আমার তিন শিক্ষক
আমাদের ইসলামিয়াতের শিক্ষক আব্দুল কাবীর স্যার। শর্ষীনার পীর সাহেবের মুরিদ ছিলেন। আলাভোলা লোক। মাঝে মাঝে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
আমাদের সাথে দেখা হয়ে গেলে বলতেন, মহান আল্লাহর সৃষ্টি। কি আশ্চর্য না! তো উনি একদিন আমাদের বললেন, আমাকে কবির ডাকবে না। আমার নাম আব্দুল কাবীর। অর্থাৎ আল-কাবীরের দাস। আমি তো দাস মাত্র। তোমরা আবার মন খারাপ কোরোনা যে তোমাদের শিক্ষক একজন দাস। আমিতো আল্লাহর দাস।
উনি আমার মনে সুদ সম্পর্কে সর্বপ্রথম সচেতনতা তৈরী করেছিলেন। তখন অনেকেই ব্যাংকের ইন্টারেস্ট-কে সুদ মনে করতেন না। তবে উনি কখনই এ বিষয়ে আমাদেরকে লম্বা-চওড়া খুৎবা দেননি। শুধু এতোটুকু জানাই যথেষ্ঠ ছিলো যে সুদী ব্যাংকের হজ্জ স্কীমে ওনার কোন জমা ছিলোনা।
আমাদের বাংলা ও ইংরেজীর দুই শিক্ষক ছিলেন আঁতেল শিরোমণি। তবে নিরীহ প্রকৃতির আঁতেল। বাংলার শিক্ষক প্রতিদিন ৮টি সংবাদপত্র পড়তেন বলে শুনতাম। দেশী শাম্বাদিকদের নিয়মিত পাঠক ও মিডিয়ার নিয়মিত দর্শক হলে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতে পরিণত হওয়া অবশ্যম্ভাবী।
বাংলার শিক্ষক বিশালাকার অক্সফোর্ড ডিকশনারী নিয়ে ঘোরাঘুরি করতেন। সবসময় ইংরেজীর মাহাত্য বর্ণনা করতেন। মাত্র ছাব্বিশটা বর্ণ দিয়ে তারা বিশ্বজয় করেছে অথচ অর্ধশতাধিক বর্ণ দিয়েও আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে রবীন্দ্র-নজরুলের শরানপন্ন হতে বাধ্য হই। গাঁইগুই করি।
অন্য সব আঁতেলের মতোই ওনার মূল বক্তব্য যে কি তা আমরা ঠাহর করতে পারতাম না। পোলাপান তাতে খুশী-ই ছিলো। তো একদিন স্কুলে মহাপরিদর্শক আসবেন এজন্য উনি ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই সতর্ক করে দিলেন, আজকে নো হাংকি-পাংকি। কারক-সমাস দিয়ে আমাদের জীবন আজ বিষিয়ে তোলা হবে।
তো ক্লাস শুরু হবার পর যথারীতি উনি কিভাবে কিভাবে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ থেকে আফগানিস্তান হয়ে লাদেনে চলে গেলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত লাদেনের আত্মঘাতী কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন। বেশ জোশের সাথে। এটা একটা লক্ষ্যণীয় ব্যাপার। যারা ইসলাম বিরোধী বলে সমাজে পরিচিত তাদের প্রায় সকলে লাদেন ভক্ত। আমি নির্মলেন্দুগুনকেও দেখেছি লাদেনের কবিতা চর্চা করতে।
সে যা-ই হোক আমাদের বাংলা স্যার আপন মনে খেই হারিয়ে যখন লাদেনের আত্মঘাতি কবিতা আবৃত্তি করে চলেছেন এমন সময় মহাপরিদর্শক এসে হাজির। ঘটনার আকস্মিকতায় উনি কিংকর্তব্যমিমূঢ় হয়ে তোতলাতে শুরু করলেন। দৃশ্যটা স্মরণ হলে এখনো হাসি পায়।
ইংরেজীর শিক্ষক হাদীস নিয়ে আঁতলামী করতেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ-এর বিরাট ভক্ত ছিলেন। সহীহ বুখারীর সব হাদিসকে-ই সহীহ বলা যাবে কিনা এই সব আর কি। আমাদের মধ্যে যারা তখন উঠতি তালেবান-লাদেন তারা ঈমান আক্বীদা ধ্বংসের এহেন ষঢ়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতাম। মানে ঘেউ ঘেউ করতাম আরকি। আমাদের ইংরেজীর শিক্ষক-ও তাল মিলিয়ে সুর চড়িয়ে কখনও কখনও কু-উ করে উঠতেন। মানে আমাদের তর্কাতর্কি ছিলো বাংলার বুদ্ধিজীবি, রাজনীতিবিদদের গভীর আলোচনা পর্যালোচনার মতো। চেঁচামেচি-ই সব। কোন সারবত্তা নেই। তো এহেন পরিস্থিতি কখনও সামলে উঠতে না পারলে উনি উপনিবেশবাদীদের আশ্রয় নিতেন। ইংরেজীতে গালি দিতেন: You fanatics! এই শব্দের অর্থ আমাদের তখন জানা ছিলোনা। তবে বিলাতী ঘেউ। নিশ্চই খারাপ কিছু। নিজেদের মান-সম্মানের কথা চিন্তা করে আমরাও চুপ করে যেতাম।