কাফেরদের কূটকৌশলের বিপরীতে মুসলিম নেতৃত্বের বিচক্ষণতা
দেশের জনগণের ভোটের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া, তাদের অর্থ পাচার করা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে বলে নিপীড়িত জনসাধারণ বেশ খুশী। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একথা কেনো কেউ বলছে না যে এই দেশের যে অর্থ অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে তা এদেশের মানুষের নিকট ফেরত দেয়া হবে কিনা? নাকি, পূর্বে যেমন ঈঙ্গিত দিয়েছিলাম, ইরানের শাহের মতো ৪০ বিলিয়ন ডলার পাচার করে যুক্তরাষ্ট্র্যে নিয়ে যাবার সুযোগ দিয়ে আবার সেই অর্থকে দীর্ঘদিন বাজেয়াপ্ত করে মার্কিন মুলুকে রেখে দেয়ার মতো একই কাজ করা হবে?
মুসলমান বিশ্বে স্বৈরাচারীদের টিকে থাকতে সহায়তা করে, স্বজাতীদের শোষনে সহায়তা করে, আবার তাদের বিরুদ্ধেই স্বেচ্ছাচারীতা-দুর্নীতির অভিযোগ করা কি পুরনো মার্কিন কৌশল নয়? নিরীহ জনগণকে খুনী স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে পেছন থেকে সটকে পড়া বা war of attrition এর মাধ্যমে মার্কিন বিরোধী বহু পক্ষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার এই কৌশল কি আমরা সিরিয়ায় দেখেনি? এখন বার্মাকে কেন্দ্র করে সে-ই একই কৌশল যে তারা নিচ্ছেনা এই গ্যারান্টি কে দিলো?
পাঠক যদি মদন মিডিয়ার ভক্ত পাঠক-দর্শক না হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চই ধরতে পেরেছেন যে রাশিয়া এবং পুতিন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। এখন প্রশ্ন পরাজয়ের ধরণ নিয়ে। তাই চীন এখন মার্কিনীদের প্রধান মাথা ব্যাথা। কারন চীন রাশিয়া কিংবা উত্তর কোরিয়ার মতো কোন দেশ নয়।
চীনের ব্যাপারে আমার মার্কিন ও পাশ্চাত্য মিডিয়া প্রভাবিত ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে সজাগ হই শেইখ উমার ইব্রাহীম ভাদিল্লো এঁর পর্যালোচনায়। ধর্মহীনদের নেতৃত্বে চীন গত কয়েক দশকে তাদের দেশের প্রায় ৮০ কোটি মানুষকে চরম দারিদ্র সীমা থেকে বের করে নিয়ে এসেছে। যদি ধরেও নেই এসব কমুনিস্ট প্রোপাগান্ডা তথাপি তাদের দেশের যে বিস্ময়কর উত্থান তাতো অস্বীকার করবার মতো নয়।
সম্প্রতি প্রযুক্তির একটা বিষয় বেশ আলোড়ন তৈরী করলো। যাহলো মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত হুয়াওয়ে ৭ ন্যানোমিটার চিপ তৈরীতে সফলতার ঘোষণা দেয়া। এবং সেটা এমন সময় করা হলো যখন মার্কিন গুরুত্বপূ্র্ণ রাজনৈতিক নেতারা চীন সফররত ছিলেন। হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেবার কারন হিসেবে যা-ই উল্লেখ করা হোক না কেন, এবং সেসবের সত্যাসত্যের যাচাই ছাড়াই যা বাস্তব এবং প্রকাশ্য তা এই যে মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য মতে চীন কোভিডের সময় ১২ ন্যানোমিটারের চিপ বানানোর কৌশল রপ্ত করেছিলো। মার্কিনিরা, অর্থাৎ এ্যাপল খুব সম্ভবত সে-ই সময়েই ৩ বা ৫ ন্যানোমিটারের চিপ বানানো শিখে গিয়েছিলো।
