স্বাধীনতাবিরোধী বনাম মুক্তিযুদ্ধবিরোধী

অবশেষে বিএনপি মহাসচিব আওয়ামীলীগের সাথে তাল মিলিয়ে বলেছেন, স্বাধীনতাবিরোধীদের কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে দেয়া যাবেনা। বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী বলে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামী-র প্রতি ঈঙ্গিত করা হয়। এটা জামাত বিরোধীদের তৈরী একটি মোক্ষম কিন্তু অসত্য রাজনৈতিক বয়ান।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে জামাত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল, স্বাধীনতাবিরোধী নয়। বরঞ্চ বাস্তবতা হলো ১৯৭১ পরবর্তী থেকে এ সময় পর্যন্ত জামাত এই দেশ ও এই দেশের মানুষের জন্য যে খেদমত করেছে তা নজির বিহীন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়েও এই জাতের ও পর্যায়ের খেদমত করা অন্যদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই।

যারা এ যাবৎ ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন তারা বড়জোর অবকাঠামোগত কিছু উন্নতি সাধন করেছেন। কিন্তু আদম সন্তানের সাথে অন্যান্য সৃষ্টিকুলের মূল পার্থক্য এখানেই যে তার জাগতিক অর্জন সমূহ আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব ব্যতীত অপূর্ণাঙ্গ। দু-ক্ষেত্রেই জামাতের অবদান অদ্বিতীয়। জামাত একদিকে যেমন ইসলামী ব্যাংক-ব্যবস্থার গোড়া পত্তন করেছে, উৎপাদনশীল-দক্ষ জনশক্তি তৈরীর জন্য বিবিধ পেশাদার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, অপরদিকে ইসলামের মূল শিক্ষা-কৃষ্টি-কালচার এর সাথে সম্পর্ক-সংশ্রবহীন তথাকথিত ইংলিশ ও বাংলা মিডিয়ামে পড়ুয়া মুসলিমজাত সন্তানদের তরবিয়্যাতের জন্য প্রয়াশী হয়ে বাংলায় ইসলামী সাহিত্যের প্রসারণ ও তাদের সমাজ-সংগঠন শিক্ষায় ব্রত হয়েছে। এ এক অতুলনীয় কর্মযজ্ঞ।

কিন্তু আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের মুল উদ্দেশ্য জামাত বন্দনা নয়। কারন আমরা না জামাতের বেতনভূক, না তাদের অন্ধ-সমর্থক। বাংলাদেশের মুসলমান নামীয় যে অংশটি সজ্ঞানে মুসলিম আমরা তাঁদের অংশ। অর্থাৎ আমাদের সর্বপ্রথম পরিচয় আমরা আল্লাহর বান্দা। আমাদের চূড়ান্ত সাফল্য ও পরিণতি তাঁর ﷻ বান্দীগিরি-তে নিহিত। মুসলমান জাতির পিতা ইব্রাহীম আ: এঁর মতো, নিশ্চই আমাদের সালাত, আমাদের কুরবানী, আমাদের জীবন এবং আমাদের মরণ কেবলমাত্র আল্লাহর-ই জন্য।

সুতরাং জামাতের প্রতি আমাদের সমর্থন, ইসলামের প্রতি তাঁদের আনুগত্যের প্রতি শর্তযুক্ত। বিপরীত পক্ষে এর অর্থ এই নয় যে প্রতি মূহুর্তে কেবলা পরিবর্তন আমাদের বদভ্যাস। অর্থাৎ আমাদের চিন্তাধারা এমন ঠুনকো নয় যে, যেহেতু প্রেসিডেন্ট মুরসি নির্বাচিত হবার এক বছরের মাথায় মিশরের শত বছরের জঞ্জাল পরিষ্কার করে একে কল্পলোকে পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, উপরন্তু আন্তর্জাতিক মাহাজনদের নিকট থেকে দেশের জন্য সুদ ভিত্তিক ধার-কর্য করেছেন, তাই মিলিটারী জান্তা, তাগুত ও খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরুদের সাথে আঁতাতের মাধ্যমে মুরসির উৎখাতেই মুসলিম মিল্লাতের‌‌ কল্যাণ নিহিত, এমন ধারণা‌ পোষণ করবো। আমরা তেমন নই।

