জ্ঞানের প্রসার বনাম আঁতলামির প্রসার

এদেশে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে সবচাইতে বড়ো দুর্ঘটনা হলো পুস্তক সর্বস্ব জ্ঞানের প্রসার। যা বেগবান হয়েছে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইদের বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের কার্যক্রমে। এ জাতীয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ইতিহাস এদেশে পুরনো। যেমন গত শতকের ষাটের দশকে খুব সম্ভবত ড. কাজী মোতাহার হােসেনের উদ্যোগে মুক্তির বুদ্ধি নামীয় একটি আন্দোলন শুরু হয়েছিলো।

কাজী মোতাহার হোসেন ও তাঁর সাম্প্রতিক পূর্বের বা সমসাময়িক জ্ঞানী গুনী ব্যক্তিবর্গ যেমন প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, মাওলানা আকরাম খাঁ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সহ আরও অসংখ্য পন্ডিতদের কর্মের সাথে আবদুল্লাহ আবু সাইদ ও তাঁর সমসাময়িক ব্যক্তিবর্গের যাঁরা বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত বলে পরিচিতি পেয়েছেন তাদের একটা বড়ো পার্থক্য, আন্তত আমার মতে, এই যে পূর্বের পন্ডিতেরা বৈদেশীয় ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করতে সমর্থ্য ছিলেন। পরবর্তীরা শুধু অক্ষম ছিলেন তাই নয়, তারা অধিকাংশ সময় বিষয়বস্তুর ভুল পাঠ করেছেন।

আমার মতে এটা হতে পেরেছে কিতাব সর্বস্ব এবং অনুবাদ নির্ভর বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার কারনে। বৈদেশিক ধ্যান-ধারণা দ্বারা পূর্বের পন্ডিতেরাও প্রভাবিত ছিলেন। বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবার ঘটনা স্বাভাবিক ও বৈশ্বিক প্রক্রিয়া। কিন্তু তাঁদের সফলতা এই যে তাঁরা বৈদেশিক ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করে তাকে দেশীয় কায়দায় উপস্থাপন করে সমর্থ হয়েছিলেন।

এ কারনেই দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের কিতাব পড়ে অন্তত এতোটুকু বোধ হয় যে এই ব্যক্তি সন্দেহাতীত ভাবে কাবিল। কোন বুজরুক বা মূর্খ বৈদ্য নয়। এটা বুঝবার একটা কায়দা হলো এই সমস্ত পন্ডিতদের লেখা সামঞ্জস্যপূর্ণ। বয়ান সুস্পষ্ট। কোনটা তাঁদের নিজস্ব চিন্তা, কোনটা আহরণকৃত তা বুঝতে তেমন বেগ পেতে হয়না। বিপরীত পক্ষে পরবর্তীদের রচনা ও ভাষণ কর্ম অধিকাংশই খাপ-ছাড়া, এলোমেলো, সর্ববিধ। বরঞ্চ অনেকেই বিদেশী লেখকদের রচনা শৈলী ও চিন্তাধারা চুরি করে কাবিল সাজার দোষে দুষ্ট।

এটা এমন মহামারী আকার ধারণ করেছে যে এখন মূর্খ বৈদ্যেরা পন্ডিতদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। এবং এই নিয়ে সমাজে কোন উচ্চবাচ্য দুরে থাক, বুজরুকেরা পন্ডিত হিসেবে স্বীকৃতি পর্যন্ত পাচ্ছে। একারনেই পলাশীর ছুতোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাবিল এবং চিকিৎসা বিদ্যায় ডিগ্রী নেয়া মিডিয়া ব্যক্তিদ্বয় কর্তৃক সোফির যৌথ ধর্ষণ চর্চা সমাজে ব্যাপক স্বীকৃতি পেতে পেরেছে। কিন্তু তার চাইতে ভয়াবহ যেটা, তা হলো সাধারণের নিকট দর্শন শাস্ত্রের একটা লালন শাহী - গাঁজাখুরি - ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যে কারনে যে কোনভাবে হেঁয়ালী কথাবার্তা বলেই সমাজে দার্শনিক, জ্ঞানী, হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার সহজিয়া রাস্তা তৈরী হয়েছে।

