শাসনকার্য ও বাঙ্গালীত্ব

ইতিহাসবিদ নই। তথাপি ইতিহাসে বেখবরও নই। যতোটুকু জানি তাতে উপলব্ধি এই যে বাঙ্গালীত্ব কোন নৃতাত্ত্বিক পরিচয় নয়। রাজনৈতিক পরিচয়। মজার ব্যাপার যাঁরা এই পরিচয়ের উদ্ভাবক তাঁরা আসলে বৈদেশী। অর্থাৎ তুর্কী-ইরানী বংশজাত। সুলতানী আমলে-ই সর্বপ্রথম 'বাঙ্গালা মুলক'-এর গোড়া পত্তন হয়। এর অধিবাসী পরিচিত হয় 'বাঙ্গালী' নামে। অর্থাৎ 'শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ' বাঙ্গালীত্বের জনক।

কিন্তু যেটা উল্লেখ্য তা হলো অত্র অঞ্চলের হাজার বছরের ইতিহাসে আঞ্চলিক অধিবাসীদের মধ্যে থেকে এমন কোন শাসককুলের উদ্ভব হয় নাই, যারা বংশানুক্রমে বা কালাদিক্রমে শাসনকার্যের গোড়াপত্তন ও বিকাশে সক্ষম হয়েছেন। যতো মহামতি শাসকদের নাম আমরা জানি তাদের প্রায় সকলেই বহিরাগত। মৌর্য, পাল, সেন রাজবংশ থেকে শুরু করে, সুলতানী আমল নিয়ে, সর্বশেষ সিরাজউদ্দৌলা পর্যন্ত সকলেই হয় বৈদেশী কিংবা বৈদেশীদের ঔরসজাত।

আমার তাতে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু আমার প্রশ্ন ঠিক কি কারনে এমনটা হলো? এর অর্থ কি এই যে অত্র অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বায়ত্বশাসনের যোগ্যতা নেই? আমার ধারণা তাই। বাংলাদেশে জন্মের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র্যের নাগরিক হিসেবে অভিজ্ঞতা সুখের নয় তো বটেই, সকলের জন্যই এই অভিজ্ঞতা নিদারুণ। এবং যতো সমস্যা আমাদের নাগরিক জীবনে জেঁকে বসেছে তার মূলে সঠিক নেতৃত্ব-সংগঠন-যোগ্যতার অভাবকেই মূখ্য মনে হয়।

আমাদের মধ্যে শাসক হবার জন্য নূন্যতম যে গুণাবলীর প্রয়োজন তার অভাব আছে শুধু তা-ই নয়, একজন সুশাসক-কে ধারণ করবার জন্য যে গুণাবলী শাসকের সমর্থক-অনুসারী-অধীনস্তদের মধ্যে থাকা প্রয়োজন তারও অভাব আছে প্রকটভাবে। তবে যোগ্যতার এই সংকট শুধু বাংলা বলে পরিচিত অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মোটামুটি উপমহাদেশের সর্বক্ষেত্রেই এই কথাটা প্রযোজ্য বলে মনে করি। যদি বিশ্বসেরা শাসকদের সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা করি তবে অত্র অঞ্চলের রথী-মহারথীদের মাঝেও বিশেষ কিছু গুণের অভাব দেখতে পাই।

যেমন চন্দ্রগুপ্তের কথাই ধরুন। উনি এক জীবনে বেশুমার মানুষ হত্যা করে, পরের জীবনে অনুতপ্ত হয়ে প্রায় সন্ন্যাস ব্রতে আত্ম-নিয়োগ করেছিলেন। এই ভেল্কিবাজী অত্র অঞ্চলের মানুষের ভেতর প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। এটা সমস্যা জনক এজন্য যে এর থেকে একটি সুস্থির ও সুসঙ্গত নীতির প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব।

ইসলামের উত্থানের পর কাদেসিয়ার ময়দানে পারসিকদের সাথে মুসলানদের যে সংঘর্ষ হয় তা বিশ্বের ইতিহাসের শীর্ষতম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের একটি। তথাপি ঐ সময়কার মুসলমান শাসককুলের মাঝে এই নিয়ে কোন অনুশুচনা পরিলক্ষিত হয়নি। হওয়াটা অবাঞ্ছনীয়। কেননা তখন সংগতির প্রশ্ন ওঠে।

কেউ একটি কর্ম সংগঠিত করলো। করার পূর্বে সে মনে করলো কাজটি সঠিক। কিন্তু করার পর সে অনুশুচনা করা শুরু করলো। সেক্ষেত্রে প্রথতম তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। দ্বিতীয়ত ঠিক কি কারনে একটি কাজকে সুকর্ম কিংবা দুষ্কর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হবে তার জন্য একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে। ভালো-মন্দ বিচারে অনুশুচনা-অনুভূতির প্রাধান্য সমস্যা বিশেষ। চন্দ্রগুপ্ত বেশুমার হত্যার বদলে যদি একজন নিরপরাধীর প্রাণ হরণ করতেন এবং এরপর অনুশুচনায় তাড়িত না হতেন তবে কি সেটা ন্যায়ানুগ বলে বিবেচিত হতো?

