মেধার সাতকাহন
কোটা আন্দোলনের শুরু থেকে আমার যে সংশয় ছিলো তা হলো তাতে একদিকে মেধাতন্ত্রের প্রতি একটা স্পষ্ট স্বীকৃতি যেমন ছিলো, তেমনি দেশের বর্তমান দুরবস্থার জন্য এর অভাবকে দায়ী করবার একটা প্রচ্ছন্ন প্রবণতা ছিলো। তথাকথিত মেধাতন্ত্রে আমি যে নাস্তি তা আগেও বলেছি কয়েকবার।
তবে সে-ই প্রসঙ্গ এড়িয়েও বলা যায় যে আওয়ামী জালিমশাহী শাসনকে রাষ্ট্র্যযন্ত্রের শীর্ষস্থানে থাকা যেসব ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে, আনুকুল্য দিয়ে এর দীর্ঘায়নে দোসর হয়েছে তাদের কেউ-ই "জিপিও পাইপ" কিংবা তার পরবর্তী অটোপাস প্রজন্মের নয়। বরং তারা বিলাতী উপনিবেশকদের রেখে যাওয়া তথাকথিত মেট্রিকুলেশন সিস্টেমে এসএসসি কিংবা এইচএসসি-তে স্ট্যান্ড করা, স্টার কিংবা ডিভিশন পাওয়া প্রজন্ম। ঐ যে, যে সময় পাবলিক পরীক্ষার রেজাল্টের পর গুটি কয়েক "শীর্ষস্থান" লাভ করা পরীক্ষার্থীদের চান মুখ বিক্রী করে পত্রিকাগুলো ফাও লুটতো।
জালিমশাহীর সহযোগী এই সব লোকেরা কিন্তু আওয়ামী আমলে রাষ্ট্র্যযন্ত্রে প্রবেশ করে নাই। তারা পূর্বের আমলেই বিসিএস কিংবা আইএসএসবি প্রভৃতি পরীক্ষায় "উত্তীর্ণ” হয়েই এই চাকরের জীবনে প্রবেশ করেছে। উপরন্তু এই চাকরানী সুত্রে সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে "প্রশিক্ষণ” গ্রহণ করতে হয়েছে। এতো সবকিছুর পরেও তাদের নিকট তাদের ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক স্বার্থের বিনিময়ে জালিমশাহীর অপশাসন বৈধতা পেয়েছে। এরপরও কি করে মেধাতন্ত্রের অভাব-কে দেশের বর্তমান দুরবস্থার জন্য দায়ী করা যায়?
এই পরিপ্রেক্ষিত শুধু তাদের প্রজন্ম কিংবা এই দেশের রাষ্ট্র্যযন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এ কারনেই দেশের তথাকথিত রাঘব-বোয়ালদের একটা বড়ো অংশের দুই-তিন প্রজন্মের পূর্বে কোন ইতিহাস নাই। বরং তাদের পূর্ব পুরুষদের এমন হঠাৎ উত্থানের পেছনে একমাত্র কারন উপনিবেশিক আমলে নিজ ধর্ম-জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিলাতী প্রভুদের সেবাদাসত্ব গ্রহণ। খোঁজ নেন, বেশি দুর যেতে হবে না।
এমন প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী, নেতা-কর্মী - দের যাঁরা তথাকথিত মেধাতন্ত্রের এই বয়ানে গা ভাসাচ্ছেন তাঁদের আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে জামায়াতে ইসলামীর স্লোগান হলো:
আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই।
তাঁরা তো একথা বলেননি যে মেধাবী লোকের শাসন চাই। এবং তা না বলে তাঁরা দেশের রাজনীতির ময়দানের এক অনন্য খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। একারনেই যেখানে পুরো দেশ আত্মীয়তা-পরিচয় সূত্রে তো বটেই, অঞ্চল সূত্রে, পেশা সূ্ত্রে, প্রতিষ্ঠান সূত্রে - সংঘবদ্ধ মাফিয়াদের নিকট জিম্মী হয়ে গিয়েছে এবং এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা পর্যন্ত করতে অপারগ, সেখানে জামাত কেবলমাত্র বিশ্বাস, নিষ্ঠা ও ত্যাগ-তিতীক্ষার সূত্রে সংঘবদ্ধ হতে চাচ্ছে।