ফলক্রমে দর্শনশাস্ত্র ও দার্শনিকদের প্রতি, আলিম বা জ্ঞানীদের প্রতি, বাস্তববোধ সম্পন্ন মানুষদের অনীহা, অশ্রদ্ধা ও অনাস্থা তৈরী হচ্ছে। আর এটা হচ্ছে বলেই গভীর জীবন দর্শন চর্চা, জ্ঞান চর্চার মাধ্যম ও পদ্ধতি সম্পর্কে মৌলিক প্রশ্ন করে তার উত্তর খোঁজার প্রবণতা কমে আসছে। ফলস্বরুপ মতবাদী (ideological) ধ্যান-ধারণা মানুষের মনে বদ্ধমূল হচ্ছে। মানুষকে বিপথগামী করে তুলছে।

ঠিক এই কারনে অনুবাদ ভিত্তিক ও কিতাব সর্বস্ব বুদ্ধিবৃত্তি চর্চায় আমার ঘোর আপত্তি। কেননা আমার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের যে অন্ধ বিশ্বাস তৈরী হয়েছে, আধুনিক যেকোন প্রবণতাকে অনুকরণ ও ধারণ করবার যে সর্বনাশা রীতি প্রতিষ্ঠা পয়েছে তা সম্ভব হয়েছে মূলত এই দুটো কারনেই।

অথচ ইসলামের ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে মুসলিম সমাজে জ্ঞান বিতরণের প্রধান মাধ্যম ছিলো মৌখিক। খোদ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছিলো মৌখিকভাবে। এর প্রাথমিক চর্চা এবং এর প্রচার বহুলাংশে হয়েছে মুখে মুখে। ইসলামী জ্ঞান চর্চা ঐতিহাসিকভাবে একটা কথ্য ঐতিহ্য (oral tradition)।

এই ধারায় কিতাব লিখিত হয় সংরক্ষণের স্বার্থে। কিন্তু কিতাব জ্ঞান চর্চার মূল মাধ্যম নয়। এ কারনেই যাঁরা হাদীসের দীক্ষা নেন তাঁদের অনেকের হাদীসের ধারা বর্ণনার ক্রম তাঁর নিজের থেকে শুরু করে স্বয়ং আঁ হযরত পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। অর্থাৎ আমি শুনেছি আমার শিক্ষক অমুক থেকে, যিনি তাঁর শিক্ষক তমুক থেকে ... এভাবে।

এই ধারায় কিতাব পাঠের মূল মাধ্যমও মৌখিক। অর্থাৎ প্রজন্মান্তরে নির্দিষ্টি কিতাব সমূহ চর্চিত হয় মৌখিকভাবে। হানাফি কিতাব পড়তে চাচ্ছেন? আপনাকে এমন একজন শিক্ষক খুঁজে বের করতে হবে যিনি এই কিতাব রপ্ত করেছেন তাঁর শিক্ষক থেকে এবং সেই শিক্ষক তাঁর শিক্ষক থেকে, এভাবে করে একদম সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠ অর্থাৎ আস-সালাফ আস-সালেহীন - দের সময়ের শিক্ষক পর্যন্ত।

অর্থাৎ কোন যদু-মধু বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের চিপায় বসে মঁ-পাছা আত্মস্থ করে ফেলবার সুযোগ নাই। আরবী থেকে উর্দু অনুবাদ কর্ম এবং সেই উর্দু অনুবাদ কর্ম থেকে বাংলা অনুবাদ করা এহইয়া উলূম আদ-দ্বীন পড়বার বিপদ অনেক। তদ্রুপ রাশিয়ান থেকে ইংরেজী অনুবাদ করা অনুবাদ কর্ম এবং সেই ইংরেজী অনুবাদ কর্ম থেকে বাংলা অনুবাদ করা দস্তয়েভস্কির সাহিত্য কর্ম নিয়ে যতই ধস্তাধস্তি করা হোক না কেন তা মূল সাহিত্য কর্মের বার্তাটি পৌছাতে ব্যর্থ হতে বাধ্য।

