ইসলাম "আসলে" কি বলে?
ধানমন্ডি-কে দেশের অভিজাত এলাকার একটি গণ্য করা হয়। মনে করা হয় এখানে শিক্ষিত, গণ্যমান্য লোকেদের বাস। তো একবার সেখানকার এক মসজিদে জুম্মা পড়তে গেলাম। ইমাম সাহেব এক সাবেক বিচারপতির সাথে মুসল্লিদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ঠিক কি জন্য স্মরণে নাই, তাকে বক্তব্যের জন্য ফ্লোর দেয়া হলো। উনি ইসলাম নিয়ে বয়ান করে চললেন।
আমার তখন আমাদের স্কুলের এক প্রিন্সিপালের কথা মনে পড়লো। উনি অংকের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু প্রতি শুক্রবার কোরানের তফসীর করতেন। বক্তব্য এতোটাই একঘেঁয়ে ছিলো যে অনেক ছাত্ররা ঝিমুতো। কেউ কেউ বিড়বিড় করে গল্প করতো। গুঞ্জন বেড়ে গেলে মাঝে মাঝে আমাদের শিক্ষক বা বড় ভাইদের মধ্যে যারা তবলীগ করতেন তাদের কেউ উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের শাসাতেন, উপদেশ দিতেন:
আমরা কথা না বলি, খুব ফযীলত হবে।
তখন কথা বন্ধ করে সবাই ঘুমিয়ে যেতো। ফযীলত হতো কিনা জানিনা।
দেশের শিক্ষিতদের শিক্ষার ও ধার্মিকজনের ধার্মিকতার হাল-হকিকত বোঝার জন্য কাবিল হবার প্রয়োজন নেই। এ বেহাল দশা হর-হামেশাই চোখে ধরা পড়ে। যখন ধানমন্ডি লেকে নিয়মিত হাঁটতাম তখন লক্ষ্য করতাম, যে দেয়ালের পাশে ময়লা ফেলা হয় সে দেয়ালে লেখা:
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ - আল-হাদিস।
আমি হয়রান হয়ে ভাবতাম, যদি ময়লা ফেলবার পূর্বে এই লেখা হয়ে থাকে, তবে কেন সেখানে ময়লা ফেলা হলো বা ফেলতে দেয়া হলো? যদি না থাকে, তাহলে ঠিক আর্বজনার জায়গায় হাদীস লিখা হলো কেনো?
শিক্ষিত লোকেদের যারা অন্যের ভুল ধরতে পারার মধ্যেই নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ খুঁজে পান, তাদের কাউকে এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ করতে দেখিনি। দেশের টং-মহলের অনেকেই সেখানে বৈকালিক জগিং এর জন্য যেতেন। মকছুইদ্যা-কে দেখতাম। ঐ-যে "বিগড়ে যাও, ভড়কে দাও" পত্রিকায় লেখতো। অনেক ধর্ম-নিরপেক্ষ করতো। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় "টংগ-এ চড়িয়া" থাকতে চাইতো। কিন্তু কখনও তাকে এ নিয়ে কিছু লিখতে শুনি নাই। অথচ যখনি দেখতাম, গান্ধীর মতো নেংটি পরে, গভীর চিন্তা ভাবনায় ব্যস্ত - এমন একটা ভাব ধরে থাকত।
হয়তো তাদের বিকার ছিলোনা এ কারনে যে এটা ম্লেচ্ছদের ব্যাপার। কারন যখন ঠাকুরপোর কোন কবিতা, গান নিয়ে এদিক-সেদিক হয় তখন এদের রোদন শুরু হয়ে যায়। খৎনা করা চক্রবর্তীদের কপালের থালার মতো এয়াব্বড়ো টিপ আঁসু জলে লেপ্টে যায়। চারিদিকে রোল পড়ে যায়, মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেলো বলে।
সেটা না হয় মানলাম। কিন্তু মোলানারা কোথায় থাকেন? যারা পান থেকে চুন খসে পড়লে কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে রাস্তায় নেমে যান, ধর্মের টান ও নবী প্রেমের দোহাই দিয়ে একে অপরের সাথে ফিরকাবাজী-তে হর-হামেশা জড়িয়ে পড়েন, আবর্জনার স্তূপে হাদীস লেখার মতো বেয়াদেবি ও ধর্ম অবমাননা কি তাদের চোখে পড়েনা?
