আগরওয়ালাদের কেচ্ছা


এই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুই শ্রেনীর লোক আশাবাদী হতে পারেন। এক: যারা অকাট। দুই: যারা স্বপ্নদর্শী। বাঙ্গালীদের মতো গড়পড়তা হাঁদারামদের দেশে মাঝে মাঝে সালেহউদ্দিন আহমেদের মতো পরিষ্কার মাথার লোকদের দেখলে আমি দেশের উন্নত ভবিষ্যত নিয়ে স্বপ্ন দেখার সাহস পাই।

এমন এক পরিষ্কার মাথার মানুষ ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম সাইফুর রহমান সাহেব। তাঁর একটা কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে:

আগরওয়ালারা ফুইশা দিয়া টেহা লইয়া যায়।

বিগত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতির চিত্র "টেহা-ফুইশা"-র এই লেনদেনের চিত্র-ই তুলে ধরে। এইতো কিছুদিন আগে বাজেট পেশ করবার সময় আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে বলা হলো, বিএনপি ধার করে বাজেট দিতো আর তারা দেশের মানুষের টাকায় বাজেট দিচ্ছে। কথা হলো বিএনপি যখন ধার করে বাজেট দিতো তখন দেশের মানুষের মাথা পিছু যে ঋণ ছিলো এখন তা বেড়েছে বহুগুণ!

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে দেশের মানুষের পকেট থেকে টাকা নিয়ে দেশের মানুষকেই আবার ঋণগ্রস্ত করছে কারা? এরাই আগরওয়ালা। দেশের মানুষের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেয়ার সাথে সাথে বিদেশীদের থেকে ঋণ করে মহাপ্রকল্পের নামে বিদেশে টাকা পাচারের এই যে মহালুটের লেনদেন এটাই "ফুইশা দিয়া টেহা লইয়া" যাবার ব্যবস্থা। সালেহউদ্দিন সাহেবের বক্তব্য এই বিষয়টাই আমাকে আবার স্মরণ করিয়ে দিলো।

আমরা আগেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নির্দেশক হিসেবে কেবলমাত্র জিডিপির ওপর নির্ভরশীলতার বিপদের কথা বলেছিলাম। অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন অর্থনীতিশাস্ত্রে একাডেমিক প্রশিক্ষণ না থাকা স্বত্তেও কি করে আমরা এই নিয়ে কথা বলতে পারি। এটা ঠিক যে শাস্ত্র বিষয়ক আলোচনা ঐ বিষয়ক পন্ডিতদেরই করা বাঞ্চনীয়। কিন্তু তাই বলে যাকে বলে আকল বা সাধারণ জ্ঞান (common sense) তা খাটানো নিষেধ তাতো নয়।

যখন আপনি অসুস্থ হন ডাক্তারের কাছে যান। হাসপাতালে নতুন যন্ত্রপাতি এসেছে। ডাক্তারের ওপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া আছে স্বল্প সময়ে নতুন যন্ত্রপাতির খরচা উঠিয়ে নেবার। আর তাই সর্দি-কাশির জন্য উনি পরামর্শ দিচ্ছেন শল্য চিকিৎসার মাধ্যমে আপনার নাসিকারন্ধ্রের ফুটো বন্ধ করে দেবার। কিংবা আপনি কানে কম শুনছেন। ওনার পরামর্শ আপনার কান দুটো ফেলে দিয়ে লাউড স্পীকার লাগিয়ে দেবার। আমেরিকা থেকে নতুন এসেছে। একদম লেটেশ। মডারেন। ডিজিটাল মাল। তাছাড়া ঐ যে বলে না "বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছে", ভালো ফল দেয়।