তবে মতিহীন মাদানী শেখ ও তাদের অনুসারীদের ছহী তরিকা এমনই। তাদের কর্মকান্ডে সুস্পষ্ট নিষিদ্ধ বিষয়সমূহকে সংশয়যুক্ত বিষয়সমূহের ওপর প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। অর্থাৎ এক পাত্রে শুয়রের গোশত। অপর পাত্রে গরুর গোশত। এটা নিশ্চিত যে ঐ গরু যবেহ করা হয়েছে কোন মুসলমান দ্বারা। কিন্তু যবেহের সময় সে পশ্চিম দিকে ফিরে 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর' বলেছে কিনা তার যেহেতু নিশ্চয়তা নাই, তাই শুয়েরর গোশতেই ভরসা। অন্তত যারা ইসলামী ব্যাংক পুরোপুরি ইসলামী না বলে সুদী ব্যাংকের সাথে দেদারসে কারবারে লিপ্ত হয় তাদের ব্যাপারটা এমনই। এই জাতীয় লোকেরা একদিকে যেমন স্বনামধন্য ব্যক্তিদের ছিদ্রানুসন্ধানে লিপ্ত থাকে অপরদিকে তাঁদের বিরুদ্বে চিহ্নিত দুষ্কৃতকারী-ধর্মবিরোধীদের সাথে আঁতাত গড়ে তুলতে দ্বিধা করে না। আল্লাহর ফযিলতে আমরা এই দলভুক্ত নই।

উল্লেখ্য কি করা হলো বা কি বলা হলো তার চাইতে অধিক গুরুত্বপূ্র্ণ তা কে করলো বা কে বললো। কেননা দুষ্টের শিষ্টাচার আর শিষ্টের দুরাচার বিপরীত ঈঙ্গিতবাহী। সুতরাং মুরসীর ঋণ গ্রহণ, জিনজিয়াং প্রসঙ্গে ইমরান খানের নিরবতা, মধ্যপ্রাচ্যীয় বিরুপ অপশক্তিগুলোর সাথে এরদোগানের সম্পর্ক পুণ:প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, কোনটাই তাঁদের নৈতিক স্খলণ নয়, কৌশল মাত্র।

জামাতের প্রতি আমাদের অবস্থানের নীতিটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন এ কারনে যে এই দেশে যখন যার পক্ষে যে কথা যায় তিনি ঐ কথায় ও কথকের ওপর বেজায় খুশী হন। তার বিরোধীরা হন নাখোশ। অর্থাৎ মূল বিষয়বস্তুর যথার্থতা নিরুপণের চাইতে মোটা দাগে এর পক্ষ-বিপক্ষ নির্ণয়ের বিষয়টি-ই প্রায়শ মূখ্য হয়ে ওঠে। যে কারনে কোন আলোচনা-ই এদেশে গভীরতা কিংবা স্থায়িত্ব পায় না।

জামাতের সমস্যা সেগুলো নয়, যা তার বিরোধীরা তার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং তার হীনমন্য নেতৃত্ব বা কর্মী বাহিনী মেনে নিয়েছে। আমাদের সংশয় ইরানের ইসলামী বিপ্লবের যে অনুকৃতি মাওলানা মওদুদী সাহেব চেয়েছিলেন, ইরানে কালক্রমে সেই আন্দোলনের বিকৃতি সম্বন্ধে জামাতীরা ধারণা রাখেন কিনা। যদি রাখেন তবে এর প্রতিকারের উপায় নিয়ে তাঁদের ভাবনা-চিন্তা আছে কিনা।

