কথা

দুর্মুখ বাঙ্গালীর সবচেয়ে অপ্রিয় বিষয় কথা। মুখরা বাঙ্গালীর সবচেয়ে অপ্রিয় বিষয় কথা। কথায় বলে, কথায় চিড়া ভিজে না। বুভুক্ষ বাঙ্গালীর ভিজা চিড়া চাই। কারন ভিজা চিড়া ভক্ষণ করা যায় তাৎক্ষনিক। শুধু খাবেন। বাঙ্গালী শুধু খেতে চায়। আর বলতে চায়। করতে চায় না। শুনতে চায় না। অথচ খেতে চাইলে, করতে হয়। বলতে চাইলে, শুনতে হয়।

একজন ভালো কথক, একজন ভালো শ্রোতা। ‌তবে নিরব শ্রোতা মানেই ভালো শ্রোতা নয়। কারন ঘুমন্ত মানুষ-ও নিরব শ্রোতা। একজন ভালো শ্রোতা, একজন মনযোগী শ্রোতা। দুইজন ভালো শ্রোতায় একটা ভালো আলোচনা হয়। দুইজন মন্দ শ্রোতায় বাগ-বিতন্ডা হয়।

বাংলাদেশের তথাকথিত এক কথা সাহিত্যিক তাঁর নাটকের একটা চরিত্রকে দিয়ে বলিয়েছিলেন: থামলে ভালো লাগে। কিন্তু উনি নিজে থামতে পারেন নি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। উনি বলে চলেছিলেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এবং এই বলাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে উকৃষ্ট বলা নয়। কারন এই বলায় তাঁর মূর্খতা প্রকাশ পেয়েছে। এই বলায় তাঁর সস্তা, অগভীর, ও অসংলগ্ন চিন্তার বহি:প্রকাশ ঘটেছে। এ কারনেই তাঁকে বলা হয়েছিলো তাঁর রচিত কথা সাহিত্য, কথারই সাহিত্য। সত্য বটে।

তবে যিনি এই কথা বলেছেন, তিনি নিজে কুম্ভিলক। চিন্তা চোর। অন্যদের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে উনি নিজের পান্ডিত্য জাহির করতে চাইতেন। স্পষ্টত দাম্ভিক ছিলেন। তথাপি দম্ভ তার জ্ঞানের দৈন্যতার পরিপূরক হতে পারেনি। তার সমালোচনা মূলক কথা, তার বুজরুকি ঢাকতে পারেনি। যে বিষয়ে তিনি কথা বলতেন বিশেষ, সে বিষয়ে তার চিন্তা ও জ্ঞানের গভীরতা ছিলো অবিশেষ। এমনকি ঐ বিষয়ের পূর্বাপর ঘটনা পরম্পরা ও পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে তার কোন জ্ঞান ছিলোনা। তাই তিনি বলেছেন নিজের মতো করে মন গড়া কথা। বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিদের নাম করেছেন। তাদের ওপর আরোপ করেছেন নিজের আষাঢ়ে চিন্তা। বলেছেন সর্বনাশা কথা। বিভ্রান্ত করেছেন নিজেকে, নিজের শ্রোতাদেরকে।

এই সকল স্বত্তেও জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক সম্পর্কে ঐ কুম্ভিলকের দাবী মিথ্যা হয়ে যায় না। কারন এটা স্পষ্ট যে ঐ জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যে কেবল কথা-ই বলেছেন। কিংবা বলিয়েছেন। সে সকল অধিকাংশ কথার কোন সারবস্তু নেই। কোন দর্শন নেই। আছে কেবল কথা। অধিকাংশ-ই সস্তা হাস্যরসের কথা। কখনও সূক্ষভাবে, কখনও স্থূলভাবে নিজেকে জাহির করবার কথা। কখনও মূর্খের মতো কথা। আর মোটের ওপর লাটিমের মতো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঘুরপাক খাওয়া জীবন দর্শনের কথা। তাঁর লেখায় যাদু বাস্তবতার যে সম্মোহনী শক্তি তার ঘোর কেটে গেলেই মানুষ এর গড়পড়তা অন্তরসারশূন্যতা উপলব্ধি করা শুরু করবে।

এই মূর্খতা প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন সময়। যেমন তুর্কি ভাষা, সাহিত্য, ও ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর অজ্ঞতা। নাহলে যে তুর্কি নামের অর্থ 'বিশ্বস্ত', সেই নাম নিয়ে তিনি কটাক্ষ করতে পারতেন না। হালকা রসিকতা করতেন না। তাঁর জানা ছিলোনা বলেই তিনি তা করেছেন। কিংবা এমনও হতে পারে যে যেহেতু তিনি নিজে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ছিলেন না, তাই তিনি এই নামটি পছন্দ করতে পারেননি। যে পূর্বপুরুষেরা উসমানীয়দের সংস্কৃতি থেকে সন্তানের জন্য এমন অর্থপূর্ণ নাম ধারণ করতে পারেন তাঁরা আর যা-ই হোক নিম্ন অভিরুচির অধিকারী হতে পারেন না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে কথা সাহিত্যিক কথার সয়লাবে কয়েকটা প্রজন্মের কি বিরাট ক্ষতি করে গিয়েছেন।