তার ফলশ্রুতিতে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীতে বৈচিত্র্যপূর্ণ পটভূমি সম্পন্ন নেতৃত্বের সমাবেশ হতে পেরেছে। এখানে একদিকে যেমন প্রচলিত অর্থে প্রখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্নাতক ও সাধারনের নিকট সম্মানার্হ পেশাজীবিদের দেখা পাওয়া যায় অপরদিকে মাদ্রাসা, পলিটেকনিক, কিংবা অন্যান্য অখ্যাত প্রতিষ্ঠান থেকে উঠে আসা নেতৃত্বও বিদ্যমান। এতে একদিকে যেমন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ও অন্যান্য স্নাতকদের উন্মেষ ঘটেছে তেমনি সমাজের খেটে খাওয়া, শ্রমিক শ্রেনীর মাঝে কাজ করা ব্যক্তিত্বদের উত্থান ঘটেছে। এটা দেশের রাজনীতিতে একটা যুগান্তকারী ঘটনা। এটা উপনিবেশোত্তর দাসসূলভ মানসের চিন্তাকাঠামো ও বিশ্বাসের মূলে আঘাত করেছে।
পাঠক মেধাতন্ত্রের বিনির্মাণ (Deconstruction) একটি পৃথক ও ব্যাপক বিষয়। যা আমার মুল কর্মের সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। তথাপি এই সম্পর্কিত চিন্তা-ভাবনা অবচেতনভাবে আমার আশৈশব লালিত। কোন পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থীর প্রথম স্থান অধিকার করার তাৎপর্য কি? ঐ পরীক্ষা যদি একাধিকবার নেয়া হয় তাহলেও কি সে তার স্থান ধরে রাখতে সমর্থ হবে এবং বাকিরা যে যার স্থান পূর্বের ন্যায় ধরে রাখতে সম্ভব হবে? যদি না হয় তবে পূর্বের মেধাক্রমের অর্থ কি দাঁড়ায়? যদি হয় তবে এই যে একজন শিক্ষার্থী একাধারে সবগুলো পরীক্ষায় শীর্ষস্থান অর্জন করছে, সকল শ্রেনীতে সে প্রথম স্থান অর্জন করে আসছে এটা তার শ্রেষ্ঠত্ব, না তার সহপাঠীদের ব্যর্থতা, না পরীক্ষা পদ্ধতির দুর্বলতা?
তদুপরি যে বিষয়ে বা যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেয়া হলো এবং তার মাধ্যমে যে ধরনের দক্ষতা পরিমাপের ধারণা করা হলো তার সাথে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে কাঙ্খিত দক্ষতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কিনা? আরও মৌলিক প্রশ্ন যদি করি, মেধা কি? এটা কি একাঙ্গিক কোন বিষয়? না বৈচিত্রপূ্র্ণ বিষয়। একজন পরীক্ষার্থী না বুঝে সমস্ত নোট মুখস্ত করে ফেলছে এটা কি মেধার পরিচয়? না বেকুবির? না উভয়ের? অর্থাৎ না বুঝেও একটা পুরো নোট রাতারাতি মুখস্ত করে ফেলা তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির পরিচয় কিনা? এবং না বুঝতে পারাটা মূর্খতার পরিচয় কিনা? শুধু পাঠ্যসূচী রপ্ত করার মধ্যেই মেধাশক্তি সীমিত কিনা? পাঠ্যসূচীর বাইরের পৃথিবী জানাটা বা কৌতুহল থাকাটাও মেধাশক্তির পরিচয় কিনা? কেবলমাত্র পাঠ্যসূচীতে মনোনিবিষ্ট থাকতে পারাটা মেধার পরিচয় কিনা? পাঠ্যসূচীর বাইরে বিচরণ করবার প্রবণতা মেধার দূর্বলতা কিনা?
মেধা কি অর্জিত না প্রাপ্ত? ভালো সঙ্গীতজ্ঞ হওয়া মেধার পরিচয় কিনা? তা-ও অর্জিত না প্রাপ্ত? ভালো ব্যবহার বা সামাজিকতা মেধার বহি:প্রকাশ কিনা? শারীরিক ও চেহারার সৌন্দর্য মেধার বহি:প্রকাশ কিনা? সেটা-ও অর্জিত না প্রাপ্ত? একজন অত্যন্ত সুচতুর লোক মেধাবী না একজন প্রবল বিশ্বাসপ্রবণ ব্যক্তি মেধাবী? একজন আবেগ প্রবণ মানুষ মেধাবী না একজন জেঙ্গিস খানের মতো নিষ্ঠুর মানুষ মেধাবী?
