হেফাজতে ইসলামের সালতামামি
হেফাজতে ইসলাম "ফিরে আসার" ঘোষণা দিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। কি কারনে তারা "ফিরে আসতে" চাচ্ছে তা জানি না। জানবার আগ্রহও নাই। এর আগে এরা ইসলামের "হেফাজতের" জন্য আবির্ভূত হয়েছিলো। কিন্তু তাদের কর্মকান্ডের ফল শেষমেষ তাগুতের পক্ষে গিয়েছে, ইসলামের পক্ষে নয়।
হেফজাতে ইসলাম দেওবন্দী ধারার কওমী গোষ্ঠী। প্রখ্যাত ওলামা-মাশায়েখ যেমন গাঙ্গুহী রহ: ও নানূতবী রহ: এঁদের হাত ধরে দেওবন্দী ধারার বুৎপত্তি। এ সকল দূরদর্শী ওলামাগণ যথার্থ-ই উপলব্ধি করেছিলেন যে বিলাতী কাফেরদের অধীনে ইসলামী শিক্ষার প্রসার দূরে থাক, টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তাগুতি-কুফরী শক্তি ততোটুকু ইসলাম-ই শিক্ষা দেবে বা দেবার অনুবোদন দেবে যা তাদের পক্ষে না গেলেও অন্তত যেন তাদের বিপক্ষে না যায়।
উপনিবেশ উত্তর পরিবেশ এখন ভিন্ন। কিন্তু দেওবন্দীদের অন্ধ অনুকরণ থেমে নেই। হেফাজত ও কওমীদের কর্মকান্ড তার প্রমাণ। জোট সরকার আমলেতো বটেই এর পূর্বেও কওমী ধারাকে একটা রাষ্ট্রীয় ভিত্তি দেবার জন্য জামাতে ইসলামীর নেতারা প্রাণপন চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কওমীদের পক্ষ থেকে বরাবরই জামাতের "আকীদা" গত সমস্যা ও দেওবন্দের সরকারী অনুদান গ্রহণ না করার ওজর পেশ করা হয়েছিলো।
এ বিষয়টা উল্লেখযোগ্য। দেওবন্দীদের ধর্মীয় গুরু হোসাইন আহমদ মাদানীর যুক্তি ছিলো "মুত্তাহিদা কওমীয়া" বা "মদিনা রাষ্ট্র্যের অনুকরনে" ব্রিটিশ উত্তর ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দুদের সাথে মিশে এক জাতি হয়ে বসবাস করা। অর্থাৎ জাতীয়তার ভিত্তিতে হিন্দু-মুসলিম এক জাত এই ছিলো ঐ "ইসলামী পন্ডিতের" প্রস্তাবনা। তার মতে এটাই কথিত "মদিনা সনদের" ভিত্তিতে মুসলিম-অমুসলিমদের রাষ্ট্র্য পরিচালনার সহিহ তরিকা। এটা শুধু ভ্রান্তি-ই নয় বরং সবৈর্ব মিথ্যাচার এ কারনে যে মদিনা সনদের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র্য গঠিত হয়েছিলো সেখানে ধর্ম (ইহুদী, খ্রীস্টান)-গোত্র (আওস, খাজরাজ) নির্বিশেষে নবিজী সা: এঁর একক ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব মেনে নেয়া হয়েছিলো।
মেনে নেয়া হয়েছিলো বলেই মুসলমানদের ক্রান্তিলগ্নে যখন ইহুদীরা পেছন থেকে ছোরা মেরেছিলো তখন মদিনা সনদের ভিত্তিতে - অর্থাৎ যার যার ধর্মীয় রীতিতে অপরাধের শাস্তি বিধিত হবে - তাদের শাস্তি প্রদান করা সম্ভব হয়েছিলো। তার মানে মদিনা রাষ্ট্র্য "আমরা সবাই রাজা" নীতিতে পরিচালিত হয়নি। কোন রাষ্ট্র্যের পক্ষেই তা সম্ভব নয়। যখন বিএনপি-কে দেশের bum-পন্থীদের ওয়াসওয়াসা সম্পর্কে আমরা সচেতন করতে চেয়েছি তখন আমরা এ কথাটাই বলতে চেয়েছি। জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার কাঠামোর ভেতর থেকে সরকারী প্রতিষ্ঠানের আবার স্বায়ত্বশাসন কি জিনিস? সবাই-ই যদি "স্বায়ত্বশাসিত" হয়, তাহলে রাষ্ট্র্য থাকলো কই?
