সালাম
বাংলাদেশের মানুষ এক সময় সালাম দিতে কিংবা নিতে জানতো না। বরং জাত-বাংলার বদঅভ্যাসের মতো এই ইসলামী সম্ভাষণকেও বিকৃত করা হয়েছে। কোন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তার অধীনস্ত কাউকে ডেকে পাঠাতে চাইলে পিয়ন গিয়ে বলে, "অমুক স্যার আপনাকে সালাম দিয়েছেন"। তার জবাবে কেউ বলেনা, "আমার পক্ষ থেকে ওনাকে ওয়ালাইকুম সালাম জানিয়ে দিয়েন"। সবাই এর অর্থ ধরে নিয়েছে যে তাকে ডেকে পাঠানো হচ্ছে।
এরকম ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা মুমিনের কাজ নয়। মুনাফিকের কাজ। বিলাতীরা এবং বিলাতের ইংরেজী এই ধরনের। কোন কথা এরা সরাসরি বলবে না। বলবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে। কিন্তু আমেরিকানরা এরকম নয়। তারা স্পষ্টবাদী। তাই বলে তারা অসভ্যও নয়। সভ্যতা বজায় রেখেই তারা কথা বলে কিন্তু কথাকে জিলাপীর মতো প্যাঁচায় না। এ কারনে আমি আমেরিকান ইংরেজীর বেশ ভক্ত। এ ধরনের আরও অন্যান্য গুণের জন্যও আমি তাদের বেশ ভক্ত। কিন্তু সে ভিন্ন কথা।
শরীয়তে সালাম দেয়া সুন্নত। কিন্তু সালামের উত্তর দেয়া ওয়াজিব। কেউ যদি আপনাকে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, "ভাই কেমন আছেন?" আর আপনি যদি উত্তর না দিয়ে চলে যান তবে তা অভদ্রতা বলে গণ্য হয়। কিন্তু দেশে সালামের এমন বিকৃত চর্চা শুরু হয়েছে যে ধরে নেয়া হয় মুরুব্বীরা সব সময় সালাম প্রাপ্য। তারা কখনও সালাম দেয় না। দেয়াটা তাদের সম্মানের বরখেলাপ। আবার দেখা যায় কর্মস্থলের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কখনও তার অধীনস্তদের সালাম দেন না। সবাই ব্যক্তিগতভাবে আলাদা করে তাকে সালাম দেয় উনি উত্তর না দিয়ে গোমড়া মুখ করে থাকেন। কখনও হাত নাড়িয়ে, কখনও মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম "নেন"। জাহেলিয়াত কাকে বলে!
আর এখন এমন শুরু হয়েছে যে সাইকেল চালানোরত অবস্থায় একজন আরেকজনকে সালাম দেয়! আমার মনে হয় এখন জাত-বাংলারা পায়খানায় ঢুকেও একে অপরকে সালাম দেয়। অথছ সালাম দেবার আদবের একটি হলো যে অপরকে সালাম দেবার সুযোগ দেয়া। তার যদি সালাম দেবার সুযোগ না থাকে তাহলে সালাম না দেয়া। কারন, পূর্বেই বলা হয়েছে, সালাম দেয়া সুন্নত, কিন্তু নেয়া ওয়াজিব। দেয়া বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু নেয়া প্রায় বাধ্যতামূলক। আপনি অপর মুসলমানকে সালামের উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে তাকে দোষী করে দিচ্ছেন। এই অধিকার আপনার নাই।
সালাম সবাই সবাইকে দিতে পারে। ছোটরা বড়োদের। বড়োরা ছোটদের। উর্ধ্বতনরা অধস্তনদের, অধস্তনরা উর্ধ্বতনদের। সেক্ষেত্রে যিনি আগ বাড়িয়ে সালাম দেবেন তিনি-ই বেশী নেকীর অধিকারী। তবে সালাম দেবার পূর্বে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করাও প্রয়োজন। যা পূর্বে উল্লেখ করেছি।
এক ব্যক্তির সাথে একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাত হলে ঐ ব্যক্তি সালাম দেবেন। বাকীরা উত্তর দেবেন। এটাই আদব। একাধিক ব্যক্তির সাথে একাধিক ব্যক্তির সাক্ষাত হলে দুইয়ের পক্ষ থেকে দুইজন ব্যক্তি সালামের আদান প্রদান করা যথেষ্ট বলেই মনে হয়। নিজেরা নিজেদের মতো করেও সালাম আদান প্রদান করে নেয়া যায়।
সালাম কথোপকথন শুরুর মাধ্যম হতে পারে। কারও সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন? সালাম দিয়ে শুরু করতে পারেন। কাউকে ডাকতে চাচ্ছেন? সালাম দিতে পারেন। যেসব বান্দীর পয়দারা এখন নবাব হয়েছে এদেরকে প্রায়ই শুনি কাউকে ডাকতে গেলে, "এই এই, অই অই" এভাবে ডাকে। মুতখোরের পয়দাদের কথার ঢঙেও মুতের গন্ধ পাওয়া যায়। তবে যারা মুতের গন্ধে অভ্যস্ত তারা এটা বুঝতে পারেনা।
