ভাগাভাগির রাজনীতি, ভেগে যাওয়ার রাজনীতি

যদি জামাত-বিএনপি ও অন্যান্য স্বৈরাচার বিরোধীদের মধ্যে আবারও জোট হয় তবে আমার মতে তাদের যুগপৎ প্রচেষ্টার যেকোন অর্জন বিএনপি, জামাত, ও অন্যান্য এর মধ্যে ৫ ভাগের যথাক্রমে ২.৫, ২.০, ও ০.৫ ভাগ অনুপাতে বন্টন করা উচিত। এটা একেবারে আনুমানিক। আমি ধরে নিয়েছি যে বিএনপি এখনও সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। কিন্তু গত এক যুগেরও বেশী সময় ধরে ভোট না হওয়ায় কোন রাজনৈতিক দলের জনভিত্তি সম্পর্কেই দৃঢ় মন্তব্য করা যায় না। বিশেষ করে ১৩-১৪ সালের দিকের উত্তাল আন্দোলনের সময়টাতে জামাত উপ-নির্বাচনগুলোতে যে চমক দেখিয়েছিলো তাতে ভবিষ্যতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে তারা যদি বিএনপি-কে, অন্তত হারাতে না পারুক, কঠিন লড়াইয়ে ফেলে দিয়ে শতাধিক আসনে জয়ী  হয়ে আসে তাতেও আমি আশ্চর্য হবো না।

তবে আমার কাছে মূল বিবেচ্য হলো জামাতের জনপ্রিয়তা - কতোটুকু জামাতের রাজনৈতিক দর্শনের উপর মানুষের আস্থা আর কতোটুকু স্রেফ তাদের ওপর আওয়ামীদের কৃত অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া। অর্থাৎ এটা কি জামাতের সাফল্য না আওয়ামীদের ব্যর্থতা। যেমনটা বিএনপির ক্ষেত্রে আমি নিশ্চিত। বিএনপির ভবিতব্য যেকোন রাজনৈতিক বিজয় স্রেফ আওয়ামী ব্যর্থতার প্রমাণ, বিএনপির সফলতার নয়। বিএনপি আমার মূল বিবেচ্য নয়। আমার বিবেচ্য জামাত। সেই সূত্রে আমার যেটা মনে হয় এই ক্ষেত্রে তিনটা বিষয় বিবেচ্য: সহানুভূতির রাজনীতি, স্বজাত্যবোধের রাজনীতি, বিশ্বাসের রাজনীতি।

সহানুভূতির রাজনীতি বিপদজনক। কারন সহানুভূতি নিপীড়নের স্বীকার হওয়ার ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ যতোদিন ফাঁসির দড়িতে ঝুলবেন, অত্যাচারিত হবেন ততোদিন মানুষের সমর্থন পাবেন। বেশ ঐ পর্যন্ত-ই। এই সমর্থন দিয়ে রাজকার্যে সফল হওয়া অসম্ভব।

স্বজাত্যবোধের রাজনীতি অনেকটা সহানুভূতির রাজনীতির মতো হলেও এই দুইয়ে একটা সূক্ষ পার্থক্য আছে। আর তা হলো নিপীড়ন ছাড়াও আরও অনেক প্রকার স্বজাত্যবোধ তৈরী হতে পারে। যেমন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যদি বিশ্বাস করা শুরু করে যে জামাত তাদের মধ্যকার মানুষদের সমন্বয়েই গঠিত তখন এক প্রকারের স্বজাত্যবোধ তৈরী হয়। সমস্যা হলো দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্য পীড়িত। ভাত-কাপড়ের সংগ্রামে-ই তাদের জীবন নাশ হয়। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্য থেকেও যদি এক শ্রেনীর লোক ক্ষমতা আরোহণ করেন তখন স্বজাত্যবোধের ধারনায় চিড় ধরে। তাছাড়া রাজকার্য ঠিক ভাত-কাপড়ের সংগ্রাম নয়। ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা বিধান রাজকার্যের একটা অংশ কেবল। কিন্তু তাতেই সে সীমিত নয়। সমস্যাটা ওখানেই। শ্রমিক-মজদুর এক হও বলে একটা সেনসেশনের রাজনীতি করে যারা ক্ষমতায় গিয়েছিলেন তাদেরকেই শ্রমিক-মজদুর শ্রেণী এক সময় নিজেদের প্রতিপক্ষ ভেবে তাদের বিরুদ্ধে খড়গ হস্ত হয়েছিলো ঐ কারনেই।