পাঠক আশাকরি তোমার চিরায়ত বাংলা সুলভ মুরগী মস্তিষ্কের চুদুর-বুদুর করে দিতে পেরেছি। এখন কথা হলো যদি আমি তোমাদের এই চুদুর-বুদুর করে দিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে সক্ষম হই, যদি দ্যাশ-কে ভালোবেসে দ্যাশের বাইরে ক্যাশ পাচার করে, উন্নত বিশ্বের কোন দেশে ছদ্রি পাড়া গড়ে তুলতে পারি তাকে তুমি মেধার স্বীকৃতি দেবে কিনা? এমন মেধা তুমি চাও কিনা?
পাঠকটা! আমার প্রাণের পাঠকটা! আমার প্রিয় বাংলাটা! তোমরা যেহেতু মেধার আলাপ তুলেছ আজকে তোমাদের মেধার লুঙ্গি খুলে তবে ছাড়বো। না মানে খোলা প্রায় শেষ। আরেকটু বাকি আছে। দাঁড়াও।
মহামতি হিটলার যে মানব শ্রেষ্ঠ জর্মন জাতি গঠন করতে চেয়েছিলেন, বৃহত্তর রাইখ-কে কেন্দ্র করে সহস্রবর্ষ ব্যাপী একটা রাষ্ট্র্যের গোড়াপত্তন করতে চেয়েছিলেন – তিনি কি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পৃথিবীর বুকে জর্মনরাই যে সবচেয়ে মেধাবী জাতি তা প্রমাণ করে দেখান নি? অর্থাৎ ডারউইনের সূ্ত্রে মস্তিষ্কের খোলস ও চোয়ালের আনুপাতিক হারের অংক কষে দেখিয়ে দেননি? নাকি তোমরাই কেবল গণিত শেখো, স্বপ্ন দেখো করে বেড়াও?
এখন কথা হলো তোমাদের মধ্যে কেউ যদি ফুলার রোড, পলাশী, কিংবা ভাটিয়ারীর টাট্টিখানা গুলোর কোন কাবিল থেকে থাকো এবং ঘটনাক্রমে বাংলার ডকিংস তথা আরজ আলী মাতুব্বর ছাড়িয়ে বহি:বিশ্বের চুদুর-বুদুর এর সংস্পর্শে এসে থাকো তাহলে হয়তো হিটলারের পদ্ধতিকে ছদ্ম-বিজ্ঞান বলে আপত্তি তুলবে। কিন্তু তাতে কি জর্মন জাতির মেধাহীনতা প্রতিষ্ঠা পায়? তারা কি জগৎশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, রাষ্ট্র্যনায়ক জন্ম দেয়নি? এমনকি হিটলারের শাসন কালে জার্মানীর জাতীয় উৎপাদন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির চার-পাঁচটি দেশের সম্মিলিত জাতীয় উৎপাদনের চাইতে বেশী ছিলো না? আমার প্রশ্ন হলো এটা মেধা কিনা? যদি মেধা হয় এমন মেধা তুমি চাও কিনা? যদি না চাও, কেমন মেধা তুমি চাও? মেধা সম্পর্কে তোমার চিন্তা কি? তোমার ইয়েজীবিগুলো বলতে পারবে কি?
পাঠক লুঙ্গি খোলা শেষ। এই যে তুমি ন্যাংটো-টা বাংলা-টা হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছো এক্ষণে তোমার ক্ষতবিক্ষত অহমে একটু মলম দেই। জর্মনীর স্নাতক পর্যায়ের অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষাক্রমে Ivy League জাতীয় কোন ধারণা ছিলো না। অর্থাৎ জর্মনীর সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকধারীদের একই মানের বলে গণ্য করা হতো। এবং এটা করা হতো কোন মতবাদী ধ্যান-ধারণা থেকে নয় বরং তাদের শিক্ষক ও শিক্ষাক্রমের উপর তাদের অন্তর্নিহিত আস্থা থেকে। ২০১৬-১৭ সালের দিকে কোন একটা অনলাইন ফোরামে পড়েছিলাম যে সেখানে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সমষ্টিতে Ivy League জাতীয় একটা সঙ্ঘ (মাফিয়া চক্র) গড়ে তুলবার তোড়জোড় চলছে। ফোরামে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেক জর্মনদের আক্ষেপ করতে দেখলাম তাদের শিক্ষাব্যবস্থা পাশ্চাত্যের মতো অধো:পাতে যাচ্ছে বলে। সুতরাং তুমি একা নও। জগৎশ্রেষ্ঠ জর্মন জাতিও নেংটো হতে যাচ্ছে। কথায় কথায় গর্ভিত হয়ে ওঠা আমার বাংলাগুলোর জন্য এটাই বা কম কি?