বৈপরীত্যের প্রকারভেদ এবং মানবীয় বৈপরীত্য

একটা সময় দেশীয় বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে বিদেশী, প্রধানত পাশ্চাত্যিয়, চিন্তাধারার ওপর ভর করে নিজেকে কাবিল প্রমাণ করতে প্রচেষ্ট লেখকেরা কিতাব লিখতেন, "অলৌকিক নয়, লৌকিক"। ধর্মের প্রসঙ্গে, আল্লাহর প্রসঙ্গে নিজেরাই যাচিত হয়ে শুধোতেন, "আল্লাহ কি এমন একটি পাথর সৃষ্টি করতে পারেন, যা তিনি নিজে ওজন করতে পারেন না?"। কিংবা, "আমি মিথ্যে বলছি" - এটা কি সত্য কথা না মিথ্যে কথা?

বলা বাহুল্য এগুলো বিদেশী চিন্তার চর্বিত চর্বন। আমার তাতে সমস্যা নাই। আমার সমস্যা কোথায় সেটা আগেও উল্লেখ করেছি। আমার সমস্যা হলো অপরের চিন্তা চুরি করে আইনস্টাইনের মতো একটা ভাব নেয়ায়। যেখানে নিজে অন্ধ-অনুকরনের দোষে দুষ্ট সেখানে প্রতিপক্ষের প্রতি গোঁড়ামীর অভিযোগ এনে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। নাই বাঘ বনে শিয়াল রাজার মতো।

একটা জাত-বাংলা জ্বালানি ছাড়া গাড়ী আবিষ্কারের দাবী করুক। আমার আপত্তি নাই। এরকম অপদার্থের মতো কথা একটা জাত-বাংলার মুখেই মানায়। কিংবা ঐ আবুলটার মতো মৌলবাদের অর্থনীতি "আবিষ্কারের" দাবী করে নিজেকে এডাম স্মিথ এর সম-পর্যায়ের কিছু ভাবা শুরু করুক। আমার তাতেও আপত্তি নাই। ডানিং-ক্রুগার ত্বত্তানুসারে প্রতিটি বলদ নিজেকে একমাত্র কাবিল ভাবে। বাকি সবাইকে ভাবে বলদ। আমি বরং এই ভেবে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি, নিজেকে আর্কিমিডিস প্রমান করতে গিয়ে নেংটো হয়ে রাস্তায় নেমে সে যে "পেয়েছি! পেয়েছি!" বলেনি।

এখন কম্পিউটার বিজ্ঞানের আজীবন ছাত্র হিসেবে এবং যুক্তিশাস্ত্র, ইতিহাস, দর্শন, ও ভাষাত্বত্তের ব্যাপারে নিজের আগ্রহের কারনে জানতে পেরেছি যে পারস্পরিক বৈপরীত্যপূর্ণ এ সকল বাক্য প্রধানত বিলাতের একটা নির্দিষ্ট সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডের ফসল। বার্ট্রান্ড রাসেল বিশেষত সে সময়ের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য নাম।

একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার যে ভাষাত্বত্তে আমার কোন আগ্রহ নেই। তবে মানুষ কি ভাবে বিচিত্রসব  ধ্বনির উচ্চারণ করে, একটা মূর্খ, এমনকি বোকা লোকও কি অবলীলায় এসকল জটিল কাজ করতে পারে তা আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে। বিশেষ করে প্রযুক্তি সংক্রান্ত পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতা থাকায় কম্পিউটার সিস্টেম, রোবোটিকস - ইত্যাদি সম্পর্কে মৌলিক ধারণা থাকায় এই সমস্ত বিষয়ের ঠুনকো কর্মকৌশল ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর থেকে প্রাণী জগতের সবচাইতে সহজ কাজটিও আমার কাছে জগতের বিস্ময়, অলৌক বিষয়, মোজেজা বলে মনে হয়। এখানেই আমার আগ্রহ। ভাষাত্বত্তে নয়। এর কোন সমার্থক শব্দ জানা নাই বলে এটাই ব্যবহার করতে হলো।

তো কথা হলো বার্ট্রান্ড রাসেলিয় এই বুদ্ধি বৃত্তি চর্চার উৎস এই ধারণা থেকে হয়েছে যে যদি আমরা মানবজাতির ভাষার ব্যবহারকে সংশয় মুক্ত এবং দ্ব্যর্থহীন করে তুলতে পারি তাহলে জীবন সম্পর্কে, জগৎ সম্পর্কে আমাদের বৈপরীত চিন্তাসমূহের অনেকগুলোর মধ্যেই সামঞ্জস্য বিধান করা যাবে, অনেকগুলো আপনা থেকে লোপ পাবে, এবং এই করে Grand Unifying Theory এর মতো জীবনের একটা সার্বিক ধারণা আমরা লাভ করতে পারবো।

বার্ট্রান্ড রাসেলের এই ধারার সবচাইতে উজ্জ্বল নক্ষত্র ও তাঁর ছাত্র বিশ্বখ্যাত দার্শনিক উটজেনস্টাইন একদা রাসেলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, "আমাকে বলেন, আমি একেবারেই একটা অপদার্থ কিনা? যদি আমি অপদার্থ-ই হই তবে আমি একজন বৈমানিক হবো। আর নাহলে দার্শনিক।" উত্তরে রাসেল বলেছিলেন, "তোমার বৈমানিক হবার প্রশ্ন-ই আসেনা"। এটা খুব সম্ভবত ভাষার খেলার বা একটা বলে আরেকটা বোঝানোর বা ভাষার জটিলতার, সূক্ষতার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। কারন সরলার্থে একে উটজেনস্টাইনের মেধার প্রতি রাসেলের স্বীকৃতির মতো মনে হলেও, অনেকের মতে সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে, ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা উত্তরকালে, রাসেলের এই পরামর্শ আত্মকেন্দ্রিক উটজেনস্টাইনের বৈমানিক হবার ঝুঁকির ঈঙ্গিতবাহী।