জামাতের প্রতি আমাদের নীতি সুস্পষ্ট করবার পর এখন প্রাথমিক প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। আমাদের জিজ্ঞাস্য স্বাধীনতাবিরোধী সম্পর্কিত বিএনপি মহাসচিবের এই বক্তব্য তাদের দলীয় বক্তব্য কিনা। অর্থাৎ জামাত একটি স্বাধীনতাবিরোধী দল, এটা তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী কিনা। যদি তাই হয়, তাহলে এর মধ্য দিয়ে পরোক্ষ ভাবে তারা যে নিজেদের পায়ে কুড়োল মেরেছেন তা তারা স্বীকার করবেন কিনা? কারণ জামাত যদি স্বাধীনতাবিরোধী হয় তবে তারা অতীতে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে শুধু জোট নয় সরকার পর্যন্ত গঠন করেছেন। এবং এর মধ্য দিয়ে দেশদ্রোহীতা করেছেন। ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে শুধু জামাত নয় বরং এর সহযোগী ও মদদ-দাতা হিসেবে বিএনপিকে-ও যে কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে দেয়া উচিত না প্রকারান্তরে সে কথার-ই স্বীকৃতি দিয়েছেন।

একথা পরিষ্কার করা প্রয়োজন কারন বিএনপির সাম্প্রতিক রাজনীতি জামাত বর্জনের রাজনীতি। এবং আমরা খুব ভালো করে জানি এমন নীতির পেছনের কারিগর কারা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, এই ক্রীড়ানক তারাই, যারা গত একযুগে এই ফ্যাসিবাদী অপশক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদ দিয়ে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় যে ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তাদের পরোক্ষ ক্রীড়ানকদের হঠাৎ বাহ্যত এই নৈতিক অবস্থান নেয়ার পেছনে কোন অনৈতিক উদ্দেশ্য নিহিত।

অর্থাৎ এতোদিন দরকষাকষি হচ্ছিলো। বনিবনা হতো। ইতিপূর্বে যেমন বলেছিলাম: তুমি আমার বিষ্ঠাটা খাও, আমি তোমার লাড্ডুটা খাই। কিন্তু গত দশ বছরে বিশ্ব বদলেছে। রুচি, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন এসেছে। লাড্ডুতে তৃপ্তি নাই। চাওমিন চাই।

তাহলে দিন শেষে প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে যে সর্বভুকদের লালসায় বলি হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ, বিএনপি সেই বলিদানে যোগ দেবে কিনা। অকাতরে বলিদানে বিএনপির যে সায় নেই তা আমরাও জানি। কিন্তু বলিদান যখন শুরু হয়েছে অল্পে তুষ্ট করাই কি বুভুক্ষু প্রতিহতের একমাত্র কৌশল? সর্বভুকেরা কোন কালে অল্পাহারে তৃপ্ত?

বিএনপি বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিসমূহকে অগ্রাহ্য করুক আমাদের বক্তব্য তা নয়। তা সম্ভব এবং বাস্তব সম্মতও নয়। আমাদের চাওয়া এটাই যে বিএনপি সর্বপ্রথম নির্ভর করতে শিখুক সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর ওপর এবং আস্থা রাখুক দেশের মানুষের ওপর।

কেবলমাত্র তখনই বিএনপি সাফ বলে দিতে শিখবে যে এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী তারাই যারা ব্যক্তিগত ও দলীয় স্বার্থ হাসিলে জনবিরোধী অবস্থান নেয়, যারা জনমনে ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য সাধনে পারঙ্গম স্বাধীনতা বিরোধী তারাই, যারা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী তারাই, যারা মুসলিম প্রধান দেশের সন্তানদের ধর্মীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছে এদেশের স্বাধীনতা বিরোধী তারাই, যারা মুসলমানের দেশে ধর্মহীনতা ও ধর্ম বিকৃতির বীজ বপনে লিপ্ত স্বাধীনতা বিরোধী তারাই, যারা নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করবার অপকৌশল হিসেবে দেশের মানুষের মধ্যকার ধর্মীয়-রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিভাজন ও বিরোধকে উস্কে দেয় স্বাধীনতা বিরোধী তারাই। সর্বোপরি যারা ক্ষমতার লোভে ভারত সহ অন্যান্য অপশক্তির নিকট দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে পেছপা হয়না তারাই স্বাধীনতা বিরোধী।