সুতরাং দেখা যাচ্ছে দেওবন্দী ঘরানার "ইসলামী পন্ডিতেরা" হিন্দুদের সাথে এক জাতীয় হওয়ায় দোষ দেখে না, দোষ জামাতে ইসলামীর। হাল আমলের মতিহীন সহি মদনদের মতো।
দেওবন্দী বা কওমিদের আত্মঘাতি কর্মকান্ড শুধু এখানেই থেমে নেই। তারা ঐতিহ্যবাহী ইসলামী শিক্ষাকে একদিকে আঞ্চলিকতা স্বর্বস্ব করে হিন্দুয়ানী রুপ দিয়েছে, নারীদের গৃহবন্দী করেছে, অপরদিকে ইসলামকে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে পরিণত করেছে। ঢাকার রাস্তায় চলাচল করেন এমন যে কেউ একথা স্বীকার করবেন যে মাদ্রাসা পড়ুয়াদের দিয়ে কি করে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হয়।
আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না, তথাপি এটার ব্যাখ্যা এমন হতে পারে যে, একটা সুষ্ঠু রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় হিসাব কেতাব নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ার অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু ভিক্ষার অর্থের কোন হিসাব দেয়া লাগে না। ঠিক যেভাবে তারা হিসাব দেয়নি যে শাপলা চত্বরে কতোজন ইয়াতীম ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সন্তানদের তারা নিয়ে গিয়েছিলো, আর কতোজনকে তারা ফেরত আনতে সমর্থ হয়েছিলো। সে কাজটা আদিলুর, তিনি নিজে একজন সেকুলার বা ধর্মহীন বলে জনশ্রুতি আছে, করতে যেয়ে সরকার কর্তৃক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন। তার সমর্থনে হেফাজত কিছু বলেছে কিনা জানিনা।
হেফাজত এবং সর্বোপরি দেওবন্দীদের আত্মঘাতী কর্মকান্ডের আরেকটা রুপ হলো নারী জাতির প্রতি বিরুপতা। এর শেকড় দেওবন্দী বর্তমান চিন্তাধারার অনেক গভীরে প্রোথিত। এটা দেওবন্দীদের মাঝে অভিনব বিকৃতি কি না তাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নারীদের গৃহবন্দী করার মধ্যে-ই সমাজে নারী-পুরুষ ঘটিত সব সমস্যার সমাধান নিহিত এমন ধারণা খোদ নবীজি সা: এঁর আমলেও করা হয়নি এটা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়।
প্রসিদ্ধ আলিমদের মতে মক্কার নারীদের সমাজ সংগঠন, মদীনার নারীদের সমাজ সংগঠনের চাইতে ভিন্ন ছিলো। মক্কার নারীদের কর্মকান্ড প্রধানত গৃহ কেন্দ্রিক ছিলো। অপরদিকে মদিনার নারীদের কর্মকান্ড বাহির কেন্দ্রিক। তার অন্যান্য অনেক কারনের একটা হলো মক্কা বাণিজ্য প্রধান এলাকা। এখানকার মানুষদের প্রধান উপজীব্য বাণিজ্য (trade)। অপরদিকে মদিনা কৃষি প্রধান এলাকা। এখানকার মানুষরাও কৃষি নির্ভর।
এজন্যই আমরা খালিদ বিন ওয়ালিদ রা: এঁর মতো এমন মহিলা বীর সাহাবি রা: এঁদেরও দেখা পাই যাঁরা পুরুষ সাহাবীদের মতো নবীজি সা: এঁর প্রহরায় নিযুক্ত ছিলেন। অনেকে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। খুব সম্ভবত খাওলা বিনতে আজওয়া রা: তাঁদের একজন। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুপন্ডিত উমার ফারুক আবদ-আল্লাহ বলেন ঐ মহিলা সাহাবি রা: তাঁর বন্দী ভাইকে কাফির-রোমান শিবির থেকে ছাড়িয়ে আনার যে কাব্যগাঁথা তা আরবী সাহিত্যে হোমারের ইলিয়াড-ওডিসির মতো সমাদৃত।
