাদেশ বিরোধী চক্রটি বেশ দুশ্চিন্তায় ছিলো। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই নেতৃত্বকে তারা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করতে চেয়েছে। এবং আমার মতে অনেকটা সফলও হয়েছে। জিয়া কিংবা তারেক রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের উত্থানকে অন্তত গত ১৫-২০ বছর যাবত তো ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছে। নাকি? এটাই বা কম কি?
আমার যতোদূর মনে হয় তারেক রহমান জামাত-শিবিরের মতো বিএনপি-ছাত্রদলের একটা শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি ও শৃঙ্খলা আনতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তিনি সংগঠনের নেতা-কর্মীদের একটা ডিজিটাল ডাটাবেজ করতে চেয়েছিলেন। আমার মনে পড়ে এনটিভি-তে দেয়া তার একটা সাক্ষাৎকারে উনি বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমানা বাড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এরপর মিডিয়াতে তা নিয়ে কুত্তার কামড়াকামড়ি শুরু হয়। দিল্লীর উচ্ছিষ্ঠ ভোগীরা এই কামড়াকামড়ি শুরু করলেও ঝাতিয়তাবাদি চেৎনায় উদ্বুদ্ধ বাঁদর গুলোও লাফাঙ্গা থেকে বাদ যায়নি। সবার একটাই কথা উনি কি ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করছেন? এই হলো অবস্থা।
যেখানে উচিত ছিলো ইসলামপন্থী-জাতিয়তাবাদী সাংবাদিক পক্ষ এজেন্ডা তৈরী করবেন আর দিল্লীর কুত্তাগুলো সেগুলো নিয়ে কেঁউকেঁউ করবে কিন্তু হচ্ছে তার বিপরীত। এটাই সমস্যা। যেদিন সেটা হবে কেবল সেদিন-ই বুঝবেন বাংলাদেশের একটা সম্ভাবনা তৈরী হচ্ছে।
যাহোক তারেক রহমানের সেই পুরো ইন্টারভিউয়ের ঐ বিষয়টি-ই আমাকে আকৃষ্ট করেছিলো বেশী। তখন আমার পিতিবি গোল। সুতরাং পড়ালেখা থুয়ে ধুমায়া Rise of Nations আর CIVILIZATION III গেম খেলি। আজকে যে শিককা বেবস্তা নিয়ে তুমুল গবেষণা চলছে মানে ঐতিহ্যবাহী বাংলার BAL-এর আলাপ চলছে এগুলো টয়লেটে ফ্লাশ করে দিয়ে যদি মেট্টিক-ইন্টার পড়ুয়া বা ঐ বয়সী পোলাপাইন এইসব গেম খেলা শুরু করে আখেরে তাদের আকল-বুদ্ধি বিকাশে তা অধিকতর সহায়ক হবে তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই।
তো ঐসব গেম এ একটি ধারণা ছিলো এমন যে আপনি যে জাতির হয়ে লড়ছেন ধরেন জার্মানি তারা যদি অন্য সকলের আগে কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে পারে বা সাংস্কৃতিক বিকাশে এগিয়ে যায় তখন তাদের জাতীয় সীমানা একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় বেড়ে যায়। এভাবে অনেক সময় দেখা যায় যে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক ও সভ্যতার সূচকে এগিয়ে থাকার কারনে কোন দেশের সীমান্ত সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী দেশের অনগ্রসর শহগুলোতে এমন প্রভাব বিস্তার করে যে তার দরুন ঐসব শহরে নাগরিক বিক্ষোভ দেখা দেয় তাদের উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় এবং এক পর্যায়ে তারা তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে বিদ্রোহ করে প্রাগ্রসর দেশের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।
অর্থাৎ কেবল যুদ্ধ করে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েই যে দেশের সীমানা বাড়ানো যায় ব্যাপারটা তা নয়। আর সে উদাহরণ তো বাংলাদেশের ইতিহাসেই আছে। বার্মার রাজাকে হৃত সিংহাসন ফিরে পেতে সাহায্য করায় বার্মা এক সময় বাংলাদেশের করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। বাংলাদেশ থেকে রাজার সাহায্যের জন্য যাদের পাঠানো হয়েছিলো তাদের বংশধরেরাই বর্তমানে রোহিঙ্গা বলে পরিচিত।
আমার মনে হয়েছে তারেক রহমান যেভাবে তাঁর দলকে গুছিয়ে আনতে প্রচেষ্ট হয়েছিলেন এবং বাংলাদেশ কেন্দ্রিক একটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রুপকল্প গড়তে চেয়েছিলেন সেটা দিল্লী কেন্দ্রিক ক্ষমতা বলয়কে আতংকিত করে তুলেছিলো।
এবার মূল বিষয়ে আসি। তারেক রহমান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে ফ্যামিলি কার্ডের যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন তার কয়েকটা সমস্যা আছে। যেমন মায়ের নামে কার্ড দেবার বিষয়টি সরাসরি লিঙ্গ বৈষম্য। ব্যাডারা কি দোষ করলো? তারপর ধরেন যে পরিবারে মা গত হয়েছেন পিতা সংসার চালান তাদের কি হবে? প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা অবিবাহিত পুরুষ কিংবা মহিলা তারা কি দোষ করলো? যেসব পরিবারে একাধিক স্ত্রী আছেন তারা? যে দেশের মানুষেরা "উন্নত বিশ্বের” নাগরিকত্ব পাবার তাড়নায় নিজের বোনকে স্ত্রী ভিসায় বিদেশে নিয়ে যেতে পারে তারা ফুড কার্ডের জন্য কয় বেডির নামে কার্ড নেবে তার গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব?