কেবলমাত্র তখনই বিএনপি জোর গলায় বলতে পারবে যে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির ঐক্যই দেশের স্বাধীনতার মুল স্তম্ভ। এটাই দেশের মূল চালিকা শক্তি। এটাই মূল ধারা। যারাই এই ঐক্য বিরোধী, তারাই দেশের শত্রু। স্বাধীনতার শত্রু।

কেবলমাত্র তখনই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিসমূহের সাথে কূটনীতির খেলায় সমান তালে অংশগ্রহণে বিএনপি সক্ষম হবে। এই সংকুল, অনিশ্চিত, জটিল বৈশ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করা তখনই সম্ভব হবে। বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠতে পারবে স্বাধীন এবং চর্চা করতে পারবে তার সার্বভৌমত্বের।

আরও এই যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিএনপির সংগ্রামের যে ভাষা, যে বয়ান, তার ব্যাপারেও তাদের সতর্ক থাকা উচিত। কেননা ‌bum-পন্থীদের কুমন্ত্রণায় বিএনপি যেভাবে সরকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের স্বায়ত্বশাসন, মিডিয়ার তথাকথিত স্বাধীনতার নামে ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট এর বিরোধীতাসহ, দেশবিরোধী, ইসলাম বিরোধীদের দুরুভিসন্ধিমূলক সেকেলে গীতে তাল মেলাচ্ছেন, ক্ষমতার পালা বদলে তা যে তাদের জন্যই বুমেরাং হবে তা কি তারা ভেবে দেখেছেন?

কোন এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক যথার্থই বলেছেন যে, বেগম জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচাইতে বড় বিভ্রম  হলো, স্বৈরাচারী এরশাদ পরবর্তী প্রেসিডেন্টসিয়াল সরকার পদ্ধতির বদলে পার্লামেন্টারিয়ান সরকার পদ্ধতির প্রবর্তণ করা। তখন ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের এই একই জাতীয় কুমন্ত্রণা দেয়া হয়েছিলো। প্রেসিডেন্টের হাতে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত হবার ভয় দেখানো হয়েছিলো। পরবর্তীতে বিএনপি ক্ষমতায় আসবার পর তাদের নিয়োগকৃত প্রেসিডেন্টকেই অপসারণ করতে হয়েছিলো বিদ্রোহ করে বসবার আশংকায়। কিন্তু যারা এর পেছনের কারিগর, যারা ঐ পর্যায়ে যেতে, রাষ্ট্রপ্রধান, তথা বেগম খালেদার হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চলে যাওয়া ঠেকাতে সরকার কাঠামো পরিবর্তনের ও পার্লামেন্টারিয়ান পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ওকালতি করেছিলো, তাদেরকে কি বিএনপি চিনে নিয়েছিলো? মনে হয় না।

রাষ্ট্র্য ব্যবস্থার এই পরিবর্তন স্বত্তেও বিগত এক যুগে আমরা দেখেছি খাতা-কলমে বিকেন্দ্রীকৃত এই সরকার কি করে এক ব্যক্তির শাসনের স্বীকার হয়েছে। ভেবে দেখুন এই সর্বময়ক্ষমতাটা-ই যদি বেগম জিয়ার মতো দেশনেত্রীর হাতে থাকতো তাহলে এতোদিনে বাংলাদেশের কি প্রভূত কল্যাণ ও উন্নতি সাধন হতে পারতো। কত সহজে দেশ বিরোধী শক্তি সমূহকে ঘায়েল করা যেতো। অবলীলায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যকার অচলাবস্থা নিরসন করা যেতো।