অথচ মুফতী শফির হিসেবে মুসলমান মেয়েদের শুধু স্বামীর অর্থের হিসাব রাখবার জ্ঞানটুকু থাকলেই হয়। পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়লেই চলবে। পাঠকদের মধ্যে যারা হালের খবর রাখেন তারা জেনে থাকবেন সাম্প্রতিক সময় আফগানিস্তানে মহিলাদের গৃহবন্দী করে ফেলবার একটা প্রচেষ্টার খবর চাউর হয়েছে। সমস্যা হলো আফগানিস্তান সম্পর্কে আমরা তাগুতী-কাফির মিডিয়া ছাড়া নির্ভরযোগ্য আলিম-ওলামাদের বরাতে খবর পাই কম।
তথাপি আফগানিস্থানে থাকা, অন্তত আফগানিস্থানে আছেন বলে দাবী করা ও তালিবান সমর্থকদের নিজেদের মধ্যকার আলোচনা থেকে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে দেওবন্দীদের মাঝে পুঁথি নির্ভর, অলীক কল্পনা প্রসূত চিন্তার প্রাধান্য আছে। পরিপক্কতারও যথেষ্ট অভাব আছে বলে মনে হয়েছে।
কারন সম্প্রতি আফগানিস্তানের কোন এক শহরের পার্কে উঠতি বয়সের কিছু ছেমড়াদের দ্বারা কিছু নারীদের ইভ টিজিং এর স্বীকার হবার পরিপ্রেক্ষিতে তালিবান সরকার সে এলাকার নারীদের পার্কে যাবার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। অর্থাৎ ওনারা পার্কগুলো নারীদের জন্য পৃথক করে দেয়া বা নিরাপদ করে তোলার সাহস বা যোগ্যতা দেখান নাই। নারীদের গর্তে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সেই হাদীসের কথা মনে পড়ে যে এক তরুণ সাহাবী রা: মুগ্ধ দৃষ্টিতে এক মহিলা সাহাবি রা: এঁর দিকে তাকাচ্ছিলেন আর নবিজী সা: স্নেহভরে তার চিবুক ধরে বারবার তার দৃষ্টি অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন। এটা সাহাবীদের রা: হাস্যরস তৈরী করেছিলো সন্দেহ নেই। তালিবানি-দেওবন্দী পদ্ধতিতে ঐ মহিলা সাহাবী রা: কে গর্তে ঢুকিয়ে, কোটরবন্দী করে ফেলা উচিত ছিলো।
আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী আওমায়ী “মুসলমানদের” মাঝে এই জাতীয় আষাঢ়ে ও কোটরবন্দী ইসলাম চর্চার প্রবণতা বেশী। তাগুতের অধিনে থেকে সহী পদ্ধতিতে ইসলাম চর্চার প্রবণতাও এদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশী।
যেকোন উন্নত সভ্যতায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে গন্য করা হয়। ঐতিহ্যগত ও শরীয়ত মোতাবেক নারী-পুরুষে অবাধ মেলামেশায় বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু তাই বলে নারীদের গর্তবাসি করে ফেলতে হবে বা গুজরাটী হিন্দু মেয়েদের মতো মুসলিম মেয়েদেরও পোটলা বন্দী করতে হবে এমন কথা বা ভাবনা ইসলামী ইতিহাসের সম্পূর্ণ বিপরীত।