তাছাড়া ক্ষুধা বিমোচনে কার্ডের অবতারণা আমাকে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ফিঙ্গার প্রিন্ট প্রজেক্টের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অর্থাৎ আপনার মূল সমস্যা ছিলো সুষ্ঠু নির্বাচন। আর এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে জাতীয় পরিচয় পত্র সুষ্ঠু করা সংক্রান্ত নানাবিধ সমস্যা। মানে মূল সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা আরও বেড়েছে। তাতে যদিও এই প্রজেক্টের সুবিধাভোগীদের কোন সমস্যা হয় নাই। যারা যা কামায় নেয়ার তারা তা নিয়েছে। আর ভোট সুষ্ঠু হওয়া দুরে থাক ডাকাতি হয়েছে।
আমার মতে এর পরিবর্তে ফুড ব্যাংক বা লঙ্গরখানা চালু করেন। এটা আমেরিকাতেও আছে বলে শুনেছি। দেশের দারিদ্র ক্লীষ্ট অঞ্চলগুলোতে বা ভাসমান শ্রমিক ঘন এলাকা গুলোতে সপ্তাহে অন্তত একবার পাকানো খানা সরবরাহ করুন। এখানে মাঠ পর্যায়ে সাংগঠনিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার মেলা সুযোগ আছে। আমলাতান্ত্রিকতা এড়িয়ে গণসেবার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করবার অভিনবত্ব আছে। কাগুজে পরিকল্পনার গোলকধাঁধায় হাবুডুবু না খেয়ে নগদে কর্ম বাস্তবায়নের ব্যাপার আছে।
এখানে এটাও উল্লেখ্য যে কদিন আগে জামাতের খুব সম্ভবত ডা: তাহের সাহেব বিনা জামানতে উদ্যোক্তাদের দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেবার পরিস্থিতি তৈরী হবার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। সমস্যাটা হলো ঋণ কেন্দ্রিক চিন্তা। অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর মতো একটা প্রাগ্রসর, দক্ষ, বিদগ্ধ ইসলামী দলের কর্তা ব্যক্তি পর্যন্ত কুফরী ঋণ কেন্দ্রিক চিন্তা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। আমাদের অবস্থা এতোটাই নাজুক। এ কারনে আমাদের বিনিয়োগ কেন্দ্রিক চিন্তা-ও ঋণ নির্ভর। অথছ সুদের বড়ো অংশটাই তৈরী হয় ঋণের ওপর।
তবে এর কারন হলো একমাত্র ব্যাংক ঋণ ভিত্তিক সফল ব্যবসায় সম্প্রসারণের অভিজ্ঞতা। কারন অন্যান্য সকল সামাজিক উদ্যোগ লাভের মুখ দেখেনি। অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব খুইয়েছেন। সুতরাং ব্যাংকিং এর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কি করে বিনিয়োগ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ও সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা যায় তার দিকে বেশী মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। কি করে ব্যবসায় কর্মের সংস্কৃতিকে বিকশিত করা যায়, কি করে ব্যবসার বিকাশের প্রতিবন্ধকতা দুর করা যায় তা নিয়ে কাজ করা বেশী প্রয়োজন। ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা মানুষ যতোটা না অর্থ কিংবা রাষ্ট্রের নিকট থেকে সহায়তার মুখাপেক্ষি তার চাইতে রাষ্ট্র তার চলার পথে আমলাতন্ত্রের মোড়কে যে অগুনিত প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে রাখে সেগুলোর অপসারন বেশী জরুরী। আমার মনে আছে পাশ্চাত্যের এক সহকর্মী আমাকে বলেছিলো তার দেশে একটা কোম্পানী রেজিষ্ট্রেশন করতে সর্বোচ্চ আড়াই ঘন্টা লাগতে পারে। এই যে নিজ দেশের ওপর এই আস্থা-টা এটাই আসল দেশপ্রেম। এটা কোন বায়বীয়, আরোপিত, আবেগি, প্যান-প্যানানি বহি:প্রকাশ নয় যে আপনি মাথায় ত্যানা পেঁচিয়ে, ভীষ্মলোচন শর্মার মতো জাতীয় সঙ্গীত জুড়ে দিয়ে দেশের বিরাট কিছু করে ফেলেছেন।
পরিশেষে যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আগ্রহী তাদের একটা প্রশ্ন করি। এটা অনেক গেম থিওরীর সমস্যাগুলোর মতো। ধরেন আপনি রাষ্ট্রনায়ক। আপনার কাছে সীমিত অর্থ আছে। আপনার জনপদের মানুষগুলো খাদ্যাভাবে রুগ্ন এবং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের অভাবে রুগ্ন। এখন আপনি যদি খাদ্যের ব্যবস্থা করেন তাহলে আপনি শ্রমশক্তি লাভ করবেন কিন্তু আপনার ব্যবসাগুলো বসে যাবে। অর্থাৎ আপানর শ্রমশক্তি থাকবে কিন্তু তা ব্যয় করবার উপায় থাকবে না। বিপরীত পক্ষে আপনি যদি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেন তখন আপনার শ্রমশক্তি থাকবে না। আপনি কি করবেন? কেন করবেন?
1চার দলীয় জোট সরকার বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচাইতে সফল সরকার। তাদের সময় পুলিশে যে ব্যাপক সংস্কার হয়েছিলো তা কিশোর হিসেবে আমারই চোখে পড়েছিলো। পরিবেশের উন্নয়ন যেমন পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহার কমিয়ে আনা, উন্মুক্ত পরিবেশে ধুমপান নিরুৎসাহিত করা ইত্যাদি অনেক প্রাগ্রসর কাজ সে সরকার করেছিলো। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে আজ বাংলাদেশ কমসে কম মালয়েশিয়ার কাতারে থাকতো বলে আমার ধারনা। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে বায়বীয় আলাপ করতে হতো না।