আমার মনে হয়, এ জিনিস এই উভয় শ্রেনীর-ই চোখ পড়ে, তবে মাথায় "খেলে" না। এদের মাথায় তা-ই খেলে, যা অন্যেরা খেলে দিয়েছে। বাঙ্গালী নিজে খেলতে পারেনা। সে দেখে শেখে। ঠেকে শেখা তার ধাতে নাই। আমি শুনেছি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একদা গোস্বা করে হিন্দুদের কোন দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন বাংলার পানির স্তর যেনো তিন হাত নীচে নামিয়ে দেয়া হয়। কারন তার মতে প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য-ই বাঙ্গালীকে বখে দিয়েছে। তাই তিনি চেয়েছিলেন বাঙ্গালী এক হাতের বদলে তিন হাত মাটি খুঁড়ুক। ঠেকায় পড়ুক। শিখুক।
বাঙ্গালী চরিত্রের এটাও একটা দিক যে যদিও-বা সে সমালোচক বিশেষ, তথাপি আত্ম-দর্শনে সে একেবারে অপারঙ্গম। এমন-কি তার চোখে আঙ্গুল দিয়ে-ও তার ভুল শোধরানো যায় না। যে বাঙ্গালী ফাঁড়া লুঙ্গি পরে পশ্চাদ্দেশ বেরিয়ে অবলীলায় হেঁটে যায়, তাকে গিয়ে যদি তা বলেন, অমনি সে মুখে হাত দিয়ে লজ্জাতুর ভঙ্গিতে পাল্টা শুধোবে:
আমনে কইলেন, আমনের শরম করলো না?
কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে। বাঙ্গালীর চরিত্র বিশ্লেষণ অত্র লেখার প্রতিপাদ্য নয়। পার্শ্ব-আলোচনা।
তো কথা হচ্ছিলো ইসলাম ধর্মের অবমাননা নিয়ে। এদেশে কেবল ইসলাম নিয়ে কথা বলতে কোন যোগ্যতা লাগে না। আর সব বিষয়ে লাগে। এইতো কদিন আগে ডাক্তার জাহাঙ্গীর বা কি যেনো নাম, পাশ্চাত্যের এক যুগ আগের কিটো ডায়েটের ধারণা নিয়ে বাঙ্গালের হার্ট থ্রবে পরিণত হয়েছিলেন, তাঁকে দমিয়ে দেয়া হলো। অর্থাৎ ডিগ্রীধারী পেশাদার ডাক্তার হয়েও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়ে তার কথা বলার অধিকার হরণ করা হলো।
কিন্তু ইসলামের বিষয়টা অন্য। এই নিয়ে কথা বলতে কোন যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। যে কাবিল, যৌবনে লুঙ্গির ভিতর করে "প্রাভদা" চালান দিতো, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী-প্রোলেটারিয়েট ইত্যাদি কঠিন কঠিন শব্দ বলতো, বিয়ের সময় সেটাই আওয়ামী মাহাজনের মেয়ে বিয়ে করে শেষ বয়সে সরকারী খরচে হজ্জ মেরে এসে ইসলামের বয়ান শুরু করে। সেই বয়ানের মুল প্রতিপাদ্য এটাই যে, মোলানা-মুলুবীরা ইসলাম সম্পর্কে কিছু জানে না। সে জানে। তাই গর্ধভের মতো তারস্বরে সে হাদীস-কোরান-মাযহাব ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বয়ান করে চলে।
যে কাবিল যৌবনে কাফেরের দেশ থেকে চোখ পাকিয়ে আসে, কিংবা যেটা যৌবনে হিন্দী নায়িকাদের শরীরতত্ত্বের উঁচা দরের গবেষক ছিলো, সেটা বিয়ের পর "অল্লা-হি! শায়খ" হয়ে যায়। কঠিন কঠিন বয়ান শুরু করে। নপুংশক স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য, ইসলামে নারীদের গর্তবাসি হবার ফযীলত ইত্যাদি জ্ঞানগর্ভ আলোচনা।
এই-তো কিছুদিন আগেও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরণোত্তর মিলাদ মাহফিল হলো। ধর্ম শিক্ষিত লোকদের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখিয়ে ধর্ম-নিরপেক্ষ লোকেরা পুরোপুরি মাওলানা বনে গেলো। শরৎচন্দ্রের হিসেবে একদা যে হিন্দুতে-যবনে মিলে একসাথে ফুটবলটা পর্যন্ত খেলতে পারতো না, সেই হিন্দুতে-যবনে মিলে কোরান পড়লো। দরুদ শরীফ পড়লো। জের-জবর-পেশ-মাখরাজ জানলেই না তবে ভুলে যাবার প্রসঙ্গ! কি দরকার এ সবের? মোল্লারা বললেই হলো? ওরা জানে-টা কি?
দেয়াল লিখন দিয়ে অবতারণা করেছিলাম, তা দিয়ে-ই উপসংহার টানছি:
এখানে প্রস্রাব করিবেন, না করিলে ৫০ টাকা জরিমানা।
যতোদিন এই জাতি ব্যাকরণ জানা, মানা, ভাঙ্গা, ও গড়া-র কায়দা না শিখছে ততোদিন সে ধর্ম-অধর্ম যা-ই করুক, জরিমানা দিয়ে যেতে হবে।