এই যে ভাষা ভিত্তিক এই বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা, ভাষার পুঙখানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা এটা এই বিশ্বাস থেকেও যে মানুষের চিন্তা ভাষায় সীমিত। এই চিন্তা যে আমি যা বলতে পারিনা তা অস্তিত্বহীন। অথচ এই ধারার পরবর্তী বিশেষত মার্কিন ধারার পন্ডিতেরা বরাবরই উপলব্ধি করেছেন যে এমন অনেক বিষয় আছে যা আমরা ভাবতে পারি কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনা। তা না হলে কেন আমরা বলি যে "তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়"? উইটজেনস্টাইনও জীবনের শেষ দিকে এসে এটা উপলব্ধি করেছিলেন বলে প্রকাশ। আমেরিকার প্রথিতযশা ভাষাত্বাত্তিক নোয়াম চমস্কিও এই মতের সমর্থক যে মানব চিন্তা ভাষার অভিগম্য।

এখন কথা হলো বৈপরীত্যের প্রকারভেদ নিয়ে। আপনি আপনার স্ত্রীর পাকানো খাদ্য খেয়ে বিষম খাচ্ছেন। স্ত্রী শুধোলে তাকে বলছেন, "খু-উ-ব ভালো হয়েছে"। আপনার বলার ভঙ্গিতে, ঢং-এ তৎক্ষনাৎ আপনার স্ত্রী বুঝে গিয়েছেন যে রান্না স্বাদের হয়নি। এটা বৈপরীত্যের একটা প্রকার। এটা বোধগম্য। এমন বৈপরীত্য কেবল মানুষই ধারণ করতে পারে। রোবট নয়। কিন্তু আপনি বলছেন আপনি একজন "ধর্মনিরপেক্ষ মুসলমান", কিংবা "সেকুলার-ধর্মহীন মুসলমান" - এটাও বৈপরীত্যের একটা প্রকার। এটা অবোধগম্য। এমন বৈপরীত্য মানুষতো নয়-ই রোবট-ও ধারণ করতে পারেনা। কারণ রাসেলীয় ধারায় এটা কোন অর্থপূূর্ণ বাক্য নয়। কারন আপনি সামনের দিকে পেছাতে পারেননা।

অর্থাৎ আমরা বলতে চাচ্ছি এক কিসিমের বৈপরীত্য মূলক কথাবার্তা আছে যা কেবল অপদার্থের পক্ষেই বলা সম্ভব। এক কিসিমের বৈপরীত্য আছে যা যুক্তিশাস্ত্রের, রোবটের অবোধগম্য কিন্তু আদম সন্তান তা ধারণ করতে সক্ষম।

ভাষায় বৈপরীত্যের এই উপস্থিতি এবং এর থেকে দ্ব্যর্থবোধকতা দুর করবার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা ইসলামের একেবারে শুরুর দিকে পরিলক্ষিত হয়। এখানেই ইমাম শাফেয়ী রহ: ও ইমাম আবু-হানিফা রহ: এঁর মধ্যকার মুল পার্থক্য। ইমাম শাফেয়ী রহ: মুলত ভাষাতাত্ত্বিক। কিংবা এভাবে বলা চলে যে বার্ট্রান্ড রাসেল বা উইটজেনস্টাইন ইউরোপের ইমাম শাফেয়ী। ইমাম আবু-হানিফা প্রধানত প্রয়োগশাস্ত্রজ্ঞ। ভাষার বৈপরীত্যের চাইতে প্রায়োগিক বিধান কাঠামোর সামঞ্জস্য রক্ষা তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য।

হাল আমলের নজদি-ছালাফি মদনদের একটা সমস্যা হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বৈকল্য। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো নিজেদের আথারি দাবি করে, কোরানের ব্যাপকার্থক বা দুর্জ্ঞেয় আয়াত সমূহের অর্থ সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার প্রবণতা। যেই মূহুর্তে আপনি বলছেন যে "আল্লাহর হাত বলতে হাত-ই বোঝায়" সেই মূহুর্তে আপনি অর্থ যোগ করছেন বা আরোপ করছেন। আপনি আর আথারি নাই। কারন "আল্লাহর হাতের সাথে সৃষ্টিকুলের হাতের কোন সদৃশ নাই" - এটা একটা অপদার্থের মতো কথা। কেননা তখন ভাষায় "হাত" - এর সর্ব স্বীকৃত সংজ্ঞা ছেড়ে অন্য অর্থ আবিষ্কার করা হয়। অর্থাৎ যে হাতের সাথে সৃষ্টিকুলের হাতের কোন মিল নেই তা আসলে হাত-ই নয়।

বুদ্ধিমান পাঠক নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন এই জাতীয় আলোচনা-ই কি করে চক্রাকার তর্কে পরিণত হয়। এটাই অনুকরনকারী ও অনুসারীদের মধ্যে মূল পার্থক্য। অপদার্থেরা একদিকে যেমন গুড়ার্থের বৈপরীত্যকে ধারণ করতে অক্ষম, অন্যদিকে তাদের কর্ম অসামঞ্জস্যপূর্ণ-অর্থহীন-বৈপরীত্যপূর্ণ ভাষার দোষে দুষ্ট।

Popular posts from this blog

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

ইসলাম ও গণতন্ত্র

জামাতের ভোট: একবারে না পারিলে দাও শতবার