অবশ্য বর্তমানে ভালো-মন্দের বিচারে অনুভূতির প্রাধান্যের একটা মহামারী সারা বিশ্ব জুড়েই চলছে। তথাপি এদেশীয় লোকদের চরিত্রে এর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য ও ঐতিহাসিক। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ বাংলা ও হিন্দী সিনেমা। ছোটবেলায় এই নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতাম। এমন সব অদ্ভুত-ঠুনকো গল্প মানুষ দেখে কিভাবে?

এখন মনে হয় আমার বোঝারই ভুল ছিলো। আমার ধারণা তখনকার সময়ের চিত্রনাট্য নির্মাতারা আম জনতার চাহিদার ব্যাপারে বেশ ভালোই ওয়াকিবহাল ছিলেন। চিত্রনায়ক মান্না যখন বলেন, 'আমরা গরীব হতে পারি, কিন্তু আমাদেরও মন আছে', তখন মুলত দেশের অবহেলিতদের একটা বিরাট অংশ মান্নার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। যখন নায়ক ক্ষমতাশালী উৎপীড়কের দুর্নীতি, নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধ কথা বলেন, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন, তখন দর্শকের আত্মা তৃপ্ত হয়।

এটা ভয়াবহ। কারন এটা সমাজের-রাষ্ট্র্যের অক্ষমতা-ব্যর্থতার নির্দেশক। সমাজ ও রাষ্ট্র তেমন-ই যেমন-টা চিত্রায়িত হচ্ছে। এখানকার অবহেলিতদের, নিপীড়তের, শোষিতদের অবস্থা তেমনই যেমনটা দেখানো হচ্ছে। কিন্তু তাদের একমাত্র অবলম্বন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। কি ভয়ংকর!

একটা বিরাট সমস্যা হলো এক সময় ছায়াছবি-চিত্রনাট্য প্রভৃতি থেকে সমাজের অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা নেয়া যেতো। কিন্তু আমার মনে হয় এখন যে সর্বনাশা পরিবর্তনটা হয়েছে তাহলো সুপরিকল্পিতভাবে সমাজের যুব, স্পর্শকাতর ও অবহেলিত অংশটিকে লক্ষ্য করে তাদের দুবর্লতাকে পুঁজি করে অর্থোপার্জনের একটা মহোৎসব শুরু হয়েছে। যে কারনে এখন দেশীয় ছায়াছবি গুলোতে বলিউডি ধাঁচে উর্বশী তরুনীদের পশ্চাদ্দেশ ঘুরানো, থলথলে, খিঁচুনী নৃত্যের উপস্থিতি বেশী। অন্তত YouTube-এ local trend এর ভিত্তিতে যে ভিডিও সমূহ recommend করা হয় এবং বারংবার আমাকে শুধু ভিডিও নয় পুরো চ্যানেলটিকে ব্লক করে দেবার পরিশ্রমটা করতে হয় সেই অভিজ্ঞতা থেকে তা-ই বলতে পারি।

কিন্তু যেটা উদ্ভটস্য-উদ্ভট তাহলো সিনেমার সম্পর্কগুলোর টানাপোড়েন, বিচ্ছেদ ও পুন:মিলিত হবার অসংলগ্ন প্রবণতা। অসংলগ্ন এ কারনে নয় যে তা সমাজের ভুল চিত্রায়ন। বরং সমাজের অবস্থা এমনই। অসংলগ্ন এ কারনে যে এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যার অতীত। বুদ্ধির অতীত। ঠিক কি কারনে টানাপোড়েন তৈরী হচ্ছে এটা সুস্পষ্ট নয়। যে কারনে এর কোন যুতসই সমাধানও দেখানো হয়না। আছে শুধু প্রলাপ-বিলাপ-হাঙ্গামা এবং দিন শেষে সবাই মিলে হাসিমুখে ফটোসেশন।

আমি বলতে চাচ্ছি এটাই বাংলাদেশ। যেখানে ঠুনকো সমস্যা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় পড়ে যায়, যা বায়বীয় উপায়ে নিমিষেই সমাধা হয়ে যায়। সমস্যা ও সমাধানের মাঝখানে ক্ষণিকের এই হাঙ্গামা-ই একমাত্র স্থিতিশীল। বাঙ্গালীর ব্যক্তিগত ও জাতীয় চরিত্রের দুষ্ট চক্র এটাই। বাঙ্গালীর মধ্য থেকে যে শাসককুল তৈরী হতে পারেনি তার মূলে স্বজ্ঞান ও আত্মশাসনের এই অনুপস্থিতি।

তা-ই বলি যাবৎ মূল সমস্যা চিহ্নিত পূর্বক তার সমাধান খুঁজে বের করবার প্রবণতা তৈরী হচ্ছে, যাবৎ সুস্থির-সংলগ্ন চিন্তাশক্তির ব্যাপক চর্চা হচ্ছে, যাবৎ সত্য-অসত্য নির্ণয় পূর্বক সত্যকে দৃড়ভাবে ধারণ করবার ও সত্য-পথে আঁকড়ে থাকবার অনবদ্য প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হচ্ছে, তাবৎ নিজেদের মধ্য থেকে সুশাসক খুঁজে নেয়ার প্রচেষ্টায় গুঁড়েবালি।

Popular posts from this blog

জুলাই কাহা-নি

অত্রাঞ্চলে আমি-ই রাষ্ট্র্য, আমি-ই তার পতি

The Case for Rohingyas