আপনি কি ডাক্তারের এই পরামর্শ শুনবেন? শুনবেন না। এবং চিকিৎসক না হয়েও এই না শুনার অধিকার আপনার আছে। কারন এটা আপনার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়তো বটেই, এটা স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তারও বরখেলাপ। এখন প্রশ্ন হলো এক্ষেত্রে আপনি কি করবেন। আপনি তখন অন্যান্য ডাক্তারের সাথেও পরামর্শ করবেন। করবেন এই বিশ্বাসে যে একজন ডাক্তারের স্খলণ হতে পারে। দুনিয়ার তাবৎ ডাক্তারের একই সাথে একটি বিষয়ে নৈতিক স্খলণ জনিত ঐকমত প্রতিষ্ঠা পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

তদ্রুপ অর্থনীতির ক্ষেত্রেও কিছু বিষয় আছে যেগুলো শুধু যে স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার বিষয় তা-ই নয়, বরং ধর্ম সংশ্লিষ্ট বিষয়ও বটে। অর্থনীতির মৌলিক কিছু পদ্ধতি, রীতি, নিয়ম আছে যা আমাদের নবী মুহাম্মদ মু্স্তাফা সা: শিখিয়ে গেছেন। এর মধ্যে আছে সুদ সম্পর্কিত নিষেধাবলী ও ঋণ সম্পর্কিত নিরুৎসাহীকরণের উপদেশাবলী। সেই সূত্রে এবং অন্যান্য পন্ডিত গণের আলোচনা ও লেখার সূত্রে আমাদের নিকট বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অনৈতিক দিক সমূহ স্পষ্ট হওয়ার ভিত্তিতেই আমাদের এই সকল দাবী উত্থাপন।

সালেহ উদ্দিন সাহেবও সেই কথাই বলেছেন। যেখানে সুস্পষ্টভাবে জাতীয় ঋণ বেড়ে যাচ্ছে এবং তার বিপরীতে ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যেখানে ধনী-গরিবের বৈষম্য প্রতি নিয়ত বেড়ে যাচ্ছে সেখানে কেবল এক জিডিপির অংকের হিসাব দেখানোর মানে হলো এরা-ই আগরওয়ালা।

আমরা কিছুকাল পূর্বে দেখেছি কিভাবে এরদোগান সাহেবকে শায়েস্তা করার জন্য কারসাজির মাধ্যমে তুর্কি লিরার দাম কমিয়ে দেয়া হয়েছিলো। যেখানে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে প্রতি বছর তুরষ্কের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে, তাদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সম্প্রসারিত হচ্ছে, সারা বিশ্বে তাদের মান-সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে লিরার দাম কমে কি করে? এটাই আগরওয়ালাদের কারসাজি।

আগরওয়ালারা কিন্তু নিজ দেশে এই সব কারসাজি করে না। কারন তাদের শিক্ষা তাদের নিজেদের তৈরী। তাদের প্রতিষ্ঠান সমূহ তাদের নিজেদের গড়ে নেয়া। ঔপনিবেশিকতার ফসল নয়। নয় বলেই কথায় কথায় তাদের সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে তারা অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজ-ডক্টরেট খোঁজে না। খুঁজলে তার কি পরিণতি হয় এক-এগারোর ডিগ্রীর ভারে জর্জরিত সরকারের কর্মকান্ড আমাদের তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

আমার তো স্পষ্ট মনে আছে মির্জা আজিজুল হক বা এই জাতীয় নামের এক "বিরাট অর্থনীতিবিদ" সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন যে আওয়ামী সরকারের প্রথম বারে শেয়ার কেলেঙ্কারির পর যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো তাতে শেয়ার ধ্বসের ঘটনা আর ঘটবার সম্ভাবনা নেই। বাকীটা ইতিহাস। টাকলাটার মাথায় চুল নাই তা-ই নয় ঘিলুও নাই। তবে ডিগ্রীটা আছে। আর আছে বিশ্বের "নামকরা" সব প্রতিষ্ঠানে বান্দীগিরি করার গৌরবজনক ইতিহাস। সহজাত ভৃত্যদের এই দেশে পাবলিক এটাই "খায়"। এজন্যই ঠাকুরপো নিয়ে এতো মাতামাতি। যদি নোবেলটা  না জুটতো, যোগ্যতা থাকা স্বত্তেও তার পরিণতি জীবনানন্দ দাশের চাইতে ভিন্ন কিছু হতো না।