হুয়াওয়ের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেবার পর গেলো বছর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মার্কিন নীতি নির্ধারকেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলেন যে তাদের হিসেবে ৭ ন্যানোমিটারে আসতে চীনাদের কম সে কম পাঁচ বছর লাগবে। বছর না ঘুরতেই এই লক্ষ্য অর্জন করে ফেলায় তা মার্কিনিদের হতবাক করে দিয়েছে। তাদের শাম্বাদিকেরা এও বলতে চেয়েছেন যে মার্কিন নেতাদের চীন সফরের সময়েই হুয়াওয়ে এই ঘোষণা দেয়ায় চীন পরোক্ষভাবে তাদের জবাব দিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু চীন সম্পর্কে খবর রাখেন এমন অনেকের মতে এটা কাকতালীয় ঘটনা। এভাবে দেখিয়ে দেয়া, কাঁদাছোড়াছুড়ি, প্রতিক্রিয়া মূলক কর্ম আদৌও চীনা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে যায় না। তারা কর্মপটু। তারা তাদের কাজ করে যায় নীরবে। লক্ষ্যে অবিচল। অর্থাৎ জাত-বাংলার মতো তারা "পারলে ঠেকা" বলে ভোঁদড় নাচ দিয়ে বিদেশীদের হাত-পা ধরে বসে থাকে না।
চীনের বন্দনা আমার উদ্দেশ্য নয়। চীন যদি তার এই ধর্মহীন পথেই চলতে থাকে তাহলে তাদের এসকল কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য এ নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। ধর্মহীনতার পথ চীনের ঐতিহ্যের সাথেও বেমানান। এটা বরং ইউরোপ থেকে আমদানী করা। তবে মুল কথাটি হলো চীন যে ভারত কিংবা রাশিয়া নয় এটা মার্কিনীরা সঠিক ভাবেই অনুধাবন করেছেন। করেছেন বলেই আমার সন্দেহ হয় ভবিষ্যতে বার্মা কেন্দ্রিক এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলে সিরিয়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা। যার মূল লক্ষ্য চীন।
মার্কিনীরা চাইলে সিরিয়ার যুদ্ধ বহু আগে শেষ হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিলো। সেক্ষেত্রে রাশিয়ার কবর রচিত হতো আরবে, ইউক্রেনে হামলাতো দুর কি বাত। কিন্তু সিরিয়ার বিপ্লব সফল হলেই যে সহীহ মদনেরা নেতৃত্বে এসে "রাফিদাদের" বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাপিয়ে পড়তো তা মার্কিনীরা নিশ্চিত হতে পারেনি। তাছাড়া সিরিয়া কেন্দ্রিক মার্কিন বহু প্রতিপক্ষ-প্রতিযোগিদের এক জায়গায় এনে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়ারও উপযুক্ত সুযোগ ছিলো। সুপন্ডিত উমার ফারুক আব্দুল্লাহ সেই ২০১২ সালেই বলেছিলেন মার্কিনীরা সহজে এই যুদ্ধ শেষ হতে দেবেনা। এই যুদ্ধের সুত্রেই উদীয়মান তুর্কি শক্তিকে বাধাগ্রস্ত করা, নিশ্চিহ্ন করবার সুবর্ণ সুযোগ তারা পেয়েছিলো। কিন্তু মহান আল্লাহর ফযলে এবং এরদোগান সাহেবের বিচক্ষণ নেতৃত্বগুণে এ যাবৎ তারা সফল হতে পারেনি।
এ বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। যখন মিশরের ইতিহাসের সর্বপ্রথম গণভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসিকে তাঁর সমর্থক সহ হত্যা করা হলো তখন এরদোগান উম্মাহ কেন্দ্রিক ভাতৃত্ববোধে তাড়িত হয়ে তাঁদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। মিসর থেকে তুর্কিরা রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো। বুচার (butcher-কসাই) আল-আসাদের সীমাহীন নিপীড়নের শিকার হয়ে সিরীয় সাধারণ জনগণ যখন ফুঁসে উঠেছিলো তখন এরদোগান সাহেব প্রধানত ইসলামী মূল্যবোধে তাড়িত হয়ে তাদের সহায়তা ও নিজ দেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
