দফা রফা, দফার রফা
সময়ে সময়ে বিএনপি'র হুমকি-ধমকি দেখলে মনে হয় যেন এই বারে তারা সরকারের একটা দফা-রফা করে ছাড়বে। কিন্তু প্রতিবারই এরা দফার রফা করতেই খেই হারিয়ে ফেলে। দেশবাসীও আশায় গুঁড়েবালি দিয়ে ক্ষান্ত হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে এসব দফার মূল উপজীব্য সমূহ উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ভারসাম্য সম্পর্কিত কিছু কথা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি। সেই সাথে এটাও যুক্ত করতে চাই যে, বর্তমানে প্রেসিডেন্টের যেই ক্ষমতা সেই ক্ষমতার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার কি আমরা এ যাবৎ দেখেছি? যেমন প্রেসিডেন্টকে একটা ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে তিনি মৃত্যু দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর দন্ড প্রত্যাহার করতে পারেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বরং আমরা সেই ক্ষমতার অপব্যবহার দেখেছি।
অর্থাৎ যে ক্ষমতা রাখা হয়েছিলো নিয়মতান্ত্রিক গিঁট ছাড়ানোর (Tie Breaker) জন্য, সে ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছে নিয়মতন্ত্রের দড়ি ছাড়ানোর জন্য। এ ধরনের ক্ষমতা রাখা হয় এই কারণে যে, অনেক সময় নিরপরাধ মানুষেরাও ষঢ়যন্ত্রের শিকার হন। অর্থাৎ একটি পক্ষপাতহীন, ন্যায়ানুগ, বিচক্ষণ আলাদতের দৃষ্টিতে আনুষঙ্গিক প্রমাণ (circumstantial evidence) সাপেক্ষে কারও অপরাধ প্রমাণিত হওয়া স্বত্তেও যখন ব্যক্তি বিশেষের নিরপরাধ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিতজ্ঞান হওয়া যায় তখন যেনো নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই নিয়মের ব্যত্যয় করা যায়, সে জন্যই এ ব্যবস্থা।
এ কথা উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে রক্ষকের ভক্ষকে পরিণত হবার সমস্যা আইন, প্রযুক্তি প্রভৃতির মাধ্যমে সমাধান করা যায় না। ভক্ষকের বিতাড়ন ও রক্ষক হবার উপযুক্তদের পদায়নেই এর একমাত্র সমাধান। পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে যে অপরাধ সংগঠিত হয়, পারস্পরিক জবাবদিহিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কি তার প্রতিরোধ সম্ভব? মাথায় পঁচন ধরলে দেহের কি করার থাকে?
এটাও বোঝা দরকার যে, বলদের দুগ্ধদোহন অসম্ভব। যদি কেউ দুগ্ধ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় বলদ পোষণ করে তবে বলদটা কে? আল্লাহ তাআলা সকলকে সব কিছুর উপযুক্ত করে তৈরী করেননি। এজন্য বলদের সার্থকতা হাল চাষে, গাভীর সার্থকতা দুগ্ধোৎপাদনে।
এখন কথা হচ্ছে মানব সকলের মধ্যে কে কোন উদ্দেশ্যে তৈরী তা জানার কোন সহজ ও নিশ্চিত তরিকা নেই। এজন্যই জ্ঞান তাপসেরা উপদেশ দিয়ে থাকেন প্রতিটি মানুষ যেনো তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য তালাস করে এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনে নিজেকে সে ব্যপৃত করে। নিজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া, নিজের ক্ষমতা ও দুর্বলতার জ্ঞান ব্যক্তিগত। যে ব্যক্তি স্বজ্ঞানের পাশাপাশি স্বজাতির বৈশিষ্ট্য, ভালো-মন্দ সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল, নেতৃত্ব দানে তিনি-ই প্রকৃষ্টতার পরিচয় দিয়ে থাকেন।