ইসলামী শিক্ষার ঐতিহ্যবাহী ধারায় শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে একেবারে বাক্য ধরে ধরে বোঝান। এটা হালের তথাকথিত ক্রিটিকাল থিকিং শিক্ষা পদ্ধতির একেবারেই বিপরীত। হাল ফ্যাশন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রদের চিন্তা করতে শিখবার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তাদের লাগামহীন ভাবে কিতাব পড়ার ও পঠিত কিতাবের মনগড়া অর্থ করে নেয়ার সর্বনাশা চর্চা।

এদের মতে বিশ্ববিদ্যালয় পাঠশালা নয়। জ্ঞান তৈরীর কেন্দ্র। তাই শিক্ষকেরা বনানীর রাস্তায় রাস্তায় কিংবা পার্টি অফিস বা মিডিয়া পাড়ায় সারাদিন ঝোলা নিয়ে ঘুরে, টকশো করে, দিন শেষে ঝোলা ভর্তি করে যখন ফুলার রোডের টাট্টিখানায় ফিরে যান তখন তার একমাত্র কাজ থাকে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মুন্ডুপাত করা কিংবা দেশ-রাজনীতি রসাতলে যাচ্ছে বলে চেঁচানো। অর্থাৎ যে টাট্টিখানায় তিনি দিনভর কর্ম সম্পাদন করেন, সেটা যে শৌচকর্মের কতোটা অনুপোযুক্ত তা নিয়ে খিস্তি খেউড় করা।

এখানে স্পষ্ট করা দরকার যে অনুবাদ কর্মের গুরুত্ব-কে অবহেলা করা অত্র প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। তা কাঙ্খিত-ও নয়। অনুবাদ কর্মে যে অন্তর্নিহিত জটিলতা অর্থাৎ লেখকের মূল চিন্তাকে ধারণ ও ব্যক্ত করবার যে চ্যালেঞ্জ তা-ও আমার মূল প্রতিপাদ্য নয়; আমার মূল প্রতিপাদ্য বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার ক্ষেত্রে সার্বিক অবনতি, এর কারন ও প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা করা।

অযোগ্যদের পন্ডিতের ভান ধরবার এই মহামারীর খুব সম্ভব একটা ভালো উদারহণ হলো কাহলিল জিব্রানের The Prophet। এর একটা লাইন এমন:

Your children are not your children. They are the sons and daughters of life longing for itself.

এর বাংলা অনুবাদে দেশের জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া এক অপদার্থ লিখেছে:

তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়। তারা জীবনের সন্তান।

এই অনুবাদের জন্য ঐ কথিত অধ্যাপকের একটা উসমানীয় থাপ্পড় (Ottoman Slap) প্রাপ্য ছিলো।

অথচ এক বড়ো ভাইয়ের সূ্ত্রে এদেশেরই এক অখ্যাত ব্যক্তির অনুবাদকর্ম দৃষ্টি গোচর হয়:

তোমাদের সন্তানেরা তোমাদের নয়। তারা জীবনের সন্তান। জীবনেরই তরে।

এই যে শেষের বাক্যটা, এটাই longing for itself এর মর্মার্থকে ধারণ করতে পেরেছে। উল্লেখ্য এ দুয়ের কোন অনুবাদ-ই আমার হুবহু স্মরণে নেই। তবে এই বিষয়টা আমার মনে তখনই গেঁথে গিয়েছিলো। অখ্যাত ব্যক্তির অনুবাদও পদ্যের ছন্দে বেশ সাবলীল মনে হয়েছিলো।