বর্তমানে মুসলমানের ঘরের বালেগ ছেলেমেয়েরা একে অপরের “বন্ধু” হয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাষায় “just friend”। কারন মুসলমান নামীয়দের বিজাতীয়দের প্রতি মানসিক দাসবৃত্তি মানসিক বৈকল্যে পরিণত হয়েছে। তাই যখন ইসলাম নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার বিরুদ্ধে বলে তখন তা বেশ সেকেলে শোনায়। কিন্তু যখন ইসলামের দাবীগুলোই কোন অমুসলিম কিংবা পাশ্চাত্যীয় পন্ডিত-চিন্তাবিদ তাদের মতো করে প্রকাশ করেন তাতে কারও আপত্তি দুরে থাক বরং সেটা মুখস্ত করে একে অন্যকে শোনাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে:
Between men and women there is no friendship possible. There is passion, enmity, worship, love, but no friendship. — Oscar Wilde
নারীদের জান্নাতি হুরী বানাবার এই প্রচেষ্টার সাথে সাযুয্য খুঁজে পাই তালিবানদের শিক্ষা মন্ত্রী বা তৎসংশ্লিষ্ট একজন ইসলামী পন্ডিত প্রদত্ত উপদেশের সাথে যেখানে বলা হয়েছে যে প্রতি ঘন্টা দুনিয়াবী কাজের জন্য তার দ্বিগুন পরিমাণে আখিরাতী কাজ ইবাদত বন্দেগী করবার। ভালো মানের পন্ডিতেরা যে অনেক সময় বেশ ইউটোপিক হয়ে পড়েন এটা তার ভালো উদাহরণ।
ভালো কাজ করার গুরুত্ব সকলেই স্বীকার করেন। বিধর্মীরাও করেন। কিন্তু তৎসংশ্লিষ্ট বিধিবিধান কেবলমাত্র ইসলাম ধর্মের শরিয়তই সুস্পষ্ট করেছে। এখানে কর্মসমূহকে ফরজ, ওয়াজিব ও নফল প্রভৃতি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এমনকি প্রতিটি এবাদত আদায় বা গৃহীত হবার সর্বনিম্ন সীমা থেকে সর্বোচ্চ সীমা সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এটাও ইসলামের একমাত্র সত্যতার আরেকটি প্রমান।
আলিমগণ বলেন, শরীয়ত ইসলামী জীবনের সর্বনিম্ন সীমাকে নির্দিষ্ট করে এর পালনকে সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু তাতেই থেমে থাকার উপদেশ দেয়নি। বরঞ্চ যার যার সাধ্যমতো উর্ধ থেকে উর্ধে আরোহণের জন্য তাগাদা দিয়েছে। আইন একটি সর্বনিম্ন সীমা। সর্বোচ্চ নয়। ঠিক যেমন একটি ইমারতের ভিত্তি ইমারত নয়। বরং ভিত্তির ওপর দেয়াল দিয়ে চুনকাম ও যার যার রুচি অনুযায়ী রঙ ও নকশা করবার পরই তা একটি পূর্ণ ইমারত হয়ে ওঠে। তেমনি আইনের ভিত্তিতে সংস্কৃতি-আচার-অনুষ্ঠান এসবের প্রসারেই একটি সভ্যতা পূর্ণঙ্গতা পায়। মনে হচ্ছে তালিবানরা সবাইকে আল্লার অলী বানানোর পণ করেছেন। বিশ্বের কোন শিক্ষা পদ্ধতিতে সকলকে আইনস্টাইন বানাবার লক্ষ্য নির্ধারত করা হয় না। এ কারনেই পাস মার্ক ৩৩, ৯৯ নয়।
এটাও লক্ষ্যনীয় যে নজদী পাঠ্যক্রমে দিক্ষিত ও দেওবন্দী পাঠ্যক্রমে দিক্ষিতদের মধ্যে যে সংঘাত রাশিয়ার বিরুদ্ধে আফগান জিহাদের সময় পরিলক্ষিত হয়েছিলো তার মূলে ছিলো ঐ পাঠ্যক্রম। নজদী-ছালাফিদের কথায় কথায় তাকফির ও শেরক-বেদাত বলে ঝামেলা পাকানোর বদভ্যাস এবং এর বিপরীতে তালিবানদের নজদী-ছালাফিদের তাশাহুদের আঙ্গুল ভেঙ্গে দেয়ার এমন অনেক ঘটনা শোনা যায়।