সালাম আরবী সম্ভাষণ নয়। এটি একটি ইসলামী সম্ভাষণ। তার প্রমাণ আমরা পাই ঐ হাদীস থেকে যেখানে একজন বেদুঈন এসে নবীজি সা: কে "সুপ্রভাত" বলে শুধোলেন। নবীজি সা: তাকে বললেন মহান আল্লাহ আমাদের মুসলমানদের এর চাইতে উত্তম জিনিস শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা একে অপরের সাথে সাক্ষাতে সালাম বিনিময় করি।
বাংলাদেশের সেকুলাঙ্গারীর এক ভং হলো "শুভ সকাল" ইত্যাদি বলা। এটাই তাদের শয়তানীর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ যে একদিকে তারা মুসলানদের পরস্পরের সাথে সালাম আদান-প্রদান করাকে নিরুৎসাহিত করে। বিপরীত পক্ষে বিধর্মীদের সালাম দেবার জন্য মুসলমানদের উপর চাপ তৈরী করে বা বাধ্যবাধকতা তৈরী করতে চায়। অথচ বিধর্মীদের সালাম দেবার বিধান শরিয়তে নেই। পবিত্র কোরআনে যাদের "অভিশপ্ত" (ইহুদী) ও "পথভ্রষ্ট" (খ্রীস্টান) বলা হয়েছে তাদের জন্য আবার কিভাবে শান্তি কামনা করা যায়? আর আহলে কিতাবদের ব্যাপারে যদি এই হুকুম হয় তবে অন্যান্য ধর্মীয়দের, মালাউনদের জন্য - তা সে হিন্দু ধর্মালম্বী হোক কি মুসলমান নামধারী - জন্যতো সে বিধান আরও কঠোরভাবে অনুসরণ করার কথা। বরং আমার বিবেচনায় একজন জন্মগত হিন্দু সেইসব নামধারী মুসলানদের চাইতে কম অভিশপ্ত যারা মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও দ্বীনের হেদায়াত লাভ করতে পারেনি। মহান আল্লাহ যেনো এমন গোমরাহীর পথ থেকে আমাদের রক্ষা করেন। তবে কোন বিধর্মী যদি সালাম দেয় তার উত্তরে "ওয়াʿআলাইকুম" বলার বিধান আছে। ব্যস অতোটুকুই।
কারও অবস্থা সম্পর্কে না যেনে "শুভ সকাল" ইত্যাদি বলার বিপদ হলো যাকে "শুভ সকাল" বলা হচ্ছে তার জন্য সেটা "শুভ" নাও হতে পারে। হয়ত তার সকাল শুরুই হয়েছে বিপদাপদ দিয়ে। তাহলে তাকে এই বলে সম্ভাষণ করা তার সাথে মশকরা নয় কি? কিন্তু সালাম দোয়া বিশেষ। কারও বিপদে বললে তা আশীর্বদা বা দোয়া বলে সমাদৃত। আমরা অনেক সময় বলি, "ভাই দোয়া করিয়েন"। কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে দোয়া চাইলে তা নির্দিষ্ট করা উচিত। অন্যথায় সাধারণভাবে দোয়া চাইবার চাইতে আমার মতে সালামের আদান প্রদান করাই যথেষ্ট।
এক সময় দেশে সঠিক উচ্চারণে সালাম দেবার চল খুব কমই ছিলো। এখন তা বেড়েছে। এটা ভালো দিক। তবে এখনও অনেককে, "স্লাঁমালিকুম" বলতে শোনা যায়। সঠিক উচ্চারণ একটি জটিল ও ব্যাপক বিষয়। নিজ মাতৃভাষায়ও অনেকের পক্ষে সঠিক উচ্চারণে কথা বলা দুষ্কর হয়ে যায়। এখানে সঠিক বলতে মান ভাষা বোঝাতে চেয়েছি। কারন যারা আঞ্চলিক ভাষায় বলেন আঞ্চলিকতার মানদন্ডেতো সেটাই সঠিক। তাহলে প্রশ্ন ওঠে এক আমেরিকান এর নিকট থেকে কি করে ফরাসী শব্দের ফরাসীদের মতো সঠিক উচ্চারণ প্রত্যাশা করা যেতে পারে? কিংবা এক ভাষার লোকের মুখে অন্য ভাষার শব্দের সঠিক উচ্চারণ প্রত্যাশা করা যেতে পারে।
এর বিপরীতে এই প্রশ্নও আসে যে তাহলে বিদেশী ভাষার কোন শব্দ কি দেশীয় মানদন্ডে উচ্চারণ করবার সুযোগ নেই? কিন্তু সেই প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েও এই কথা বলা যায় যে দীর্ঘদিনের ব্যবহারে এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় বিবর্তিত ও আত্মস্থ হয়। একারনেই আমরা Table এর সহীহ উচ্চারণ করিনা। বলি টেবিল। অর্থাৎ টেবিল এখন আর ইংরেজী শব্দ নাই। এটা এখন বাংলা শব্দ।
তাহলে আবার প্রশ্ন আসে "স্লাঁমালিকুম", বা "আসলামালিকুম", বা (মিনমিনিয়ে) "আছড়ামারুম" - এ কি সমস্যা। সমস্যা এই যে এই শব্দের একটি ধর্মীয় মর্যাদা আছে। তাছাড়া এই উচ্চারণ মূল উচ্চারণ এর একেবারে বিকৃতরুপ। এটা বিকৃত বলে বিবেচিত এই জন্য যে "আস্-সালামু" উচ্চারণ করাটা বাংলাভাষীদের জন্য মোটেও দু:সাধ্য নয়। যদিও "ʿআলাইকুম" - এর হিসাবটা ভিন্ন। কারন এখানে ʿআইন (ع) এর ব্যবহার আছে। আর এমন ধ্বনি বাংলাতে নেই। তাই তার সঠিক উচ্চারণও বাংলাভাষীদের জন্য সাধারণত সম্ভব হয় না। সুতরাং কেউ যদি "আস্-সালামু-ʿআলাইকুম" এর বদলে "আস্-সালামু-আলাইকুম" বা "আস্-সালামুয়ালাইকুম" বলে তা গ্রহণ যোগ্য হতে পারে, কিন্তু "স্লাঁমালিকুম" বা "আস্লামালিকুম" কিছুতেই নয়।