এই যে কদিন পর পর অমুক তমুক-কে সামনে নিয়ে আসা হয় এই প্রত্যাশায় যে এঁকে কেন্দ্র করে নতুন একটি যুগের সূচনা হবে এবং পরবর্তীতে সমস্যায় জর্জরিত হয়ে মানুষের প্রত্যাশার বেলনুটি নিমিষেই ফেটে চৌচির হয়ে যায় তার মূলে ঐসব তথাকথিত নেতাদের স্বজাতীয় জ্ঞানের অভাব। এ কারনেই এদেশে স্বচিন্তা প্রসূত কোন নেতার উপস্থিতি নেই। ইনি কমিউনিস্ট, তো উনি কমিউনিস্টি মাওলানা। একজন ধর্মনিরপেক্ষ-মুসলিম তো অন্যজন অসাম্প্রদায়িক-জাতীয়তাবাদী। আবার একজন ইসলামিস্ট তো অপরে জিহাদিস্ট। হালে তৈরী হচ্ছে এরদোগানিস্ট।
যেদেশে গণতন্ত্রের চর্চা কেবল ভোট দানে সীমিত সে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশের প্রত্যাশা করা হয় কোন আক্কেলে? যেদেশে অধিকাংশ সাংসদ লিখিত বক্তব্য পড়তে হিমশিম খান, যে দেশে তর্কের খাতিরে তর্ক হয়, সে দেশে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ন্যায় মুক্ত ও স্বাধীন আলোচনার অনুকৃতির প্রত্যাশা অবাস্তব নয় কি? বুদ্ধি বিকলাঙ্গের নিকট বু্দ্ধিবৃত্তি চর্চার প্রত্যাশা শুধু অবান্তর-ই নয়, এটা তার প্রতি একটা জুলুম বিশেষ এবং এর পরিণতি ভয়ংকর।
তবে একথাও পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে সফলতার অনুকৃতি সকলেই চান। এটা বৈশ্বিক প্রবণতা। তবে এর সফলতা নির্ভর করে অনুকৃতি প্রত্যাশীদের যোগ্যতার ওপর। কমিউনিজমের জন্ম হাঙ্গেরীতে। রাশিয়ায় এর বিনাশ। চীনে এর সংস্কৃত (কিংবা বিকৃত তবে) সফল বিকাশ। আরবে ইসলামের আবির্ভাব। তুরস্কে তার বর্ণাঢ্য ও দীর্ঘমেয়াদী বিকাশ।
মাও-এর স্বজাতীয় জ্ঞান ও স্বচিন্তার ক্ষমতাকে এই সফলতার অন্যতম কারন বলে মনে করি। একই কথা আমেরিকান, তুর্কি ও অন্যান্যদের বেলায়ও প্রযোজ্য। ভিনদেশীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় এঁরা শুধু অবিশ্বাসী ছিলেন তা-ই নয়, বরং তাঁরা সফলভাবে স্বকীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার গোড়াপত্তন করে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
তবে দাবী দাওয়ার এই মহাভারতের ভীড়ে যে বিষয়টি আমার নজর কেড়েছে তাহলো সংখ্যালঘুদের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ। যে দেশে সংখ্যাগুরুরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত, তাদের বিষয়টি সুরাহা না করতে পারলে, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা না গেলে, কি করে সংখ্যালঘুদের ন্যায়বিচার ও অন্যান্য অধিকার প্রদান করার প্রত্যাশা করা যেতে পারে তা আমার জানা নেই।
সবশেষে ইসলাম প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে শেষ করবো। মনে রাখা দরকার কোন একটি সুনির্দিষ্ট শাসন পদ্ধতির ব্যাপারে ইসলামের কোন অবস্থান নেই। অর্থাৎ ইসলাম না গণতান্ত্রিক, না অগণতান্ত্রিক। তদ্রুপ ইসলাম বাক স্বাধীনতায়ও বিশ্বাসী নয়। ইসলাম বিশ্বাসী হক কথার স্বাধীনতায়। এখানেই ইসলাম ও কুফরী ব্যবস্থার মৌলিক তফাৎ। অর্থাৎ ইসলাম প্রতারণায় বিশ্বাসী নয়। পাশ্চাত্যের মতো মত প্রকাশের স্বাধীনতার দুর্ভোধ্য বয়ান দিয়ে এর অসংলগ্ন প্রয়োগ ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের বিধি-নিষেধের সীমারেখা সুস্পষ্ট তাই এর লংঘন-ও অমোঘ।