অথচ ইমাম গাজ্জালী রহ: এঁর প্রণীত পাঠ্যক্রম অনুসারে বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী রহ: যে নিজামিয়া মাদ্রাসা চালু করেছিলেন সেই পাঠ্যক্রমে আব্বাসীয় শাসনামলে বাগদাদে দিক্ষীত আলিমরাও কি অনায়াসে, কি সাবলিলভাব তৎসময়ে শিয়া নিয়ন্ত্রিত মিশরীয় প্রশাসনে অবদান রাখতে পেরেছিলো এবং এক পর্যায়ে তার নেতৃত্বও নিয়ে নিতে পরেছিলো তা ইতিহাস প্রসিদ্ধ।
আমি জানিনা এ যাবৎ আমার লেখালেখিতে পাঠককে আমি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি কিনা। যদি না হই, সেটা আমার ব্যর্থতা না আমার পাঠকের সেটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কারন মানুষের selective listening বা যা শুনতে চাই তাই শুনবার প্রবণতাতো আছেই। ঐ যে এ ডাক্তার মদের অপকারিতা বোঝাতে গিয়ে এক গ্লাসে পানি অপরটিতে মদ রেখেছেন। এরপর পানির গ্লাসে একটা পিঁপড়া ছেড়ে দিলেন। সেটা অবলীলায় সাঁতরে বেড়াতে লাগলো। এরপর মদের গ্লাসে আরেকটা পিঁপড়া ছেড়ে দেয়া হলে তা মূহুর্তে মন্ডে পরিণত হলো। তখন উক্ত চিকিৎসক এই উপপাদনের ব্যাখ্যা উপস্থিত দর্শকদের নিকট জানতে চাইলে এক মদ্যপ বললো, "এর দ্বারা বোঝা গেলো আমরা যদি নিয়মিত মদ পান করি তবে আমাদের পেটের সমস্ত কীট-পতঙ্গ-ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস নির্মূল হয়ে যাবে"। হাদিসে একে বলা হয়েছে, "অপাত্রে জ্ঞান দান, শুকরের গলায় মুক্তো ঝুলোনোর সমান"।
কারন আমার লেখায় আমি যখন জামাতে ইসলামীর প্রশংসা করি বা তাদের প্রতি সমর্থন বা প্রত্যাশা ব্যক্ত করি তা এই জন্য নয় যে আমি তাদের বেতনভূক। বা এর সাথে আমার স্বার্থ জড়িত। এমনকি এটাও নয় যে এদেরকে আমি উসমানীয় সালতানাতদের দিকপালের মতো বিচক্ষণ মনে করি। বরঞ্চ তা এ কারনে করি যে আমার দৃষ্টিতে এরা এ পর্যন্ত যা করতে পেরেছে, "জাত বাংলা" হিসেবে তাদের সেটা করতে পারার কথা ছিলোনা। কিন্তু তারা পেরেছে। এবং আমার মতে তা পেরেছে ইসলামের কারনে। ইসলামের প্রতি তাদের নিষ্ঠার কারনে।
"জাত বাংলা"-র অনেকগুলো ভয়াবহ চরিত্রদোষের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো নিষ্ঠাহীনতা, আত্মদর্শন ও অনুধ্যানে অপারঙ্গমতা, ভেদজ্ঞানের অভাব, ও চারিত্রিক তারল্য।
যখন ওমর ফারুক রা: নবিজী সা: কে বললেন যে তিনি নিজের জীবন ছাড়া আর সব কিছুর উর্দ্বে তাঁকে ভালোবাসেন - এটাই নিষ্ঠা। একটা জাত বাংলা - কখনও এমন সুস্পষ্ট করে, নির্দিষ্ট করে কথা বলে না। যখন তাকে জেরা করা হয় এই যে সে সস্তা চালে বললো সে "সব কিছুর উর্দ্বে ভালোবাসে", সে-কি নিজের জীবনের চাইতেও ভালোবাসে? তখন উল্টো আপনার প্রতি তাচ্ছিল্যভরে সে বলে উঠবে, "এটা বলা লাগে নাকি? নিজের জানের চাইতে কে কারে বেশী ভালোবাসে?"। আমার মতে নবুয়্যতের পরিসমাপ্তি বাংলায় না হয়ে আরবে হবার এটাও একটা কারন। একটা জাত বাংলা গুপ্তভাষী। আরবের বেদুঈনেরা স্পষ্টভাষী। একটা জাত বাংলা চিপায় চাপায় গাঁইগুঁই করে কথা বলে অভ্যস্ত। একটা বেদুঈন ক্ষুরের মতো শব্দ চালিয়ে অভ্যস্ত।