এবং সেটা যদি হতো সাংবিধানিক ভাবে অর্থাৎ প্রেসিডেন্টসিয়াল পদ্ধতিতে, তাহলে বিকেন্দ্রীকৃত সরকার ব্যবস্থার ভেতর স্বৈরাচারী-এক নায়কের আবির্ভাবের যে তত্ত্বিয় ধাঁধা তৈরী হয় তাও এড়ানো যেতো। অর্থাৎ এই একই ঘটনা যদি প্রেসিডেন্টসিয়াল পদ্ধতির কাঠামোতে ঘটতো, নিদেনপক্ষে পদ্ধতির ওপর দোষ চাপিয়ে আমরা নিজেদের স্বান্তনা দিতে পারতাম। কিন্তু এখনতো সেই সুযোগও নেই। অন্তত খাতা কলমে তো সরকার প্রধানের ক্ষমতা সীমিত এবং বিকেন্দ্রীকৃত! তাত্ত্বিকভাবে পার্লামেন্টারিয়ান সরকারে স্বৈরাচারী তালাশ করা, খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতো।

তার চাইতে অধিকতর সত্য বাস্তবতা হলো, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ব্যবস্থায় বেগম জিয়াকে পরাজিত করার সম্ভাবনার বাতুলতা। সেই ক্ষেত্রে বেগম জিয়া যে এক নায়ক হয়ে উঠতেন না সেই বিষয়ের নিশ্চয়তা দেয়া আমাদের এই আলোচনার মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। বরং আমাদের উদ্দেশ্য হলো এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশার পুনরাবৃত্তি করা যে বেগম জিয়া এক নায়ক হতে পারেন, লৌহ মানবী হয়ে উঠতে পারেন, কিন্তু দেশ বিক্রী করতে পারেন না।

কারন পূর্বে একাধিকবার আমরা যেমনটা বলেছি, কি বলা হলো বা কি করা হলো, তার চাইতে অধিক গুরুত্বপূ্র্ণ হলো কে বললো বা কে করলো। বিগত এক যুগে এক ব্যক্তির যে একচ্ছত্র শাসন, সেই ব্যক্তিটি যদি বেগম জিয়া হতেন, তাহলে আজ মীরজাফরের বংশধরেরা দেশের উপার্জনে বিদেশের মাটিতে বসে আমাদের দেশপ্রেমের সবক দেবার স্পর্ধা দেখানো দুরে থাক, দেশদ্রোহীদের হারিকেন দিয়ে খুঁজে পাওয়া যেতোনা। আজ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের যে দৈন্যদশা তার বিপরীতে আমার বিশ্বাস অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ অন্তত মালয়েশিয়া বা সমমানের অর্থনৈতিক দেশের কাতারে উন্নীত হতে পারতো।

কিন্তু এর বিপরীতে বিএনপিকে গেলোনা হচ্ছে যে সরকার গঠন করতে পারলে তাদের প্রধান কর্তব্য মিডিয়ার বাক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ যে মিডিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে ক্ষমতার গলি-ঘুঁপচি দিয়ে এই সরকারের আগমন ও প্রতিষ্ঠা, সেই মিডিয়া যেনো আবারও বিদেশী মেওয়ার লোভে তাদের ঘৃণ্য কর্মের পুণরাবৃত্তি ঘটাতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। বিগত এক যুগে নিরাপত্তাহীনতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিরেট সত্য কথাটা পর্যন্ত বলতে পারেনি বটে, তথাপি আগামীতে জনগণের প্রতিনিধিত্বে গঠিত সরকারের উচিত দেশদ্রোহী চিহ্নিত অংশটিকে মিথ্যা বলবার অবাধ লাইসেন্স দিয়ে দেয়া।