অর্থাৎ অযোগ্য ও দূষিত ব্যক্তি কর্তৃক বিদ্যাচর্চার হাল ধরা একটা বিরাট অবক্ষয়। যার কারনে অনুবাদ, তা-ও দুষ্ট, ও পাঠ সর্বস্ব অপসংস্কৃতির প্রসার হতে পরেছে। পেরেছে বলেই আমরা দেখি ইউরোপীয় ও অন্যান্য বৈদেশিক সমস্যা সমূহকে আত্মস্থ করবার একটা বিকৃত স্বভাব। অর্থাৎ বিদেশী ধ্যান-ধারণা সমূহের উৎপত্তি ও প্রসারের  পেছনের কার্যকারনের সুলুক সন্ধান না করে, সেই সকল ধ্যান-ধারণার বিকৃত পাঠ ও বৈদেশিক সমস্যা সমূহের সাথে স্থানীয় সমস্যার একটা ব্যাখ্যাতীত যোগসূূত্র স্থাপন করে, বিদেশী চিন্তার ছকে (paradigm) দেশীয় সমস্যার বিদেশী রুপ দিয়ে বিদেশী কায়দায় তার সমাধান করবার একটা ভজকট পদ্ধতি।

আমার মতে ইসলামের বিরুদ্ধে, এদেশে ইসলামের প্রায় সহস্র বৎসর ব্যাপী যে জাঁকজমকপূর্ণ ঐতিহ্য - তার বিরুদ্ধে বিষোদগারের মূলে এটাই।

ধরেন আপনি ফুলার রোডের টাট্টিখানার কাবিল। গিয়েছেন দেশের বাড়ি, অর্থাৎ গ্রামের বাড়ী। গ্রামে আপনার মূর্খ-চাষা ভাইটি তার সাধ্যমতো খানা পাকিয়েছে আপনার জন্য। আপনি খুশী হয়ে তাকে "ধন্যবাদ" দিলেন। সে-ও খুশী, তবে তৃপ্ত নয়। সে বলল, আমি ওসিলা মাত্র খাওয়ানোর মালিক মহান আল্লাহ।

এই যে কথায় কথায় আল্লা-রসুলের নামে দর্শন চর্চা এতে-ই আপনার ক্ষোভ। এটা দর্শন হলো? কাজ করলাম আমি আর শোকর করবো আল্লাহর? যখন চিকিৎসার অভাবে আমার সন্তানটা মারা যায়, তখন এতো দোয়া করে, তাহাজ্জুদ পড়েও কাজ হয় না কেন? অথচ ঘুষ খোর, তাহাজ্জুদী আমলাটা সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করে ক্যান্সার সারিয়ে এসে আবার আমাকে-ই খোঁটা দিচ্ছে, হালাল কামাই দোয়া কুবল হবার পূর্ব শর্ত।

দুনিয়া যখন বিজ্ঞান চর্চায় অসম্ভবকে সম্ভব করছে, তখন আপনার ভাই-টি আছে ধর্মের নামে অপদর্শন চর্চায়। সে দর্শনের কি বোঝে? সে-কি আপনার মতো ফুকো নিয়ে নকল থিসিস করেছে? এ্যাঁ?

সে যাক। স্যাটায়ারে না যা-ই। খুব ফযীলত হবে।

বলতে চাচ্ছিলাম যে দর্শন চর্চার জায়গির নেয়া এসব আঁতেলেরা এটা বুঝতে ব্যর্থ যে, গ্রাম বাংলার এবং বিশ্বজুড়ে মুসলিম জাহানের সাধারণ মানুষের এই যে জীবন দর্শন, যে তারা ক্রিয়ার মূল নয়, উসিলা মাত্র, এটা-ই পাশ্চাত্যিয় দার্শনিকদের-বিজ্ঞানীদের কথা। এটাই ইম্যানুয়েল ক্যান্টের কথা। হিউমের কথা।

ছোটবেলায় "স্বল্পশিক্ষিত" মওলানাদের মুখে কত শুনেছি, এই যে আমি নলা ধরে খাবার তুলে মুখে পুরছি আমি এর মূল কর্তা নই। এর মূল কর্তা মহান আল্লাহ পাক। যে মূহুর্তে তিনি এর বিপরীত ইচ্ছা করবেন, সেই মূহুর্তে আমার শত চেষ্টায়-ও আমার হাত আমার মুখে পৌঁছবেনা।

বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী হিউম কি এই কথা-ই বলেন নি? আমার মতে তিনি একথাই বলেছেন। তবে তাঁর নিজস্ব কায়দায়। ইউরোপীয় কায়দায়। রেনেসাঁ উত্তর চিন্তা কাঠামোয়। এ কারনেই তিনি স্পষ্ট করেছেন, হতাশা ব্যক্ত করেছেন যে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রচ্ছন্ন অনুমান কাঠামো সমূহের সত্যতা প্রমাণ করা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্ভব নয়।

অর্থাৎ আপনি ম্যাচ বক্সে কাঠি ঘষে আগুন জ্বালাচ্ছেন। এখানে দুটো ঘটনা। কাঠি ঘষা। আগুন জ্বলা। কিন্তু এই যে আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাঠি ঘষাকে আগুন জ্বলার কার্যকারণ হিসেবে ধরে নিয়েছেন - তা কিন্তু আপনি প্রমাণ করেন নি। এটা সম্পূর্ণ আপনার অনুমান। এবং এই অনুমান প্রতিষ্ঠা পেতে পেরেছে আপনার ও অন্য আর সকলের অভিজ্ঞতা থেকে। অভিজ্ঞতা যা কিনা ঐন্দ্রিয় দ্বারা সীমাবদ্ধ।

এ কারনেই আপনি যতো সহস্রবার কাঠি আগুন জ্বলতে দেখেন না কেনো, এবং এর যতো গভীর থেকে গভীরতর ও বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করান না কেন, তা কখনই এই নিশ্চয়তা দেয় না যে অতীতে অসংখ্যবার কাঠির ঘষায় আগুন জ্বলেছে বলেই ভবিষ্যতেও তা ঘটবে।

এ কারনে আল-কোরআনের আয়াতে যখন বলা হলো, যে মানুষ ফিকির করুক যে মহান আল্লাহ তাকে কোত্থেকে তৈরী করেছেন। তাকে তৈরী করা হয়েছে সম্মুখে সজোরে নিক্ষিপ্ত পানি (বীর্য) থেকে; তখন এক পর্যায়ে আমার মনে এই বোধদয় তৈরী হলো যে আসলে আমরা প্রকৃতি বা আল্লাহর তৈরী নিয়মে অভ্যস্ত। অভ্যস্ত বলেই আমরা ধরে নিয়েছি যে বীর্য আর ডিম্বের জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়ায় ভ্রুণের উৎপত্তি। কিন্তু যদি আল্লাহ চাইতেন, তাহলে শস্যক্ষেতে পানি ছিটালে সেখান থেকেও আদম সন্তান তৈরী করবার রীতি তিনি চালু করতে পারতেন এবং আমরা তখন তাতেই অভ্যস্ত হতাম, এখন তা যতো উদ্ভটই মনে হোক না কেন।

মানব কর্মের ঠিক এই বিষয়টাই হিউমকে হতাশ করে তুলেছিলো। যা ক্যান্ট কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার স্বল্প পাঠে মনে হয়েছে, ক্যান্ট হিউমের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে গিয়ে আরও বিরাট গোলযোগ তৈরী করেছেন। এবং তা রেনেসাঁ উত্তর সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর সম্বন্ধীয় ধারণার প্রতি ঘাউড়ামীর কারনেই। অর্থাৎ হিউমের বিপরীতে গিয়ে তিনি বলছেন যে মানুষের স্বাধীন চিন্তা (Freewill) আছে। তবে স্বাধীন চিন্তা শক্তির উৎপত্তি এই ভূয়োদর্শনলব্ধ জগৎ (empirical world) থেকে পৃথক কোন জগতে। সমস্যা হলো তাঁর মতে স্বাধীন চিন্তা শক্তি ভূয়োদর্শনলব্ধ জগতে কার্যকারণের ধারাবাহিকতা তৈরীর পরের সমস্ত ঘটনা এই জগতের বৈজ্ঞানীয় সূ্ত্রের অমোঘ নিয়মে পরিচালতি হয়। তার বাইরের যাবার ফুসরত নেই।

অর্থাৎ ভূয়োদর্শনলব্ধ জগতের বাইরেও যে জগত আছে তা তাঁদের কাছেও স্পষ্ট হয়েছিলো। তথাপি ধর্মীয় চিন্তা কাঠামোয় তা ব্যাখ্যা করবার প্রচেষ্টাকে তাঁদের নিকট বাখিল্য মনে হয়েছিলো।