অনেক তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক তখন বলেছিলেন এরদোগানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংসের পথে। হচ্ছিলোও তাই। তুরস্কে শরনার্থীদের ব্যাপক উপস্থিতিতে তুর্কীদের নাগরিক জীবনে যে মন্দ প্রভাব পড়েছিলো তার প্রতিফলন হয়েছিলো বড়ো বড়ো শহরের নির্বাচনে এরদোগানের দলের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে মার্কিনী ও পাশ্চাত্যিয়রা চাচ্ছিলো এরদোগানকে তাঁর প্রতিবেশীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তারপর Thanks giving dayতে টার্কি ভক্ষণ করা।
কিন্তু আল্লাহর মর্জি ছিলো ভিন্ন আর বিচক্ষণ এরদোগান সে সুযোগ তাদের দেনওনি। এখানেই তাঁর নেতৃত্ব গুণ ও বিচক্ষণতা। তিনি তাঁর শত্রুদের পাতা ফাঁদে পা নেননি আবার এমন কোন কাজও করেননি যে তাঁর শক্ররাও বলতে পারে যে তিনি মিথ্যাবাদী বা অবিশ্বস্ত। পাশ্চাত্যের কেউ বলতে পারেনি যে তিনি unreliable। তবে তিনি unpredictable এটাই তাদের সবচেয়ে বড়ো অভিযোগ। সবচেয়ে বড়ো মাথাব্যাথা।
মার্কিনীরা ভালো করেই জানে যে রুশ-তুরস্ক যতো মাখামাখি হোক না কেন তাদের মধ্যে ঐক্য অসম্ভব। তাই প্রায় এক যুগ ধরে এরদোগান সরকার প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চেয়েও মার্কিনীদের কাছ থেকে তা পেতে পারেননি। অন্তত যৌক্তিক শর্তে। মার্কিনী শর্তে নয়। অর্থাৎ আপনে টাকা দিবেন কিন্তু জিনিস আমার, ঐ জিনিসের নিয়ন্ত্রণও আমার থাকবে, আপনি শুধু দরকার হলে আমাকে বলবেন কাকে গুল্লি মারতে হবে আমি মেরে দেবো। পরবর্তীতে এরদোগান মার্কিনীদের হতবাক করে দিয়ে রাশিয়া থেকে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনে নিলেন। স্বাভাবিকভাবেই মার্কিনীরা এই সম্পর্কের ব্যপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। যুক্তরাষ্ট্র্যে বসবাসরত গুলেন সমর্থিত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক দিয়ে রাশিয়ার বিমান ভূপাতিত করানোও এর অংশ।
তথাপি রাশিয়া ও তুরস্ক প্রত্যেকে কাজ করেছে নিজস্ব ছকে। রাশিয়ার অর্থের প্রয়োজন ছিলো। তুরস্কের গ্যাস এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম। কিন্তু সম্পর্কের এমন বিকাশের মধ্যেও আমরা দেখলাম রাশিয়া সুযোগ পেয়ে সিরিয়ায় তুরস্কের প্রায় অর্ধশত সৈন্যকে হত্যা করলো আসাদের প্রক্সি হয়ে। রাশিয়ান বৈমানিক মারার প্রতিশোধ। তুরস্ক আসাদ সরকারকে হামলা করবার এমন বৈধ সুযোগ পেয়ে তাদের ড্রোন প্রযুক্তিকে সফল ভাবে কাজে লাগালো।
কিন্তু তার চাইতে গুরুত্বপূ্র্ণ বিষয় হলো ঐ সময় তুরস্কের পক্ষের অনেক ফ্যানবয় (fanboy) এটা বুঝে উঠতে পারেনি যে তুরস্ক দামেস্ক পর্যন্ত পৌঁছে আসাদকে একেবারেই নির্মূল করে দিচ্ছেনা কেনো। রাশিয়ান আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তুচ্ছ করে তুর্কী ড্রোনের এমন সফলতা মার্কিনীদের যেমন বিস্মিত করেছিলো তেমনি উচ্ছসিতও করেছে। যে কারনে আমরা মার্কিনীদের দেখেছি তুর্কী সরকারকে উস্কে দিতে যে তারা যেনো এ যাত্রায় আসাদকে বিনাশ করেন।