বিশ্বাসের রাজনীতি বলতে মতাদর্শিক রাজনীতি বুঝিয়েছি। তবে মতাদর্শিক বা মতবাদী ধ্যান-ধারণা বর্তমানে একটা ঋণাত্মক ধারণা তৈরী করে। তাছাড়া শিল্পবিপ্লব উত্তর এইসব মতবাদী রাজনীতি মূলত জাগতিক, অবিশ্বাসী, নাস্তিকতা থেকে উৎসারিত। বিশ্বাসের রাজনীতি বলতে তাই আস্তিকতা বা ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার ওপর নির্মিত রাজনৈতিক দর্শন বা মতবাদকে বুঝিয়েছি। বিশ্বাসের রাজনীতির একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রশিক্ষিত, বিশ্বস্ত, ও পরিক্ষীত জনভিত্তি। জামাতের এটাই প্রয়োজন। কারন জামাতের মতো দল বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসা মানে জগতের তাবৎ শক্তির নজর কাড়া। যে দুষ্ট পান্ডা গুলো বিশ্বের নিয়ামক হয়েছে উঠেছে তারা কিছুতেই এমন একটা জাতিগোষ্ঠী-কে মেনে নিতে চাইবে না যাদের নাকের ডগায় দড়ি দিয়ে ঘুরানো না যায়। 

তাই প্রশ্ন হলো জামাতের মুল জনভিত্তি বিশ্বাসের রাজনীতি উৎসারিত কিনা। কারন পাহাড়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ তখনই সকলকে ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে যখন তার ভিতটা প্রশস্ত ও মজবুত হয়। আমরা দেখেছি ইরানী ইসলামী বিপ্লবোত্তর শাসকগোষ্ঠীর জনসমর্থনের ভিত্তি বিশ্বাসের রাজনীতি। প্রায় অর্ধশতক বছর অনাহারে-অর্ধাহারে রেখেও বিশ্বের তাবৎ পরাশক্তিকুল তাদের দাবাতে পারেনি। অর্থাৎ তাদের সংগ্রাম ভাত-কাপড়ের লড়াইয়ে হারিয়ে যায় নি। তারা স্বাধীন মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে আত্ম-প্রকাশ করতে বদ্ধপরিকর। আমরা এর পুনরাবৃত্তি দেখতে পারছি তুরস্কে।

অথচ এমন প্রচেষ্টা মিশরেও হয়েছিলো। কিন্তু তা সফল হয়নি এ কারনেই যে স্বৈরশাসক উত্তর ইখওয়ানের বিজয়ের অন্যতম কারন ছিলো তাদের মূল সমর্থকদের বাহিরে এমন জনগোষ্ঠী যারা স্বৈরাচারবিরোধী স্বজাত্যবোধ থেকে তাদের সমর্থন করেছিলো। ইখওয়ান ক্ষমতা আরোহনের সাথে সাথে সেই স্বজাত্যবোধ হারিয়ে যায়। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারনে মিশরের ইতিহাসের সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে সরিয়ে দিয়ে এখন সেই জনগোষ্ঠী ভাত-কাপড়ের সংগ্রামেও হেরে গিয়েছে। খবরে বলছে যে মহিলা মুরসির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তাঁর অপসারণে সরব ভূমিকা পালন করেছিলেন, তিনি এখন আবর্জনার স্তুপে খাবার খুঁজে হয়রাণ হয়ে মুরসির বিদায়ে আফসোস করছেন।

স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আত্মমর্যাদা, স্বাধীনতা এমন কোন লেবেন চুষ নয় যে চীন থেকে ঋণ নিয়ে, জাপানীদের তৈরী করতে দিয়ে, কোরীয়ানদের ব্যবস্থাপনায়, পাশ্চাত্যের মোড়লীপনায় আপনি শুধু কিনবেন আর চুষবেন। স্বাধীনতার মূল্য এই যে ত্যাগ-তিতিক্ষা দিয়ে তা খরিদ করতে হয় আর অধ্যবসায় দিয়ে তা বহন করতে হয়।

Popular posts from this blog

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

ইসলাম ও গণতন্ত্র

জামাতের ভোট: একবারে না পারিলে দাও শতবার