এই ব্যাপারটি দেশের পক্ষপাতদুষ্ট, অসৎ, নিষ্ঠাহীন, অযোগ্য, ব্যক্তিবর্গের পক্ষে ঠাহর করা সাধ্যাতীত। কারন এরা বুদ্ধিবৃত্তিক ও চারিত্রিক উভয় দিকেই দুর্বল। প্রথমত সত্য উপলব্ধি করবার মতো মেধা ও বিশুদ্ধ অন্তর এদের নেই। দ্বিতীয়ত অলৌকিকভাবে যদি সত্য তাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়েই যায়, তথাপি তাকে ধারণ করবার মতো চারিত্রিক দৃঢ়তা এদের নেই। আর এরাই দেশের দুরাবস্থার সুযোগে পান্ডিত্যের কান্ডারী হয়ে উঠেছে।

এখানে একথাও বলা প্রয়োজন যে যদিও বক দার্শনিকদের সোফিগিরী চর্চার জন্য আমি কঠোরভাবে লিখেছি তথাপি আমি এমন কঠোরতার সমর্থক নই। আমার মুল ক্ষোভ এদের দর্শনের সস্তা চর্চায় নয় বরং সস্তা দর্শন চর্চা করে নিজেকে বিরাট দার্শনিক-কাবিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার অসৎ প্রচেষ্টার প্রতি।

এটা বলা প্রয়োজন এ কারনে যে জ্ঞান চর্চার স্তর অনেক। প্রতি স্তরে একই ভাবে, একই মানে, একই গভীরতায় তা চর্চিত হয়না। হওয়া সম্ভব নয়। ইসলামী জ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রেও যদি দেখেন, দেখবেন এখানে মাওলানা মওদূদীর ﵀ মতো পন্ডিতের অবদান যেমন আছে, তেমন মাওলনা সাঈদীর ﵀ মতো বাগ্মীর অবদানও আছে।

বরঞ্চ আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশে ওয়াজ-মাহফিলের সংস্কৃতি, গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের পুরনো পুঁথি পাঠের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ কোন চিন্তক সমাজ-জীবন প্রভৃতি নিয়ে চিন্তা করলেন। তিনি তা নিয়ে গুঢ় ত্বত্তকথা লিখলেন। কোন কবি সেই ত্বত্তকথা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গল্প-কবিতা লিখলেন। লোকজ যাত্রাপলা-পুঁথিপাঠের বক্তা-অভিনেতারা সেটাই জনগণের মাঝে তুলে ধরলেন।

এর প্রতিটি স্তরের কর্মই আবশ্যকীয়। কেননা মওদূদীর ﵀ যে কাজ করেছেন তিনি তাঁর চাইতে অধিক একাডেমীক যারা কিনা জনপ্রিয় ধারায় লিখে অভ্যস্ত নয় কিন্তু বিষয়বস্তুর পাঠ ও সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণে পারঙ্গম - তাঁদের কর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

এ কারনে সাধারণ মানুষের জ্ঞান চর্চার প্রবণতাকে আমরা যদি হেয় করি তখন মানুষ লজ্জায়, বেকুব প্রতিপন্ন হবার ভয়ে জ্ঞান চর্চা, ধর্ম চর্চা থেকে দুরে সরে যাবে। বিপরীত পক্ষে জ্ঞান চর্চা ও এর সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করা হলে অবধারিত ভাবে বেকুবেরাও কথা বলবে। পন্ডিতদের সেক্ষেত্রে একই সাথে সহনশীল ও সজাগ থাকতে হবে। সহনশীল হতে হবে নিরীহ বেকুবদের প্রতি আর সজাগ থাকতে হবে যেনো বুজরুকেরা এই সুযোগে পন্ডিত সেজে বসতে না পারে।

Popular posts from this blog

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

ইসলাম ও গণতন্ত্র

জামাতের ভোট: একবারে না পারিলে দাও শতবার