যেহেতু দেশের মানুষের নিকট গ্রহণযোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি এটাই, তাই এইসূ্ত্রে বলে রাখা যায় যে, নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত মার্কিন এক অর্থনীতিবিদ, নামটা মনে নাই খুব সম্ভবত ফ্রাইডম্যান (ভাজা-মানব কি অদ্ভুত নাম!),  উনি ওনার এক কিতাবে সুস্পষ্ট করে লিখেছেন যে, সুদবিহীন অর্থনৈতিক সমাজ একটি আদর্শ সমাজ। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি যুক্তি দিচ্ছেন এই বলে যে সুদ ছাড়া মানুষ পরস্পরকে ঋণ বা ধার দেবে না। হক কথা। কারন তিনি মুসলমান সমাজের কথা বলছেন না। তা বলা তাঁর পক্ষে সম্ভবও না। তিনি তো অমুসলিম। তিনি তো জানেন না যে হাজার বছর ধরে মুসলমানদের মধ্যে শুধুমাত্র আল্লাহর রাজি-খুশি প্রাপ্তির প্রত্যাশায় কর্জে হাসানা সহ এমন অনেক লেনদেন প্রতিষ্ঠিত যা সুদ বিহীন।

কিন্তু বর্তমানে অমুসলিমদের জন্য ধর্ম কেবল একটা অনুভূতির ব্যাপার। ধর্মাচার মনে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরীতে সীমাবদ্ধ। এর কোন ইহজাগতিক তাৎপর্য নেই। এ কারনেই একটি অমুসলিম সমাজে-রাষ্ট্রে সুদের প্রয়োজন। তবে তাঁর মতে এর হার হওয়া উচিত একেবারেই প্রান্তিক (marginal)। শূন্যের কাছাকাছি। যুক্তরাষ্ট্র্যের সুদের হার যদি আমরা দেখি তাতে এই চিন্তার-ই প্রতিফলন দেখতে পাই। সেখানে সুদের হার এক অঙ্কেরতো বটেই বরঞ্চ মোটের ওপর তা প্রায় শুন্যের কাছাকাছি-ই থাকে। এবং তা বাড়তে থাকলেই তাদের পন্ডিতেরা সরব হয়ে ওঠেন। বিপরীত পক্ষে তৌহিদী জনতার এই দেশে ব্যাংকের সুদের হার ব্যাংকার ও ব্যাংক মালিক-পরিচালকদের শ্মশ্রুর দৈর্ঘ্যের বর্গানুপাতিক। কিছুতেই তাকে এক অঙ্কের ঘরে নামানো যায় না।

দেশের এমন প্রেক্ষাপটে সালেহ উদ্দিন সাহেবের মতো পরিষ্কার মাথার লোকের প্রয়োজন। আর উনি শুধু এই এক ইন্টারভিউতেই তা প্রমাণ করেছেন এমন নয়। এর আগেও উনি আলোচনায় এসেছিলেন যখন উনি শেয়ার বাজারকে "ফাটকা" বাজার বলে মন্তব্য করেছিলেন। দেশের শাম্বাদিককুল ভীমরুলের মতো তাঁকে পেয়ে বসেছিলো। বঙ্গীয় শেয়ার বাজারের তালেবরেরা তালেবানের মতো ওনাকে পারলে প্যাঁদানী দেন এমন অবস্থা। সেই থেকে আমি ওনার গুণমুগ্ধ।

এরপর পানি অনেক দুর গড়িয়েছে। মুদি দোকানদারদের মতো শেয়ার ব্যবসা করে যারা ওয়ারেন বাফেট হবার স্বপ্নে বিভোর ছিলো তারা এখন সর্বস্ব হারিয়ে নির্বাক। তথাপি এই দেশের মানুষ কি বুঝতে পেরেছে যে টাকায় টাকা পয়দা দেয় না? এই দেশের মানুষ কি আগরওয়ালাদের চিনেছে? মনে তো হয় না।