কিন্তু তুর্কীরা নিজেদের সক্ষমতার ব্যাপারে সচেতন বলেই মনে হয়েছে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের পর অবধারিত ভাবে সেটা মার্কিনী বা রুশদের দখলে চলে যেতো। তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অধিকৃত এতো বড়ো অঞ্চল নিজেদের দখলে রাখার মতো রাষ্ট্র্য এখনও তুরস্ক হয়ে উঠতে পারেনি। অর্থাৎ তখন দেখা যেতো তুরস্কের পরিশ্রমের ফল কাফিররা ভোগ করছে। বরং তখন তুর্কী সরকারের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হতে পারতো।
শুধু সিরিয়াতেই নয় মার্কিনীদের হতাশ করে আরব বিশ্বের সাথেও এরদোগান সম্পর্ক পুনোরুদ্ধার করতে এখন বদ্ধ পরিকর। এটাই নেৃতত্বের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা। এখানেই সাদ্দাম হোসেনের থেকে এরদোগানের পার্থক্য। সাদ্দাম হোসেন মনের সুখে কুয়েত-ইরান আক্রমণ করেননি। পরিস্থিতির প্রয়োজনেই করেছিলেন। কিন্তু তাঁর কৌশল বুমেরাং করেছে। মার্কিনীরা কুয়েত ও ইরানের বিরুদ্ধে তাঁকে উস্কে দিয়ে, অস্ত্র সরবরাহ করে এখন বলছে যে তিনি তাদের কথার ভুল তরজমার করেছিলেন। ভুল তরজমা এরদোগান করেননি। এটাই মার্কিনীদের ক্ষোভের কারন।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে কাফিররা জাল বিস্তার করবে, ফাঁদ পাতবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মুসলমান নেতৃত্ব দুরদর্শী হবেন। তিনি ফাঁদের বিপরীতে ফাঁদ পাততেই পারেন। কিন্তু কাফিরদের মতো কূটকৌশল ও অন্যায়ের আশ্রয় নিতে পারেন না। তিনি পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে বাস্তবভিত্তিক কৌশল প্রনয়ণ করতে বাধ্য হতে পারেন, তবে তার সীমা শত্রুপক্ষের কূটকৌশল ও নৃশংসতার বিপরীতে নিয়ন্ত্রিত।
যেমনটা আমরা সালাহউদ্দীন আইয়্যুবী রহ: কে ক্রুসেডারদের দ্বারা জেরুজালেমে পরিবেষ্টিত হয়ে করতে দেখেছি। তিনি আশেপাশের কূপ গুলো বিষাক্ত করে দিয়েছিলেন। কিছু যুদ্ধে সরু উপত্যকায় বন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। এগুলো কোনটাই ইসলামী যুদ্ধের মান (standard) কৌশল নয়। তথাপি পরিস্থিতির প্রয়োজনে শর্ত সাপেক্ষে তা যায়েজ।
তাই বলি বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মার্কিনীদের সাহায্য-সমর্থন মুসলমানদের জন্য মহান আল্লাহর বিরাট নেয়ামত হয়ে উঠতে পারে। তবে সেটা তখনই যখন বিশ্বরাজনীতির এই জটিল খেলায় দেশের মুসলিম নেতৃত্ব মার্কিনীদের সাথে সমান তালে খেলতে পারবেন।
বর্তমানে শাসক গুষ্ঠি আত্মবিশ্বাসের যে ঠুনকো প্রদর্শন করে চলেছেন শাহের পতনের আগের দিন পর্যন্ত ইরানী জেনারেলদের পক্ষ থেকে এমন আত্মবিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছিলো। পরেরদিন হারিকেন দিয়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারন তারা তখন দেশকে ভালোবাসে বিদেশ পাড়ি দিতে ব্যস্ত।