বিগত এক যুগে যেই অপশক্তি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের দলীয় করনের মাধ্যমে রাষ্ট্র্য ব্যবস্থাকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, তার থেকে উত্তরণের দাওয়াই হলো, সেই প্রতিষ্ঠানসমূহকেই বিএনপি আমলে স্বায়ত্বশাসন দান করা। যাতে বিএনপি আমলে স্বাধীন ও সাংবিধানিকভাবে এরা জনসমর্থিত সরকারকে প্রতিঘাত করার সক্ষমতা অর্জন করে।

এখন বিএনপি কি করবে তা তাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাদের অপেক্ষায় বসে না থেকে জনগনের উচিত নিদেনপক্ষে আত্ম-নিরীক্ষণে মনোযোগী হওয়া। এবং এটাই আমাদের আজকের আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য। যার আত্ম-সমালোচনার ক্ষমতা নেই, তার আত্মোন্নয়নের সুযোগ নেই। তেমনিভাবে জাতির উন্নতির জন্য সামষ্টিক আত্ম-নিরীক্ষণ প্রয়োজন।

লক্ষনীয় যে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা ভারত থেকে আসেনি। এরা এ দেশেরই পয়দা। যেটা এতোদিন আওয়ামী লীগের কাবিল বলে স্বার্থ হাসিল করেছে, আসছে নির্বাচনে ক্ষমতার পালা বদলে সেটাই তারেক রহমান সাহেবকে 'বাইয়া' ডাকতে ডাকতে হয়রান হবে। ঠিক যেমনি ভাবে এক যুগ আগে জামাতের উচ্ছিষ্টভোগীদের একাংশ ভোল পাল্টে রাতারাতি জয় বাংলা হয়ে গিয়েছিলো।

আমার মনে হয় এই ভেল্কিবাজী আমাদের জাতীয় চরিত্র। বাঙালীর চারিত্রিক তারল্য-ই তার পরিচয় বিশেষ। এই অস্থিরমত্তা ও খামখেয়ালীপনাই তার শত্রুবিশেষ। এটি-ই তাকে হাল ফ্যাশনের বাঁদর নাচে বারংবার প্রলুব্ধ করে। আজ ছৈদি ইসলাম, তো কাল ছালাফী ইসলাম; আসছে তুর্কীদের উত্থানে শুরু হবে সূফীবাদী উল্লম্ফন। ‌কিন্তু আব্দুল ওয়াহহাব কিংবা আলবানির কর্ম ও চিন্তাধারার ব্যাপারে সম্যক ধারণা রাখেন, এবং সেই ধারণা তাঁদের কিতাবাদি কিংবা তাদের সরাসরি ছাত্রের নিকট থেকে রপ্ত করেছেন এবং সেই রপ্ত করার স্বীকৃতি আদায় করেছেন এমন লোক ক'জন? কিংবা সূফীবাদী আলিমদের উচ্চমার্গীয় সূক্ষাতিসূক্ষ জ্ঞানগর্ভ পর্যালোচনা, উম্মাহর মনস্ত্বাত্তিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় তাঁদের অবদান সম্পর্কে ধারণা আছে ক'জনের?

আমাদের প্রস্তাবনা এই যে, জাতীর চরিত্র ও শাসক একে অপরের প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ অনাচারীরা যখন ক্ষমতা দখল করে বসে তখন যেমন সর্বক্ষেত্রে অনাচারের প্রদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়, তেমনি একথাও সত্য যে অনাচারীরা অনাচারীদের মধ্য থেকেই উঠে আসে। ঠিক যেমনি ভাবে, যে জাতি যতো বড়ো জালিম, মহান আল্লাহ তাদের ওপর তাদের চাইতে অধিক জালিম শাসক চাপিয়ে দেন।

ভেবে দেখবেন।

Popular posts from this blog

আসেন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে গ্যাজাই

ইসলাম ও গণতন্ত্র

জামাতের ভোট: একবারে না পারিলে দাও শতবার