দেশের এই সংকটপূর্ণ সময়ে নানা দিক থেকে নানা তালেবর মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। যে bum-পন্থীগুলো জীবনে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড়া করাতে পারেনি, তারা বিএনপির কাঁধে চড়ে এখন রাষ্ট্র্য সংস্কার করার স্বপ্ন ফেরী করে বেড়াচ্ছে। আগেও যেমন তারা দেশের দরিদ্র অংশটির দুর্দশার সুযোগ নিতে চাইতো এখনও তেমনি সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের মনজয় করার হীন চেষ্টায় রত।

না হলে কিভাবে এটা দাবী করা সম্ভব যে রিকশা অলাদের মধ্য থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব নেই কেন! কিংবা ছুতার-চামার বা দরিদ্রদের বিশাল অংশ বা বিদেশী শ্রমিকদের মধ্য থেকে সংসদে মন্ত্রী নেই কেন! কিভাবে দাবী করা সম্ভব যে সাড়ে সাত লক্ষ কোটি টাকার বাজেট থেকে এক-দেড় লক্ষ কোটি টাকার বাজেট দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ দেয়া হোক?

তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা এক সময় আগরওয়ালাদের দলে ছিলো কিন্তু "টেহা-ফুইশা"-র কারবারে সুবিধা করে উঠতে পারেনি। তাই এখন এসেছে দরিদ্র ও নিষ্পেষিত শ্রেণীর লোকদের আবেগকে পুঁজি করে নিজের স্বার্থোদ্ধারে।

আমাদের সুস্পষ্ট কথা। আল্লাহর অশেষ রহমতে বাংলাদেশের একটা বড়ো অংশ মানুষ-ই খেটে খেতে জানে। তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে তাদের স্থায়ী ভাবে ভিক্ষুক বানিয়ে রাখার পরামর্শ কেবল আগরওয়ালারাই দিতে জানে। বাংলাদেশের মানুষের ভিক্ষার প্রয়োজন নাই। তাদের প্রয়োজন একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্র্য। তাদের প্রয়োজন এমন রাষ্ট্র্যের যেখানে ন্যায় বিচার সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের প্রয়োজন এমন রাষ্ট্র্যের যেখানে জাকাত "দান"  করা হয় না, বরং মুসলমানদের রাষ্ট্র্যপ্রধান বা আমীরের পক্ষ থেকে তা "আদায়" করা হয়। তাদের প্রয়োজন এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার যা ইসলামের এহসান ও আদল এর ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।

কারন অর্থ মূল পুঁজি নয়। একটি রাষ্ট্র্য ও সমাজের মূল পুঁজি তার আদম সন্তান। এবং সেই সন্তানদের প্রাণশক্তি ও কর্মস্পৃহা। এগুলোর কোনটাই মাহাজনদের নিকট থেকে ধার করা সম্ভব নয়। এসব খোদা প্রদত্ত নেয়ামত। রাষ্ট্র্যের কাজ এই নেয়ামতের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করা। এবং সেটা তখনই সম্ভব যখন একটি রাষ্ট্র্য ইসলামী শরীয়তের হুকুম সমূহ মেনে সমাজে ন্যায়-বিচার ও এহসান প্রতিষ্ঠা করে।

পাঠক আগরওয়ালাদের চিনে রাখুন। এদের প্রতিহত করুন। আওয়ামী দস্যুর খপ্পরে পড়ে বিএনপির তস্কদের ভুলে যাচ্ছেন। তবে ধর্মহীন প্রবঞ্চকদের খপ্পরে যদি আবারও পড়েন তাহলে আরেক দফা প্রতারিত হবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখুন।

Popular posts from this blog

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

ইসলাম ও গণতন্ত্র

জামাতের ভোট: একবারে না পারিলে দাও শতবার