তবে কথা মাওলানা সাঈদী সাহেবেও বলেছিলেন। বলেছিলেন বাংলায়, উর্দুতে, আরবীতে, ফারসীতে। বলেছিলেন ছন্দে, গদ্যে। বলার ঢং-টাও ছিলো অনন্য। আমি বিশ্বের তাবৎ শ্রেষ্ঠ বাগ্মীদের ঐতিহাসিক ভাষণগুলো খুঁজে নিয়ে শুনেছি। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা মার্টিন লুথার কিং এর ভাষণ। চার্চিলের সর্ব শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবার ভাষণ। দেশের অর্থনৈতিক ক্রান্তিলগ্নে রুজভেল্টের প্রেরণাদায়ী ও গভীর জীবনবোধের ভাষণ। স্নায়ুযুদ্ধকালে রোনাল্ড রিগানের দেয়া ভাষণ। আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নেলসন মেন্ডেলার দেয়া ভাষণ। চার্লস দি গলের বিজয়ী ভাষণ। মাহাজন ও আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে দেয়া হিটলারের ভাষণ সমূহ। সর্বোপরি আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণ। কোনটাই আমাকে সেভাবে আন্দোলিত করেনি যেভাবে সাঈদী সাহেবের ভাষণ করেছে।

সত্য বলতে বাংলাভাষী ও এদেশীয় হিসেবে, অন্য সব ভাষণের প্রেক্ষাপট জানা ও ভাষণপূর্ব বিজাতীয়দের অবস্থার পূর্ণ উপলব্ধি আমার পক্ষে সম্ভবও নয়। তবে মার্টিন লুথার কিং ও হিটলার - এঁর ভাষণগুলো সর্বজনে সমাদৃত। তাঁদের শত্রুরাও তাঁদের বাগ্মীতার প্রশংসা করেন। আমিও ব্যতিক্রম নই।

তথাপি মাওলানা সাঈদী সাহেবের ভাষণ অনন্য মাত্রার। তাঁর ভাষণের নিজস্ব চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব আছে। আছে নিজস্ব গতি। কখনও সে পালের সঙ্গী-সাথিদের নিয়ে ধীরলয়ে, আয়েশে হেঁটে চলে। কখনও দুর্বার গতিতে সাথীদের নিয়ে উত্তুঙ্গে আরোহণ করে। কখনও চলতে চলতে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। আত্ম-নির্বীক্ষণে মগ্ন হয়। কখনও মৃদু হাস্যরসে মাতিয়ে তুলে, পরক্ষণে-ই তাকে হুঙ্কারে পরিণত করে। তাঁর ভাষণের এই সকল উত্থান-পতন কখন-ই পরম্পরা বিযুক্ত হয় না। প্রতিটি কথা যেনো বিনি সুতোর মালার একেকটা মুক্তো। কোন কথাই, অকথা নয়। বাহুল্য নয়। সস্তা নয়।

যদি মার্টিন লুথার কিং এর সাথে তুলনা করি, দেখতে পাই কিং-সাহেবের বক্তব্য গীতিকবিতার মতো নির্দিষ্ট নিয়মে, ছন্দে, গঠনে আবর্তিত হয়। যেমন ভাষণের একটা বড়ো অংশ শুরু হয়, I have a dream কিংবা Let freedom ring দিয়ে। অর্থাৎ একটা শব্দ গুচ্ছ দিয়ে। মাওলানা সাঈদী সাহেবের ভাষণে পুনরাবৃত্তি কম। ওনার ভাষণ আবহমান। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উত্থান-পতনের তরঙ্গলীলায় বারে বারে আছড়ে পড়ে।

যদি হিটলার এর সাথে তুলনা করি, তবে বর্ণনাভঙ্গীর পার্থক্য উল্লেখ করতে হয়। হিটলার তাঁর ভাষণে টেবিল-চাপড়ে, বুক-চাপড়ে, অঙ্গুলি নির্দেশে, দ্রোহাত্মক মুষ্টিবদ্ধে নিজেকে জাহির করেন। অপরদিকে সাঈদীর শারীরিক ব্যঞ্জনা ও মুখের অভিব্যক্তি তাঁর ভাষণ শৈল্পের সহ-নায়ক। সাঈদীর মূল উপজীব্য দ্বীন-ইসলাম। হিটলারের মূল প্রেরণা গায়রে-ইসলাম। কথার মাধ্যমে হিটলার তাঁর জনগোষ্ঠীকে বিপথে পরিচালিত করেছিলেন। কথার মাধ্যমে সাঈদী বাংলার আপামর জনসাধারণকে তাদের রবের নৈকট্য লাভে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাগুতের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।