ঘটনাক্রমে আমার পাঠশালায় যখন জানাজানি হলো যে আমার এক নিকট আত্মীয় প্রবল ক্ষমতাধর সরকারী কর্তা, তখন আমার শিক্ষকরা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমি কেন তাঁদের বিষয়টা অবহিত করিনি। অনেকে ঈঙ্গিত দিলেন এই যে আমার আচার-আচরনে, চলাফেরায় প্রকাশ পায়নি যে আমার নিকটাত্মীয় ক্ষমতাশীল ব্যক্তি এটা আমার বেকুবীর লক্ষণ বিশেষ। অথচ এই শিক্ষকেরাই এতোদিন গালভরা শিক্ষা দিয়ে আসছেন,
বংশে নয়, কর্মে পরিচয়।
আমার এই পরিচিতি শিক্ষক কর্মচারীদের আচরনেও আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসলো। তাদের আচরনে মনে হতো আমি-ই মূল ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আমি বিরক্তিতে, অশ্রদ্ধায় কুঁকড়ে যেতাম। নিজেকে আরও গুটিয়ে নিতাম।
এই যে কথা ও কর্মে বৈপরিত্য এটা আত্মদর্শন-অপারঙ্গমতার প্রমাণ। এটা চারিত্রিক তারল্যের প্রমাণ-ও বটে। অর্থাৎ সত্য জানবার পর তাকে ধারণ করবার মতো শক্তি, সাহস ও স্থৈর্যের অভাব। কর্মে পরিচিত হতে পারাটাই ন্যায্য এই সত্য তারাও জানতেন। কিন্তু নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে তা বিসর্জন দিতে তাদের বাধেনি। এদেরকে আপনি স্বায়ত্বশাসন দিতে চান?
সবশেষে জামাতকে হিন্দু-তাগুতী শক্তির সাথে এক করে দেখা ভেদজ্ঞানের অভাব। একটা চোরকে ডাকাতের পর্যায়ে বিবেচনা করা, একটা অভিযুক্তকে দোষীর কাতারে সাব্যস্ত করা, ন্যয়বানের মানবিক স্খলনের পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে দুশ্চিত্রের পক্ষাবলম্বন এ সকলই ভেদজ্ঞানের অভাব।
আত্মদর্শনে এই অপারঙ্গমতা, ভেদজ্ঞানে এই অভাবের কারনেই, জাত বাংলা - একটা একটার পাছায় সারাক্ষণ কামড়া-কামড়ি করে। এ কারনেই যখন আমরা তথাকথিত অভিজাতদের দারিদ্র নিয়ে কথা বলি, তা অবহেলিত দরিদ্রের সাড়া পায়। আবার যখন কোন কথা অভিজাতদের পক্ষে যায় তারা নড়েচড়ে বসে। অনেক বাংলা বলে। Yes, Yes, Right, Correct, সহিহ বাত!
কিন্তু যেটা কেউ উপলব্ধি করেনা তাহলো এই সমাজটা, এই দেশটা একটা নর্দমার মতো। নর্দমায় মলের মতো সবচাইতে হালকা বস্তু যেমন ভেসে "উঠে" দুর্গন্ধ ছড়ায় তেমনি এদেশে নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোকেরা অভিজাত হয়ে “উঠে”। তার মানে কিন্তু এই নয় যে যা কিছু দুষ্ট, যা কিছু মন্দ তা কেবল অভিজাতদের। বরং আসল সত্য তারা নর্দমার রাজা। অর্থাৎ সমাজের সবচাইতে নীচশ্রেনি থেকে নিয়ে সর্বোচ্চ শ্রেনি পর্যন্ত সকলেই এই নর্দমা তৈরীর কারিগর।
গেলোবারের হেফাজত "মুফতি" শফির হেফাজত ছিলো। এবারে হেফাজতের নেতৃত্বে খুব সম্ভবত মাওলানা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী আছেন। আমার জানা মতে উনি এবং ওনার মরহুম মামা মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরী সরকার পক্ষের শত নিপীড়ন সত্ত্বেও আপোষ করেননি। ওনারা এবার কাকে হেফাজত করেন তা সময়-ই বলে দেবে।