কথা প্রান-সংহারী। কথা জীবন-সঞ্জীবনী। বাঙ্গালী চাক বা না চাক, কথা জীবনের অংশ। কথা জীবনের মতো বাস্তব। এ কারনে-ই কথাকে অস্বীকার করবার উপায় নাই। কথাকে স্বীকার করবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পন্থা হলো এর মর্যাদা বজায় রাখা। কথা বলা আর বলতে জানা এক নয়। কথার স্বীকৃতি দানের পূর্বে, কথা বলতে শিখতে হবে।

শিখতে হবে কি করে আনন্দের কথা বলতে হয়। কি করে দু:খের কথা বলতে হয়। কি করে কাজের কথা বলতে হয়। কি করে ক্ষোভের কথা বলতে হয়। কি করে ভালোবাসার কথা বলতে হয়। কি করে নিগূঢ় ভাবনার কথা বলতে হয়। কি করে ঝগড়া করতে হয়, তাও শিখতে হবে।

যেমন আমরা দেখতে পাই আগের যুগের ঐতিহ্যবাহী, জাঁদরেল, সম্ভ্রান্ত মুসলিম রাজ-পরিবার সমূহের মাঝে। রাজা রাজপুত্রকে কারারুদ্ধ করেছেন। বিধায় রাজপুত্রের দাদী অর্থাৎ রাণী-মা ক্ষুব্ধ হয়ে বিনা অনুমতিতে রাজকক্ষে প্রবেশ করে রাজাকে, অর্থাৎ তাঁর ছেলেকে, জিজ্ঞাসাবাদ করছেন:

রাণী-মা: আমার রাজপুত্র-কে আপনি কি করে কারান্তরীণ করতে পারলেন, জবাব দিন!

রাজা: তার আগে আপনি কেন বিনা অনুমতিতে রাজ-কক্ষে প্রবেশ করলেন তার উত্তর দিন!

রাণী-মা: আমি এই কক্ষের স্তম্ভ! আমার সাথে এমন আচরণ করবেন না, পাছে ছাদ সহ এই কক্ষ আপনার মাথায় ভেঙ্গে পড়ে।

রাজা: আপনি রাষ্ট্র্যের সুলতানের সাথে যেভাবে কথা বলছেন, তাতে শুধু এই কক্ষ নয়, পুরো রাষ্ট্র-ই ভেঙ্গে পড়বে।

রাণী-মা: সুলতানের কর্তৃত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে, রাষ্ট্রকর্মে। সুলতানাদের কর্তৃত্ব রাজ-প্রাসাদে, অন্দর মহলে। এটাই আমাদের ঐতিহ্য। রাজা যখন যুদ্ধবিমুখ হয়ে পড়েন, তখন তিনি অন্দর মহলে নাক গলানো শুরু করেন। এটাই বাস্তবতা।

রাজা: রাণী-মা! ভুলে যাবেন না, যে প্রাসাদে দাঁড়িতে আপনি কথা বলছেন তা আমার যুদ্ধলব্ধ। তাছাড়া রাজপুত্রকে কারান্তরিণ করা রাষ্ট্রীয় কর্ম সম্পর্কিত ব্যাপার।

রাণী-মা: আমার রাজপুত্রকে মুক্ত করুন। আমি তার শাদীর জন্য পাত্রী নির্ধারণ করেছি। এই বিষয়ে আমি তার মতামত জানতে চাই।

রাজা: যতোক্ষণ না সে ইউসুফ নবীর মতো কারাবাসে থেকে শিক্ষা অর্জন করছে ততোক্ষণ আমি তাকে মুক্ত করবো না।

রাণী-মা: আপনি তাকে ইউসুফ নবীর মতো অন্ধকূপের যে দু:স্বপ্নে নিক্ষেপ করেছেন তার তাবীর স্পষ্ট। এবার তাকে মুক্ত করুন।

রাজা: আমি-ই তাকে বন্দী করেছি। কেবল আমি-ই তাকে ছাড়াবো।

রাণী-মা: আপনি তাকে বন্দী করেছেন। আমি তাকে ছাড়াবো।

Popular posts from this blog

জুলাই কাহা-নি

অত্রাঞ্চলে আমি-ই রাষ্ট্র্য, আমি-ই তার পতি

The Case for Rohingyas